বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মহান বিজয়ের দিনে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মহান বিজয়ের দিনে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন

গত পর্ব ছিল ৮ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কিছু লিখিনি। গতকাল ছিল ১৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। আজ মহান বিজয় দিবসে লিখছি বলে গতকাল লিখিনি। এই ক’দিন কত চিঠি, কত ফোন, ‘আপনার লেখায় মুক্তিযুদ্ধের কিছু পেলাম না। আপনাকে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলির কথা লিখতে হবে।’ কী লিখব? ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন রেডিও, টিভি, পত্রপত্রিকায় নাপাক পাকিস্তানি হানাদারদের যখন ‘পাক বাহিনী’ বলতে শুনি তখন আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না।  কেউ কেউ ‘ভারত-পাক’ বা ‘পাক-ভারত’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভারত পবিত্র, পাকিস্তান পবিত্র ভূমি বা দেশ— এ নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ‘পাক’ নয়, তারা নাপাক। ৩০ বছর আগে ‘স্বাধীনতা-৭১’ লিখেছিলাম। অত বছর আগে আমিও ততটা বুঝিনি, তাই কোনো কোনো জায়গায় নাপাক হানাদারদের পাক বলা হয়েছিল। প্রায় দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ‘স্বাধীনতা-৭১’ থেকে সেই নাপাক তাড়িয়ে বইটিকে পাক পবিত্র করেছি। এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে সত্যিই নিজেকে বেশ ছোট ছোট মনে হয়। আমিও মুক্তিযোদ্ধা, আর মালেক, তারেক, হুমায়ুনরাও মুক্তিযোদ্ধা। বরং যারা এখন সরকারি দলে তারা আমার চেয়ে বড় যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো ছোট-বড় নেই, সব এক। তাই কারও কোনো গুরুত্ব বা মর্যাদা নেই। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের এই আবাস ভূমির সবচেয়ে গৌরবের দিন। হাজার বছরে মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন নিরঙ্কুশ বিজয় আমরা আর কখনো অর্জন করিনি। ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-বেদনা, পছন্দ-অপছন্দ অনেক পিছু টানের পরও রক্তের দামে কেনা স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড শাশ্বত সত্য। এই মহান বিজয়ের দিনে সব শহিদি আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর দেশবাসীকে জানাই সালাম এবং আন্তরিক অভিনন্দন। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও অন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং পথপ্রদর্শকদের। কোনো জাতির স্বাধীনতা বারবার আসে না, আর এমন রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতা তো নয়ই। স্বাধীনতার এত বছর পর স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে নানা কথা শুনি। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের প্রশ্নে স্বাধীন দেশে কোনো প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের এখানে আছে। কেন যেন আমরা কোনো ব্যাপারেই একমত হতে পারি না। স্বাধীনতার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের জঘন্য অত্যাচারের কথা তুলে ধরতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কীভাবে লোকজন ঘরে আটকে রেখে আগুন দিয়েছে, মায়ের কোলের শিশু শূন্যে ছুড়ে বেয়নেট বিদ্ধ করেছে, পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক গুলি করে মানব সভ্যতা কচুকাটা করেছে। এসব সময়মতো যদি সবাই মিলে তুলে ধরতে পারতাম তাহলে হানাদার দালাল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বলার কেউ থাকত না। আমাদের ব্যর্থতা অবশ্যই ক্ষমাহীন। কিন্তু তাই বলে দেশের প্রচলিত আইনের সমস্ত নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে বিচার করার পরও কোনো শক্তিশালী দলের সদস্য বলে প্রশ্ন উঠবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে পাকিস্তান যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা নিয়েছে তাতে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও পাকিস্তানি দালালদের যুদ্ধাপরাধে বিচার করলে তারা এভাবে কূটনৈতিক সীমা লঙ্ঘন করে আস্ফাালন করবে? আবার রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশকে তাদের বাপ-দাদার তালুক ভাববে এটা বরদাস্ত করা যায় না। মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকতেই এত বড় স্পর্ধা। পাকিস্তানকে এর একটা দাঁতভাঙা জবাব অবশ্যই দিতে হবে। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হতাম আমাদের কী হতো? যেসব বাঙালি সে সময় পাকিস্তানের হয়ে খুনখারাবি করেছে, আমরা তাদের কোলে রেখেছি, পাকিস্তানিরা কি আমাদের কোলে রাখত নাকি গর্দান নিত? পাকিস্তান জিতলে পাকিস্তানবিরোধীদের গর্দান নিতে কোনো দোষ নেই, পাকিস্তান হারলে বাংলাদেশবিরোধীদের গর্দান নিলে যত দোষ। যুদ্ধাপরাধের বিচারে সরকারের দৃঢ়তা কোটি কোটি দেশবাসী শতকণ্ঠে সমর্থন করে। দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে গুটিকয়েক রাষ্ট্রবিরোধী বাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশপ্রেমিকের জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। দেশের প্রশ্নে দেশের স্বাধীনতা ও সম্মানের প্রশ্নে আমরা সবাই এক ও অভিন্ন, একই মন্ত্রে দীক্ষিত। এক্ষেত্রে যে যখন ক্ষমতায় থাকেন বা থাকবেন তাকে অবশ্যই দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব করতে হবে।

