শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিএনপিকে বুঝতে হবে : পারিবারিক নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক বিকল্প নয়

মইনুল হোসেন

বিএনপিকে বুঝতে হবে : পারিবারিক নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক বিকল্প নয়

নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলীয় ব্যানারে এবং দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে এসব পৌরসভার নির্বাচন প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হবে। স্ব স্ব দলীয় নেতৃত্বের প্রতি প্রার্থীদের আনুগত্য আছে কি নেই, সেটাই যাচাই করে দেখা এই নির্বাচনের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে। জনস্বার্থ রক্ষায় কে কতটা সততা ও যোগ্যতা দাবি করতে পারেন তার কোনো মূল্য থাকবে না। সৎ লোকেরা এ ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণে কতটা আগ্রহী সেটাই চিন্তার বিষয়। নির্বাচনের প্রতি সৎ মানুষেরা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে বলেই আমাদের ধারণা।  

শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলসমূহের অনুরোধ উপেক্ষিত হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন দুই সপ্তাহ নির্বাচন পেছাতে অস্বীকার করেছে। এতে আবারও প্রমাণিত হয়েছে নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামতের কোনো মূল্য নেই। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তাপ-উত্তেজনা প্রশমনেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না এ নির্বাচন। অরাজকতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতই থেকে যাবে।

এতদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে এটা এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা যে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নেতৃত্ব গণতন্ত্রের জন্য সুফলদায়ক নয়। বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পারিবারিক নেতৃত্ব কিছু দিনের জন্য হয়তো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পারিবারিক নেতৃত্ব স্থায়ী করার সুযোগ নিয়েছে মুষ্টিমেয় চালাক-চতুর লোকেরা। নেতৃত্ব বন্দী হয়ে পড়ে গণবিরোধী স্বার্থকেন্দ্রিক লোকদের হাতে।

একটা সময় আসে যখন কায়েমী স্বার্থের থাবাকে শক্ত করতে অবাধ ও জনগণের নির্বাচন অস্বীকৃত হয়। জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চিরন্তন ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটিই ঘটেছে। আমরা এখন এক ধরনের বন্দী অবস্থার রাজনীতি থেকে ভিন্ন ধরনের বন্দী অবস্থার রাজনীতিতে আছি। এখানে একাধিক দলের অস্তিত্ব চলবে না।

এ মুহূর্তে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে যেটা গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে তা হলো, আস্থাভাজন গণতান্ত্রিক বিকল্প হিসেবে দলটির রূপান্তর ঘটানো সম্ভব হলে দলটি গণতন্ত্রের পক্ষশক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে। নতুবা নির্যাতন-নিপীড়নে নিঃশেষিত হতে হতে দলটি নৈরাশ্যজনকভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। যদিও সরকার বিরোধিতা কখনো বিলুপ্ত হয় না, এমনটি কখনো হতে দেখা যায়নি। অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড জনজীবনে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনে। এটা সবার দেখার বিষয় যে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পঙ্গু করতে করতে এখন গণতন্ত্রকেই স্থবির করে ফেলেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে গণতন্ত্রের অনিবার্য মৃত্যু প্রতিরোধ করে গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

 

 

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্বাধীন দুটি দলের কোনোটিই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার গুরুত্ব অনুধাবন করেনি। নেতৃত্ব পরিবর্তনের কথা ভাবা হয়নি। নেতৃত্বের যোগ্যতা বা সফলতার কোনো বিচার করতে হয়নি। একদলের পর আরেক দলের ক্ষমতায় আসার যে অন্ধ নিশ্চয়তা ছিল তা নিয়েই তারা আনন্দে ছিলেন। নেতা নেতাই থাকবেন। আমরা আমাদের কাজ করে যাব।  

সংসদীয় ব্যবস্থায় পরাজিত প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রশ্ন ছাড়াই দ্বিধাহীন চিত্তে পদত্যাগ করেন। সংসদীয় দল কখন তাকে অপসারণ করবে সে জন্য অপেক্ষা করেন না। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে এ রকম চিন্তার কোনো অবকাশ ছিল না, এখনো নেই। সময়ের ধারায় এ দলগুলোর প্রত্যেকটি দল ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদ করার বণিক সমিতিতে পরিণত হয়েছে। জনগণকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা করার জন্য যে রাজনীতি তা প্রধান দুটি দলের কোনোটিকেই ভাবতে হয়নি। অসুবিধায় পড়লে তারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে দলে গণতান্ত্রিক নিয়মে নতুন নেতৃত্ব আসার সুযোগ দেবেন না। গণতন্ত্রবিরোধীদের আন্দোলনের কথা শোনাবেন অথচ নিজের দলের অগণতান্ত্রিক চেহারা দেখবেন না। স্বীকার করবেন না যে, নেতৃত্বের পরিবর্তন ভিন্ন রাজনীতি গণতান্ত্রিক রাজনীতি হতে পারে না। 

সংসদে শাসনতান্ত্রিক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার ব্যাপারেও গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা রাখার কোনো বিচার-বিবেচনা করতে কাউকে দেখা যায়নি। বিরোধী দলের ভূমিকাকে অর্থবহ করার ব্যাপারে কোনো সংসদীয় পার্লামেন্টই কাজ করেনি। বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করার আঁতাত হয়েছে।  

সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দলীয় অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার জন্য উত্সাহিত করা হয়েছে। যেহেতু সাংবাদিকরা পার্টি অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে গেলেন সেহেতু তাদের স্বাধীন সত্তা থাকল না। মোটকথা, গণতন্ত্র রক্ষার চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সাংবাদিকদের স্বাধীন অবস্থান না থাকায় গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের ভূমিকা নিজেরাই অস্বীকার করলেন। তারাও রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগীদের অংশ হয়ে গেলেন।

কিছুদিন আগে মার্কিন কংগ্রেসের মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমে আসছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গণতন্ত্র শেষ হয়ে যাবে আর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা পাবে এমনটি তো কোথাও হয় না। গণতান্ত্রিক দলের অভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশায় আছে পশ্চিমা দেশগুলো। তারা দেখছে গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব না নিচ্ছে সাংবাদিকরা না নিচ্ছে আইনজীবীরা। আইনজীবীরাও পারিবারিক অগণতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মী হওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করছেন। 

বিএনপিকে এটা অনুধাবন করতে হবে যে, আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার পূর্বের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি শেষ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে উভয়ের জন্য পারিবারিক রাজনীতিও শেষ হয়ে গেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের নির্বাচন মোকাবিলার কোনো ইচ্ছা আওয়ামী লীগের নেই। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব চিন্তার ভিত্তির ওপর নির্ভর করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী দল হিসেবে দেশ শাসনের বৈধতা খুঁজছে।

যে জায়গাতে পরিবর্তন বা সংস্কার দরকার সেখানে পরিবর্তন আনতে না পারলে বিএনপির জন্য গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনের কথা না বলাই উত্তম হবে। গণতন্ত্র উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দরকার দায়িত্বশীল এবং বিশ্বাসযোগ্য গণতান্ত্রিক বিকল্প। বর্তমানে বিএনপির সেরকম গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা নেই যা বিদ্যমান অগতান্ত্রিক রাজনীতির হুমকি মোকাবিলা করতে পারে। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান দাবি করলে বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দলের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব উপস্থাপন করতে হবে। যে দল সময়ের দাবি অনুযায়ী নতুন নেতৃত্বের কথা ভাবতে পারে না, সে দল তো শক্তিশালী কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না।  

রাজনৈতিকভাবে বিএনপির প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে, দলের এবং দলনেত্রী উভয়ের অসহায়ত্ব বৃদ্ধি পাবে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সে দলের পক্ষে কারও কোনো যুক্তিসম্মত সমর্থন থাকতে পারে না। অতীতের ন্যায় আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতাই বিএনপির নির্বাচনী বিজয়ের একমাত্র যুক্তি হিসেবে নেওয়ার সুযোগ আর নেই। এখন গণতন্ত্র রক্ষার শক্তি হিসেবে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। অবাস্তব স্বপ্নের অলস রাজনীতি চলবে না।  

এ মুহূর্তে সরকার দাবার ঘুঁটি যেভাবে সাজিয়েছে তাতে হয় আমরা একদলীয় সরকার পাব অথবা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের সংঘবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যক্তির শাসন নয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারলেই সেটা হবে গণতন্ত্র।

গণতান্ত্রিক রাজনীতি কারও জন্য শত্রুতার রাজনীতি নয়। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শত্রুতার রাজনীতি অবশ্যই বর্জন করতে হবে। অরাজকতা আর নৈরাজ্যের মধ্যে উন্নতির ঝড় উঠানো সম্ভব হলে তো সরকারের প্রয়োজন থাকত না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশায়, শান্তি ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা পেতে এবং জঙ্গিবাদ ঠেকানোর প্রয়োজনে আমরা গণতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রই বিকল্প রাজনীতি। বন্দুকের শক্তির প্রতিযোগিতা নয়।

বিএনপি নেতাদের নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক জটিলতার ব্যাপারে কোনো উপলব্ধি নেই, এটা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। একই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রাজনীতি তাদের সৃষ্টির নতুন উপকূলে নিতে পারবে না।

বিএনপি নেতৃত্বের জন্য কোন বিকল্প বেছে নেওয়া সহজ তা আমরা বলতে চাই না, তবে নিজেদের টিকে থাকার জন্যই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার সাহস দেখাতে হবে। কারও নেতৃত্বের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনীতি নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির বাস্তবতা গ্রহণ করা কোনো নেতার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো নয়। রাজনীতির সময় উপযোগী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। 

আমরা এ কথা বলতে চাই না যে, আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতির যে পথ বেছে নিয়েছে তা নিরাপদ। কিন্তু তারা শক্তভাবে এবং অন্ধভাবে এমন এক পথ বেছে নিয়েছে যে পথ থেকে প্রত্যাবর্তন তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। কাদের পরিচালনায় তারা এ পথের যাত্রী হয়েছেন তা নিশ্চিতভাবে জানা ও বলা সহজ নয়। চেনা-জানার বাইরে আওয়ামী লীগ বদলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হিসেবে ক্ষমতাসীনরা তারা নিজেরাই ঠিক করবেন দেশ কীভাবে চলবে, এটা তো মুক্তিযুদ্ধের জয়ের কথা নয়— দেশ জয়ের কথা। আওয়ামী লীগকে এ দেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক চেতনার কথা ভাবতে হবে। 

আমরা সরকারকে তাগিদ দেব এই বলে যে, ক্ষমতার উচ্চমার্গ থেকে নেমে জনগণের কাছাকাছি চলে আসুন। বর্তমানের শান্ত উপরিভাগ তেমন গভীর নয় যা প্রকৃত শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে। আকস্মিক স্ফুলিঙ্গ কখন কোথায় ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড ঘটায় আমরা কেউ তা বলতে পারছি না। এমন কিছু ঘটুক তা আমরা চাই না। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সে কারণে আমরা স্বস্তিতে নেই, তাই যা বলা প্রয়োজন তাই বলার চেষ্টা করছি। আমরা চাইলে সবাই সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারি। পরিতাপের বিষয়, আমরা শান্তির পথ খুঁজছি না। এটা অস্বীকার করে লাভ হবে না যে, আমরা এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি। বুঝতে হবে পুলিশ কোনো রাজনৈতিক শক্তি নয়, পুলিশি শক্তি কোনো রাজনৈতিক সমাধানও নয়।

-লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর