বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এক রাজাকারের মেয়ের প্রতি শ্রদ্ধা

মুক্তিযোদ্ধা এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান

এক রাজাকারের মেয়ের প্রতি শ্রদ্ধা

আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার জাইগীর আড়পাড়া গ্রামে। সত্তরের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন আমার বাবার খুবই কাছের মানুষ মরহুম এম এ খায়ের। তার নির্দেশে আমার বাবা যুদ্ধে যাওয়ার উপযুক্তদের বাছাই করে চিঠি লিখে ভারতে পাঠালেও আমি বাবাকে না জানিয়েই গোপনে চলে যাই। পথ জানা নেই। একজন নৌকার মাঝিকে গাইড হিসেবে টাকার বিনিময়ে সঙ্গী করি। আমাদের দলনেতা ছিলেন ১। মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী মোল্লা (২ মাস আগে মৃত্যুবরণ করেন), ২। কাজী কাওছার, ৩। মজিবর রহমান মোল্লা, ৪। কাজী আশরাফ আলী এবং আমিসহ মোট ৫ জন।  চলতি পথে ৪ দিন ৪ রাত শুধু সঙ্গে থাকা সামান্য শুকনো চিঁড়া, পাটালি গুড় ও পানি খেয়ে আছি। সন্ধ্যা রাতে এসে পৌঁছলাম ঝিকরগাছা সিএন্ডবি রাস্তার পাশে একটি ঝোপের ভিতর। রাস্তায় আরও বড় বিপদ অপেক্ষমাণ। রাস্তা সোজা পার হওয়ার উপায় নেই। রাস্তার ওপারে বড় গভীর খাল। সিএন্ডবি রাস্তা প্রায় ১ কি.মি. দৌড়ে পার হয়ে খাল পার হওয়ার রাস্তা। ওই রাস্তার ওপর দিয়ে ২০/২৫ মিনিট পর পর পাক আর্মির পেট্রল গাড়ি চলে। ওদের সামনে পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা ঝোপের মধ্যে আর্মির পেট্রল গাড়ির সময়ের ব্যবধান অবলোকন করে অবশেষে একটা গাড়ি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিএন্ডবি রাস্তায় উঠে দৌড় শুরু করেছি। দুর্ভাগ্য হঠাৎ আমাদের মুখের ওপর মাত্র ১৫/২০ গজ দূরত্বের পাক-আর্মির পেট্রল গাড়ির দুটি লাইট সার্চ লাইটের আলোর মতো জ্বলে উঠল।

সম্ভবত ওরা রাস্তায় লাইট বন্ধ করে নীরবে পাহারা দিচ্ছিল। আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা রাস্তার পাশেই খালের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরিয়ে ওপারে জমির আলের আড়ালে আত্মরক্ষা করি। ওদিকে পাক আর্মির পেট্রল পার্টি গাড়ি থেকে নেমে রাস্তাকে আড় হিসেবে ব্যবহার করে বৃষ্টির মতো প্রায় আধাঘণ্টা ব্রাশফায়ার করে পুনরায় গাড়িতে উঠে চলে যায়। আমরা কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যাই। আমরা পাঁচজন উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু লতিফ ভাইয়ের দেওয়া গাইডের সন্ধান পেলাম না। সে জীবিত না মৃত খোঁজার সময় হাতে নেই। কারণ যে কোনো মুহূর্তে পাক আর্মির পুনরায় আক্রমণের আশঙ্কায় পশ্চিম দিকে দৌড় শুরু করলাম। কাদা মাটিতে আমরা মূর্তির মতো হয়ে গেছি। কাউকেই চেনা যাচ্ছে না। মাইলখানেক যাওয়ার পর আর শরীরে শক্তি নেই পথ চলার। মনে হচ্ছিল এখনই মারা যাব। এ এলাকা নিরাপদ ভেবে আমরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে কয়েকটি টিনের ঘরওয়ালা একটি বাড়িতে আশ্রয় চাই। উল্লেখ্য, ওই সময় যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল তাদের টিনের ঘর থাকত। বাকিদের ছনের ঘর। বাড়ির সামনে দেখলাম একজন সাদা লুঙ্গি সাদা পাঞ্জাবি টুপি পরিহিত দাড়িওয়ালা বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক। আমাদের মধ্যে একজন শুধু ভাত খাওয়ার জন্য মিথ্যা কথা বলল যে, চাচা আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসেছি, আমাদের গুলি ফুরিয়ে গেছে। ভারতে যাচ্ছি গুলি আনতে। আমরা ক্ষুধার্ত তাড়াতাড়ি আমাদের খেতে দিন। ওই দিনই ইপিআর এবং পাক আর্মিদের মধ্যে সশস্ত্র সম্মুখযুদ্ধ হয়।