 

 

স্বাধীনতার মাস, বিজয়ের মাসের ১২ ডিসেম্বর নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর শীলান্যাস করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যমুনা সেতু উত্তরবঙ্গের সঙ্গে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। ভুয়াপুরের গায়ে সিরাজগঞ্জ যেতে আগে লাগত একদিন, এখন লাগে ১৫ মিনিট। তবে এপার-ওপারের বাসিন্দা আত্মীয়স্বজনের যমুনা সেতুতে কোনো লাভ হয়নি। গাড়ি নিয়ে পারাপার হতে হাজার টাকা লাগে। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। দূরের লোকদের সুবিধা হলেও পাড়ের লোকদের কষ্ট। বহু কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতির চেহারা বদলে দেবে। আর ক’দিন পর পৃথিবীর সর্বত্র দেশের সীমানা পেরিয়ে যাতায়াত আরও অনেক সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু এক অসম্ভব বিপ্লাত্মক ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সারা দুনিয়া যেমন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে অনায়াসে পৌঁছবে, তেমনি চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যেতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। বিশ্বব্যাংকের এত ছলাকলার পরও এই অসাধারণ সাহসী পদক্ষেপের জন্য স্বাধীনতার মাসে বঙ্গবন্ধুকন্যা, আমার মায়ের মতো বোন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর ভুয়া যোদ্ধা নিয়ে মারামারি লেগেই আছে। কেউ হয়তো স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। হঠাৎ কেউ বলে বসল, ভুয়া। শুরু হয়ে গেল তদন্ত। কারা তদন্ত করবে? যাদের জন্ম স্বাধীনতার পর। যে অভিযোগ করছে অমুকে মুক্তিযোদ্ধা না, সে কে? খুঁজে দেখার দরকার নেই। কেউ কিছু বললেই হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিই বড় দুর্দিন। যেহেতু তেমন কোনো ধনবান শিক্ষিতরা প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, তাই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ভিত ছিল খুবই দুর্বল। এখন তা আরও দুর্বল হয়েছে। সরকারি একটা পিয়নের চেয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের মানসম্মান-মর্যাদা কম। ভাতা পায় সেও ফকির মিশকিনের চেয়ে অসম্মানজনক। মনে হয় সম্মান দিয়ে আমরা যেন কিছু করতে শিখিনি। বিজয়ের এদিনে কথাগুলো হূদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে এলো বলে উচ্চারণ করলাম। আজকাল একজন সরকারি কর্মচারীর সর্বনিম্ন বেতন আর জাতীয় সম্পদ মুক্তিযোদ্ধাদের কী সামান্য সম্মানী! তিন লাখ কোটি টাকা যে দেশের বার্ষিক বাজেট, সেই দেশে দু-এক হাজার কোটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খরচ করতে কেন এত কৃপণতা? মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর তেমন বেশি কিছু করার সময় বা সুযোগ কেউ পাবেন বলে মনে হয় না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রীর হাতে এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, তার বাবার হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামীদের জন্য কিছু একটা করার সুযোগ আছে। সেটা আর কতদিন থাকবে বলতে পারি না। কিন্তু ভালোভাবে কাজটা করলে তিনি সত্যিই ভালো করবেন। মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস হাজার হাজার বছর থাকবে, সেই সঠিক ইতিহাসের শুরুর কাজটা এখনো জননেত্রীর হাতে আছে। এই মহান দিনে আমি অবশ্যই আশা করব, সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থেকে তিনি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হবেন। যেহেতু ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের দিন। এমন মর্যাদার দিন আমাদের জীবনে তেমন আর আসেনি। আর সেই ঐতিহাসিক দিনে নিজে সম্পৃক্ত ছিলাম এটা আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। দর্শক হিসেবে নয়, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নিয়ে বাহুবলে হানাদারদের পদানত করতে কাদেরিয়া বাহিনীর কয়েক হাজার যোদ্ধাসহ মিত্রবাহিনীকে পথ দেখিয়ে হানাদার সেনাপতি টাইগার নিয়াজির গুহা এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতজানু হানাদারদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে শামিল ছিলাম।

