শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ইসলামের দৃষ্টিতে জাতীয় ঐক্য ও বিজয়

মুফতি এহসানুল হক জিলানী পেশ ইমাম

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

মহান ইসলাম পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালজয়ী ও পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। মানব ইতিহাসে যার সোনালি স্বাক্ষর উজ্জ্বল ও ভাস্বর। এর পূর্ণাঙ্গতার কথা এবং ব্যাপকতার সুমহান ধারা বিবরণীতে পবিত্র কোরআনের ভাষায় ইরশাদ হয়েছে।

আজ এই দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার অপার নেয়ামত পরিপূর্ণ রূপে দান করলাম এবং এই ইসলামকে দীন হিসেবে তোমাদের কল্যাণে প্রদান করে আমি সন্তুষ্ট হলাম। (সূরা মায়েদা-৬) তাই দেখা যায়, মানবজীবনের ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আন্তর্জাতিক সব বিষয়ের সমস্যায় ইসলামে রয়েছে অনুপম ও অনুকরণীয় সুষুম এবং পরিপূর্ণ সমাধান। অত্র নিবন্ধে জাতীয় ঐক্য এবং মহাবিজয় সম্বন্ধে ইসলামের দালিলিক বর্ণনা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় এমনভাবে আলোচিত হয়েছে যা পৃথিবীর মুক্তিপাগল মানুষের মিছিলকে করেছে সুবিস্তৃত। তাদের সংগঠনকে বানিয়েছেন সুগঠিত সুঠাম বাহুবন্ধনে শক্তিমান এবং তাদের দলবদ্ধ জীবনকে করেছে নিশ্ছিদ্র শক্ত প্রাচীরের ন্যায়। মুমিনদের লক্ষ্য করে ইরশাদ হয়েছে, ঐক্যবদ্ধভাবে মহান আল্লাহর রুজ্জু শক্ত হাতে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। (আলে-ইমরান ৯০৩) পবিত্র মুসলিম শরিফে হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর বান্দা বনে ভাই ভাই হয়ে থাক। (হাদিস নং ২৫৫৯) পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের ঐক্য যেন এমন সুদৃঢ় হয় যাতে তোমরা হয়ে যেতে পার ইস্পাত কঠিন প্রাচীর। সূরা সফ ৩। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হবে সততা, সত্যবাদিতা, জবাবদিহিতা, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা পরস্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। অপরকে ভোগের সুযোগ দিয়ে নিজে না খেয়ে না পেয়ে সুখানুভূতি অনুভব করা। অপরের অধিকার কেড়ে না নিয়ে বরং নিজের প্রাপ্যকে অন্যের কল্যাণে ব্যয় করা। এ সব ভিত্তিতে যেখানে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে মৃত্যু সায়াহ্নে নিজে পিপাসায় ছটফটকারী কাতর মানুষটা অন্যের জন্য পানপাত্র এগিয়ে দিয়ে এক বুক পিপাসা নিয়ে মরণকে বরণ করেছিল। ক্ষুধার্ত মানুষ, সপ্তাভর চুলো জ্বালাতে অক্ষম পরিবার একটা বকরি মস্তক লাভ করার পর অন্য পরিবারকে আরও ক্ষুধার্ত মনে করে তারা উপোস অভুক্ত ওয়াক্ত পার করে আনন্দিত হয়েছিল। মেহমান আপ্যায়নের সময় খাবার স্বল্পতার কারণে নিজেরা অভুক্ত রাত কাটানোর প্রতিজ্ঞায় দস্তরখানে প্রদীপ নিভিয়ে মিছেমিছে খাওয়ার ভান করেছিল। সেই তাদের এই কর্মে মহান আল্লাহ আহ্লাদিত হয়ে তাদের প্রশংসায় পবিত্র কোরআনে আয়াত নাজিল করেন।

তারা নিজের ওপর অন্যকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে যদিও তাদের রয়েছে প্রচুর ক্ষুধা, বিস্তর সমস্যা। সূরা হাশর-৯

এই ঐক্যের শক্তিতে তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা সমস্ত ভয়কে জয় করেছিলেন। তারা জাতিতে জাতিতে, জনপদে জনপদে ঐক্যতান সৃজন করেছিলেন। মরু-সাহারা, সাগর মহাসাগর, পাহাড় পর্বত একই সুরের গুঞ্জন তুলেছিল। একই স্লোগানে মুখরিত করেছিলেন। যেখান থেকে একদিন দীনের নবী (সা.) হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেখানেই পুনরায় বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। ঐক্যের সঙ্গে বিজয়ের সম্পর্ক বা বিজয়ের সঙ্গে ঐক্যের সম্পর্ক একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাত্ যেখানে ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে বিজয় পতাকা পতপত করে উড়তে সক্ষম হয়, আবার যারা বিজয় অর্জনে সক্ষম হয় তাদের মূলে রয়েছে ঐক্যের শক্তি। ঐক্যের শক্তিকে বলীয়ান বিজয়কে মহান আল্লাহ শুধু বিজয় আখ্যা দিয়ে ক্ষান্ত হননি বরং এটাকে মহাবিজয় বা প্রকাশ্য বিজয় বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, আমি আপনাকে বিজয় প্রদান করেছি মহাবিজয়। (সূরা ফাতাহ-১)

উল্লেখ্য, এই আয়াত মক্কা বিজয় সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়নি। এটা অবতীর্ণ হয়েছিল হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়। ইতিহাস সাক্ষী হুদায়বিয়াতে পরমত সহিষ্ণুতার যে উদাহরণ প্রিয় নবী (সা.) উপহার দিয়েছিলেন আর তার সাহাবিগণ যে জযবা ত্যাগের উপমা রেখেছিলেন এবং খোশ দিলে ও বেজার মনে উভয় অবস্থায় প্রিয় নবী (সা.)-এর নেতৃত্বের প্রতি যে অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার মাঝেই মহাবিজয় নিহিত ছিল। এবং প্রকাশ্য বিজয় সুপ্ত ছিল। যা স্বয়ং আল্লাহ জুলজালাল বিলক্ষণ অবলোকন করে মক্কা বিজয়ের দুই বছর আগেই এই সূরা ফাতাহ বা বিজয় সূরা অবতীর্ণ করে সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আবার মক্কা বিজয়ের পর ফাতাহ বা বিজয় শব্দ সংবলিত সূরা নাছর অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ করেন, যখন আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় এসে পৌঁছেছে। এবং আপনি দেখছেন যে লোকেরা দলে দলে সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর দীনের ছায়াতলে প্রবেশ করছে। অতএব, আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসায় গুণগান করুন এবং বিনয়ের সঙ্গে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। (সূরা নাছর-১, ২, ৩)।

সর্বশেষ খবর