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর থেকে কয়েকজন লোক ডেকে এনে আমাদের গা ধোয়ার ব্যবস্থা করলেন। লুঙ্গি গামছা দিলেন। কাচারিঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। তাদের আপ্যায়ন দেখে মনে হলো, চাচা আমাদের জন্য হাজার বছর অপেক্ষা করছেন। এত ভালো মানুষও দুনিয়াতে আছে। গরম ভাত, কুমড়াসহ কুইচা মাছের তরকারি আর ডাল। খেতে বসেছি সবাই। গোগ্রাসে গিলছে, মনে হচ্ছে জীবনে কোনো দিন ভাত খাইনি। হঠাৎ অনুভব করলাম বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কে যেন পাটখড়ি দিয়ে আমার পিঠে খোঁচা মারছে আর ফিস ফিস করে কী যেন বলছে। আমি উঠে কাচারিঘরের পিছনে যেতেই আমার বয়সী একজন সুন্দরী মেয়ে ভীত কণ্ঠে বললেন আপনারা এখানে মরতে এসেছেন কেন? আর জায়গা পেলেন না? আমার বড় ভাই রাজাকারের কমান্ডার, কাচারিঘরের আপ্যায়নকারী ব্যক্তিটি আমার বাবা, তিনিও রাজাকার কিংবা শান্তি কমিটির লোক ঠিক মনে নেই এ রকম কিছু বলেছিলেন। পাশেই পাক আর্মি ক্যাম্প ও রাজাকারের ক্যাম্প। সেখানে খবর দেওয়া হয়েছে। আপনাদের জবাই করা হবে। মেয়েটি বললেন, দোহাই আপনারা এখনই পালান। অজানা মেয়েটির এই খবরটিতে আমার শরীরের রক্ত শীতল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কাচারিঘরে ঢুকে সহযোদ্ধা বাকি চারজনকে বললাম এখনই বের হতে হবে। কে কার কথা শুনে। বাকি চারজনই খেয়ে ঘুমানোর জন্য মনোস্থির করেছে। তারা আমার কথা শুনছে না। বাড়িওয়ালা রাজাকার চাচা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা বন্ধ করছে। তখন আমি চিত্কার দিয়ে বললাম আর্মি আসছে, ওরা আমাদের জবাই করবে। চাচা কিছুতেই যেতে দেবে না। ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমরা বেরিয়ে দৌড় শুরু করলাম। আধা মাইল দৌড়ানোর পর দেখি ৫০-৬০টি টর্চ লাইটের আলো আমাদের দিকে আসছে। আমরা ওদের দিকেই যাচ্ছি। তখন পালানোর পথ নেই। পাশেই দেখি বেতের ঝোপ (জঙ্গল) সেখানেই ঢুকে পড়ি। কোনো রকমে আত্মরক্ষা করে জীবন বাঁচাই। রাজাকার ও পাক আর্মিরা বেতের ঝোপ পার হয়ে কিছু দূর গেলে আমরা বেতের কাঁটায় রক্তাক্ত জখম হয়ে দীর্ঘশ্বাসে কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা দৌড়ে একটি বড় মাঠের মধ্যে মাটির কোলে আশ্রয় নেই। করুণাময় রাহমানুর রাহিম, রাজাকারের মেয়ের মাধ্যমে আমাদের পাঁচটি জীবন বাঁচিয়ে দিলেন। এরপর আর কোনো সমস্যা হয়নি। পরদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেলা প্রায় ১১টার দিকে ভারতের বর্ডারে পৌঁছাই। আমরা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারসহ সেই রাজাকারের মেয়ের কাছে চির ঋণী হয়ে আছি। সেই নাম না জানা সুন্দরী মেয়েটির চেহারা মনে নেই। বেঁচে আছে কিনা, থাকলে কেমন আছে, কোথায় আছে জানি না। সেই মেয়েটির বাবা-ভাইয়ের পরিচয় যাই হোক সে আমাদের আত্মার আত্মীয়, ইতিহাসের অংশ। এরপর তার পরিণতি কী হয়েছিল— জানার কৌতূহল থাকলেও সুযোগ হয়নি।  তিনি মনেপ্রাণে একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সেই নাম না জানা রাজাকারের সুন্দরী মেয়ের প্রতি রইল শত সহস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ।

সর্বশেষ খবর