সবাই যুদ্ধের কথা শুনতে চায়। যুদ্ধ যুদ্ধই। যুদ্ধ শোনানোর মতো নয়, বলার মতো তো নয়ই। যারা আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একেবারে ছায়ার মতো ছিলাম তাদের পক্ষে কোনটা ছায়া আর কোনটা কায়া আলাদা করা কঠিন। তাই কোনটা যুদ্ধ, কোনটা নয় নিরূপণ করা মুশকিল। যারা দূর থেকে যুদ্ধ দেখেছে তাদের গল্পের মতো বলা যত সোজা, আমরা যারা যুদ্ধে যুদ্ধে অঙ্গার হয়েছি, সেই অঙ্গার থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য ভীষণ কঠিন।

সেদিন টেলিভিশনে শুনলাম, ৮ তারিখ জামালপুর স্বাধীন হয়েছে। রেডিও-টিভি-পত্রিকা ইদানীং কেন যেন নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করছে। রাজধানী ঢাকার বাইরে উত্তরাঞ্চলে সব থেকে শক্ত ঘাঁটি ছিল জামালপুর। জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইল পাকিস্তান হানাদারদের এক ডিভিশন সৈন্য ছিল। জামালপুর, ময়মনসিংহে এক এক দুই ব্রিগেড, টাঙ্গাইলে এক ব্রিগেড। সত্য কথা বলতে কী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনায় ঢাকা দখলের কথা ছিল না। ঢাকা দখল করতে গেলে প্রচণ্ড যুদ্ধ হতে পারে তাতে ঐতিহাসিক ঢাকা শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, লোক ক্ষয় হবে অনেক। অত কিছু করেও যদি দুর্ধর্ষ পাকিস্তানিদের পদানত করা না যায় তাই পরিকল্পনা ছিল চারদিক থেকে ঢাকাকে চেপে ধরে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটা কিছু করার। আর যদি চাপের মুখে ঢাকার পতন ঘটে সে তো খুবই ভালো। সে জন্য মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পত্রিকার সবক’টা পাতা ভরে যাবে তাই ওদিকে যাচ্ছি না। সোজাসাপ্টা ২-৪ কথা বলছি। যুদ্ধের ৪৫ বছর পর অনেক নেতা যোদ্ধা নতুন নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করছে এটাই স্বাভাবিক। এর আগেও এমন হয়েছে। মিত্রবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী দল ছিল পুবদিকে আখাউড়ায়। তাদেরই ঢাকা আসার কথা ছিল। যশোর, খুলনা, দিনাজপুর যেসব সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল তাদের কাজ ছিল পদ্মার পশ্চিমপাড় পর্যন্ত। ঢাকার উত্তরে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-জামালপুর-নেত্রকোনা— এসব জায়গায় কোনো শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। পরিকল্পনার শুরুর দিকে কথা ছিল ডিসেম্বরের দিকে হিমালয়ে বরফ পড়লে চীন সীমান্ত থেকে একটি মাউন্টেন ডিভিশন উঠিয়ে এনে মেঘালয়ের তুরা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শেষের দিকে ভারত মনে করে মাউন্টেন ডিভিশন সরিয়ে নিলে চীন গোলমাল করতে পারে। তাই সেখান থেকে আর মাউন্টেন ডিভিশন তুলে আনা হয়নি। একেবারে শেষ পর্যায়ে অমন হওয়ায় এখান সেখান থেকে খুঁজে পেতে কিছু সৈন্য দিয়ে দুটি ব্রিগেড খাড়া করা হয়। প্রতি ব্রিগেডে নিয়মিত সৈন্য থাকে আড়াই-তিন হাজার। তাদের ছিল দেড়-দুই হাজার। সেখানে আরও ৪-৫ হাজার করে মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ব্রিগেড খাড়া করা হয়। তারাই সীমান্ত অতিক্রম করে গারো পাহাড় থেকে নেমে আসে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে তেমন বাধা না পেলেও জামালপুরের কামালপুর সীমান্তে প্রচণ্ড বাধা পায়। যখন কোনো মতেই কামালপুর সীমান্ত ঘাঁটির পতন ঘটানো যাচ্ছিল না, তখন কামালপুর ঘাঁটি পাশ কাটিয়ে মিত্রবাহিনী শেরপুরের দিকে এগুতে থাকে। জামালপুরে তারা আবার বাধা পায়। একদিকে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ, অন্যদিকে হানাদারদের সুদৃঢ় ঘাঁটি। হানাদাররা পাকা বাঙ্কার করে জামালপুরে ছিল। ভারতীয় বিমান বাহিনী হাজার পাউন্ডের বোমা ফেলে। তাতেও তেমন কিছু হয় না। দুদিন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আটকে থেকে আত্মসমর্পণের জন্য হানাদার ঘাঁটিতে দূত পাঠায়, অন্যদিকে দক্ষিণ থেকে আক্রমণ করতে আমাদের অনুরোধ করা হয়। কাদেরিয়া বাহিনীর একটি বিরাট দল ৮ তারিখ থেকে জামালপুরের ওপর লাগাতার আক্রমণ করতে থাকে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সহায়তায় দেশি নৌকায় এক ব্যাটালিয়ন মিত্রবাহিনী ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে উত্তর দিক থেকে আঘাত হানলে তারা ঘাঁটি ছেড়ে পালাতে থাকে। এতে ৯ তারিখ গভীর রাত থেকে জামালপুর হানাদার ঘাঁটি মুক্ত হতে থাকে। আঘাতের পর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হানাদাররা একদিকে জামালপুর, অন্যদিকে ময়মনসিংহ থেকে পিছিয়ে মধুপুরে একত্র হয়। মধুপুর থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে ঘাটাইল তখন আমাদের দখলে। বিমান সাহায্য চাওয়ায় ভারতীয় বাহিনী আমাদের বিমান সহায়তা করে। মধুপুরে বিরাট পাকিস্তান বাহিনীকে আটকে না রেখে পেছন থেকে আক্রমণ করা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়। তাই প্রতিরোধ উঠিয়ে নিলে তারা টাঙ্গাইলের দিকে পিছিয়ে আসতে থাকে। সে সময় তাদের শত শত দেশীয় সহযোগী রাজাকার-আলবদরদের ফেলে রেখে যায়। এভাবেই চলে ১০ তারিখ সারা দিন। দুপুরের পর বারবার খবর আসতে থাকে ছত্রীসেনা নামানো হবে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা কর। পরিকল্পনাটা আগে থেকেই স্থির ছিল। বিকালে বরুলিয়া, ভুক্তা, চিনামুড়া, চামুরিয়া, মহেলা, পাঠন্দ, পৌলি বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছত্রীবাহিনী অবতরণ করে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন নিরাপদে ছত্রীসেনা অবতরণ করেছে কিনা জানি না। একজন ছত্রীসেনা গাছের ডালে আটকে সামান্য আহত এবং প্যারাসুড ছিঁড়ে গিয়ে একটি জিপ ভেঙে চুরমার হয়। কিছু ছত্রীসেনা পিছিয়ে যাওয়া হানাদারদের সামনে পড়ায় একটা খণ্ডযুদ্ধ হয় এবং সে যুদ্ধে কয়েকজন আহত-নিহত হয়। রাত নেমে এলে ছত্রীসেনাদের সংহত করা নিয়ে এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়।

১১ তারিখ টাঙ্গাইল স্বাধীন হয়। চারদিক থেকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা যখন শহরে ঢুকতে থাকে তখন টাঙ্গাইলবাসী অবাক হয়ে যায়— এই অল্প সময়ে এত মুক্তিবাহিনী হলো কী করে! যে হানাদাররা ছিল শহরে, চলাফেরা করত মহাসড়কে তারা শহর এবং সড়ক ছেড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। কত জায়গায় মাটির তল থেকে মুলা, আলু, কচু তুলে খাবার চেষ্টা করে। ওয়াবের মুরগি ধরার মতো গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ খালি হাতে হানাদারদের ধরে ধরে মুক্তিবাহিনীর কাছে জমা দিতে থাকে।

১১ তারিখ সন্ধ্যার দিকে টাঙ্গাইল শহর পিছনে ফেলে ব্রিগেডিয়ার ক্লের ছত্রীসেনাসহ জামালপুরের কলাম মির্জাপুর পর্যন্ত এগিয়ে যায়। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজির নেতৃত্বে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা কলাম গভীর রাতে টাঙ্গাইল শহর পার করে। দুটি কলামই ১৩ তারিখ একটি নবীনগর, অন্যটি কড্ডার মৌচাকে ঘাঁটি গাড়ে। অন্যদিকে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রায় ছয় হাজার যোদ্ধা সানসিং বাবাজির কলামের আগে আগে গ্রামের পথ ধরে মিরপুরের দিকে এগিয়ে চলে। ওদিকে ১৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হকের ঠ্যাঙ্গারবান্দের বাড়ির কাছে আমাদের হাতে ময়মনসিংহ এবং জামালপুরের দিক থেকে পালিয়ে আসা ব্রিগেড কমান্ডার কাদের খানসহ দুটি ব্রিগেডের ৩১ জন অফিসার ধরা পড়ে। তাতে জামালপুর-ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে আসা অল্প কিছু সংখ্যক সৈন্য তারা আর ঢাকার দিকে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করতে পারেনি। একদিকে কামালপুর, অন্যদিকে হালুয়াঘাট দিয়ে নেমে আসা মিত্রবাহিনীকে কোথাও পাকিস্তানি হানাদারদের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার সানসিংয়ের সঙ্গে সাভারে হানাদারদের ১৫ তারিখ সারা রাত মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। এক ব্যাটালিয়ন শক্তির হানাদার ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে মিত্রবাহিনীরও ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের দিনে ব্রিগেডিয়ার সানসিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে হেলিকপ্টারে প্রথমে মৌচাক, পরে আমরা হেমায়েতপুরে এসে অবতরণ করি। ব্রিগেডিয়ার সানসিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু মেজর জেনারেল নাগরা মাত্র ৮-১০ দিন আগে শেরপুরে এসে যোগ দেন। উত্তর দিক থেকে নেমে আসা কলামের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল গিল। কামালপুর বকশিগঞ্জের মাঝামাঝি এক মাইন বিস্ফোরণে তার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি গুরুতর আহত হন। সেখানে তার জায়গায় জেনারেল নাগরাকে আনা হয়। নাগরার কপালেই জোটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় টিকা।

আমরা হেলিকপ্টার থেকে নেমে হেমায়েতপুরের পুবে একটি ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে জিপের বনাটে ম্যাপ ফেলে দেখছিলাম। এখন দেখা যায় না, কিন্তু তখন শেরেবাংলানগর, সংসদ ভবন স্পষ্ট দেখা যেত। বহুদিন পর ঢাকা শহর দেখে মনে বিজয়ের আনন্দ উঁকি মারছিল। ১৪, ১৫ দিন দুটি ছিল অনাক্রমের আওতায়। বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ঢাকার ওপর আক্রমণ বন্ধ ছিল। ১৬ তারিখ ১০টা থেকে আবার আক্রমণের কথা ছিল।  তাই হেমায়েতপুরের পাশে ব্রিজের উপরে জিপের বনাটে এক টুকরো কাগজ ফেলে আমাদের পক্ষে জেনারেল নাগরা লিখলেন,

‘প্রিয় আবদুল্লাহ,

আমরা এসে গেছি। তোমার সব ভেল্কি খতম হয়ে গিয়েছে। আমরা তোমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছি। বুদ্ধিমানের মতো আত্মসমর্পণ কর। না হলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আমরা কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সঙ্গে আচরণ করা হবে। তোমাকে বিশেষভাবে লিখছি, আত্মসমর্পণ করলে তোমার জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে।

তোমারই

মেজর জেনারেল নাগরা

১৬/১২/৭১ ইং

০৮-৩০ মিনিট।’ (চলবে)।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর