বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!

তসলিমা নাসরিন

গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!

কিছু কিছু তথ্য শুনলে আঁতকে উঠি, যেমন বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের গড় বেতন ৫১০ টাকা। শুধু ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে গৃহকর্মীর সংখ্যা কুড়ি লাখ, এদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ নারী, অনেকে শিশু। যৌন নির‌্যাতনের শিকার শতকরা ১৬.৬৭। ২০০১ থেকে ২০১০- এই দশ বছরে নির‌্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৩৯৮ জন গৃহকর্মী, আহত হয়েছে ২৯৯ জন। আমার মনে হয়, নির‌্যাতনের শিকার আর ধর্ষণের শিকার আরও বেশি গৃহকর্মী। সঠিক সংখ্যাটি হয়তো লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। তারপরও ভালো তো কিছু লোক আছে দুনিয়ায়, ভালো সংগঠনও আছে। তারা গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও শ্রম আইনে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে। জানি না আদৌ গৃহকর্মীরা তাদের প্রাপ্য সেই অধিকার পাবে কি না।

গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার গরিবের ওপর ধনীর অত্যাচার। গৃহকর্মীরা যেহেতু সাধারণত নারী, তাই গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে যে নির‌্যাতন চলে, তা নারী নির্যাতনের অংশও, গার্হস্থ্য হিংস্রতার বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অংশও। সমতার সমাজ যতদিন না গড়ে উঠবে, যতদিন না ধনী আর গরিবের মাঝে ফারাকটা কমবে, ততদিন নির‌্যাতন চলবে। তবে গৃহকর্মীরা এখন সংখ্যায় অগুনতি নয় বলে তাদের অবস্থার উন্নতি চোখে পড়ে। ছোটবেলায় দেখতাম, চাইলেই আশপাশের বস্তি থেকে কাজের মেয়ে জোগাড় করে আনা যায়। সেইসব মেয়েকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো। মশলা বাটা, পানি টানা, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা। বিনিময়ে হয়তো শুধু দু’বেলা ভাত জুটতো। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো অল্প বয়সী কিছু মেয়ে। ওরাও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পেতো সামান্য ক’টা টাকা। মণি নামের এক কিশোরী কাজ করতো, ওর মাইনে ছিল মাসে পাঁচ টাকা। ভোর থেকে মধ্যরাত- মুখ বুজে কাজ করতো। এদিক ওদিক তাকাবার অবকাশ ছিল না। ওরা প্রায়ই মার খেতো। মার খাওয়াটা ওদের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল। শুধু চড় থাপড় নয়, রীতিমত লাঠিসোটার মার। মার খেয়েও মেয়েরা থাকতো বাড়িতে। দারিদ্র্য মানুষকে কত যে আপোস করতে শেখায়, কত যে নির্মমতা মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়!

একটা বড় পরিবর্তন এলো গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি যখন বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজাতে শুরু করলো। মেয়েরা দলে দলে যোগ দিতে শুরু করেছে গার্মেন্টে, বস্তি থেকে মেয়েদের চাইলেই তুলে আনা সম্ভব নয়। সেসময় বেতন খানিক বাড়লো মেয়েদের। গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিক যা-ই ওদের ডাকুক, মনে মনে এখনও শিক্ষিত লোকরাও ওদের চাকর-চাকরানি বলেই ডাকে। গৃহকর্তা আর গৃহকর্মীর মধ্যে যে সম্পর্ক, তা আক্ষরিক অর্থে প্রভু আর দাসদাসীর সম্পর্ক। প্রায়ই শুনি গৃহকর্ত্রীরা নাকি গৃহকর্মীদের অত্যাচার করে। মেরে হাড়গোড় ভাঙছে, এমনকী প্রাণেও মেরে ফেলছে। এত ভয়ানক কাণ্ড মানুষ কী করে ঘটাতে পারে! নারীরা মমতাময়ী, মায়াময়ী, দয়াময়ী, এসবই জানতো মানুষ। তবে ভায়োলেন্সে এত পারদর্শীই বা নারী কেন! ভায়োলেন্স নারী করলেই সেটা অবশ্য চোখে পড়ে। গৃহকর্তারা চাকর-বাকরকে কী ভীষণভাবে পেটালো, কীভাবে ধর্ষণ করলো, সেটা নিয়ে খুব একটা ছি ছি শুনি না।

ভায়োলেন্স নারী-পুরুষ উভয়েই করতে জানে। তবে নারীর সুযোগ হয় না বলে পুরুষের তুলনায় কম ভায়োলেন্স করে। সুযোগ পেলে নারীও ভায়োলেন্স করে। সুযোগটা নারীরা পায় ঘরে, কাজের মেয়ের ওপর। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তারা দ্বিধা করে না। স্বামীরা অন্যায় করলে তারা স্বামীকে পেটাতে পারে না, সমাজের দশটা অত্যাচারী পুরুষকে তারা মারধর করতে পারে না, কারণ এই সমাজে নারীরা পুরুষের অধীনে বাস করতে বাধ্য হয়। গৃহকর্ত্রীরা চাকরদের গায়ে তত হাত তোলে না, যত তোলে চাকরানিদের গায়ে। কারণ হায়ারারকিতে চাকরানিরা চাকরদের চেয়ে নিচে। সবচেয়ে নিচে যে, সবচেয়ে অসহায় আর নিরাপত্তাহীন যে, সবচেয়ে দরিদ্র যে, তাকেই নির‌্যাতন করছে নারীরা। এই নারীদের অধিকাংশই পরনির্ভর, পরের টাকায় অর্থাৎ স্বামীর টাকায় চলছে, এই নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা নির‌্যাতিত, এই নারীরাও নারী হয়ে জš§ নেওয়ার অপরাধে নিজের প্রাপ্য সব অধিকার এবং স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। এই নারীদের অনেকেই সংসারের দেখভাল করার নামে সংসারে যে শ্রমিকটি সবচেয়ে বেশি শ্রম দিচ্ছে, তাকেই ভায়োলেন্সের শিকার করছে। অত্যাচারিতও সুযোগ পেলে অন্যের ওপর অত্যাচার করে। দরিদ্র-পুরুষ ধনী-পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত হয়, এই অত্যাচারিত দরিদ্র-পুরুষও যদি কাউকে অত্যাচার করে, সে দরিদ্র-নারী। দরিদ্র নারীরা দু’বার অত্যাচারিত হচ্ছে, একবার ধনী নারী-পুরুষ দ্বারা, আরেকবার দরিদ্র-পুরুষ দ্বারা।

বাংলাদেশে আমি একুশ বছর নেই। ইউরোপের নির্বাসিত জীবনে একবার একটা মেয়েকে চাকরি দিয়েছিলাম। আমি তখন পশ্চিম বার্লিনে থাকি। বার্লিন ওয়াল ধসে পড়ার পরের কথা বলছি। পূর্ব বার্লিনের একটা জার্মান মেয়েকে মোটা টাকা মাইনের চাকরি দিয়েছিলাম। তিন বা চার ঘণ্টার জন্য আমার বাড়িতে আসতো। বাসন মাজতো, ঘর পরিষ্কার করতো, রান্না করতো, কাপড় ধুতো, ইস্ত্রি করতো। আমি সোফায় বসে চা খেতে খেতে অথবা বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর কাজ দেখতাম আর ওর জীবনের গল্প শুনতাম। ভীষণ আলসে হয়ে উঠেছিলাম অথবা একা একা সংসারের কাজ করতে আর ভালো লাগছিল না। তাই কাজের মেয়ে রাখার ইচ্ছেটা হয়েছিল। বেশিদিন পোষাতে পারিনি ওই কাজের মেয়ে। ইউরোপ আমেরিকায় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাংকে না থাকলে চাকর-বাকর রাখা যায় না।

এরপর কলকাতায় রেখেছি কাজের মেয়ে, দিলি­তেও রেখেছি। অফিসে চাকরি দেওয়ার মতো করে চাকরি দিতে হয়। দীর্ঘদিন পাশ্চাত্যে থেকে স্বভাবের বদলও ঘটেছে। কাজ যারা করছে ঘরে, তাদেরকে মানুষ বলে ভাবতে শিখেছি, সহকর্মীর মতো শ্রদ্ধা করতে শিখেছি, ভালো মাইনে দিতে শিখেছি, তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া, এক সোফায় বসে টেলিভিশন দেখা, এক বিছানায় তাদের শুতে দেওয়া- সবই নিশ্চিন্তে নিঃসংকোচে করি। যেটা ভারতের প্রায় কাউকেই করতে দেখি না। ইচ্ছে করলেই তো মানুষ দরিদ্রের প্রতি সদয় হতে পারে, নিজের ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে পারে, অন্যের দারিদ্র্য ঘোচাতে সাহায্য করতে পারে, সহমর্মী হতে পারে। ইচ্ছেটাই মানুষ করছে না। বিশেষ করে ধনীরা আর ধনীদের যে শ্রেণি অনুকরণ করতে পছন্দ করে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি।

তবে দয়ামায়া মমতা জাকাত সদগা ভিক্ষে ইত্যাদি ঢেলে অগাধ দারিদ্র্য ঘোচানো যায় না। দরিদ্রের প্রতি ঘৃণা যে সমাজে, সে সমাজে ব্যাঙের ছাতার মতো গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বা গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি করেও মানুষের দারিদ্র্য সম্পূর্ণ ঘোচানো যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি, লোভ, হিংসেকে অতিক্রম করার উপায়ও জানা উচিত। কেউ ধনী হবে, কেউ দরিদ্র থেকে যাবে, এটাকে নিয়ম না ভেবে- দরিদ্র আর ধনীর মাঝখানের ব্যবধানটাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। রাজনীতিকরা, ধনীদের যাদের ভূরি ভূরি আছে, তাদের ঠেলে খাওয়াচ্ছেন। দরিদ্ররা অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। ঈশ্বর তাদের অভাবে ডুবিয়ে ইমান পরীক্ষা করছেন, এরকম একটা হাস্যকর কথা প্রায়ই শুনি। ধনীরা এবং শাসকরা সে কারণে ঈশ্বর এবং ধর্মকে ব্যবহার করেন গরিবদের শান্ত এবং সন্তুষ্ট রাখার জন্য। তা না হলে প্রলেতারিয়েত বিপ্লব ঘটে গেলে তো মুশকিল।

নারীরা কাজের মেয়েকে নির‌্যাতন করছে। সমাজের এক নির‌্যাতিত শ্রেণী সমাজের আরেক নির‌্যাতিত শ্রেণীকে নির‌্যাতন করছে। এই ছোট নির‌্যাতন আমাদের চোখে পড়ে, আর বড় নির‌্যাতন, যেটি ক্ষমতাশালীরা করে, দরিদ্রকে আজীবন দরিদ্র করে রাখার রাজনীতি, সমতার সমাজকে ধারে কাছে ভিড়তে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র- সেটি খুব বেশি কারোর চোখে পড়ে না। লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর