রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঐশীই পারে আলোর পথের সন্ধান দিতে!

সাব্বির খান

একজন ঐশী তার অপরাধ স্বীকার করেছেন। তার জন্মদাতা পিতামাতাকে একই সঙ্গে, একই রাতে তিনি খুন করেছেন। হত্যার দায় স্বীকার এবং সুস্থ মস্তিষ্কে হত্যার প্রমাণসাপেক্ষে কিশোরী ঐশীকে আইনের পঞ্চপাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিতে আদালতের কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন একজন অবধারিত মৃত্যুপথযাত্রী কিশোরীর জন্য একটি জাতির অনুুকম্পা যে আজ দ্বিধাবিভক্ত, তা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান! যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত, তারা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন, খবরের পেছনে যে খবর, সেটাই হচ্ছে মূল খবর। পেছনের বা গভীরের খবরই যদি হয় মূল খবরের উৎসস্থল এবং তা যেমন সর্বক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না, তেমনি সংঘটিত অপরাধের কথা শোনা গেলেও, অপরাধের উৎসস্থল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিমিরেই থেকে যায়। আইনের ভাষায় এটাকে ‘দায়মুক্তি’র সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। উচ্চ আদালতে রায়ের বিপরীতে আপিল করেছেন ঐশী। সেখানে ঐশীর সাজা কমবে অথবা বহাল থাকবে। আমরা জানি, মামলায় পক্ষ হয় দুটি, ‘বাদী এবং বিবাদী’। অথচ মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিষয় দুটি নিয়ে আদালতে অভিন্ন সুরে শুনানি হয়, তা হলো ‘অপরাধ’ ও ‘অপরাধী’। আর অবাক করে দিয়ে আদালত সর্বোতই অনেকটা শুধু অপরাধীকেই সাজা দিয়ে থাকেন, ‘অপরাধ’কে নয়। সামাজিক ও মানবিক অনুশীলনের ক্ষেত্রেও এ প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে ‘নিয়মের হাত ধরে সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে, যার প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় জাতির সর্বজনীন অভ্যস্ততায়, আর মননশীলতায়। এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশে সামাজিক অপরাধগুলো অব্যাহত থাকে দাঁড়ি-কমাহীনভাবে, যুগ যুগ ধরে। ব্যতিক্রম হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, অপরাধীকে সাজা দেওয়ার পাশাপাশি অপরাধ ঘটানোর মূল উত্পত্তিস্থল ও নাটেরগুরু জামায়াতে ইসলামীর কথা প্রতিটা রায়েই ‘পর্যবেক্ষণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইতিবাচক এবং নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। ট্রাইব্যুনালের রায়গুলোকে আমলে নিলে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ‘শুধু অপরাধী নয়, সংঘটিত অপরাধের উত্পত্তিস্থল ও তার  পেছনের যে ‘খলনায়ক’, তাকেও চিহ্নিত করার সদিচ্ছা আদালত দেখিয়েছেন। এ পর্যবেক্ষণের কারণেই যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতে ইসলামীর বিচারের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং জামায়াত নিষিদ্ধের যৌক্তিক দাবিটিও আলোর মুখ দেখেছে। আইন মেনে চলার শর্তে কোনো শিশু জন্ম নেয় না। কঠিন শাস্তির ভীতিসঞ্চার করে অপরাধ থেকে তাকে দূরে রাখতে মনের সরল বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ঐশীর মামলা এবং এর চুলচেরা আইনি বিশ্লেষণ দেওয়ার এখতিয়ার বা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। তবে বাংলাদেশের আবহমান পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ে উৎপাদিত একটি ‘মডেল কেস’ হিসেবে মামলাটির ব্যাপারে আলোচনা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ফৌজদারি আইনে আরও ১০টি হত্যা মামলার মতো ঐশীর মামলাটিও শুরু থেকে শেষ হতে দেখেছি। পাশাপাশি বিশেষ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার রায়ও আমরা দেখেছি। এ ছাড়াও শত শত ফাঁসির রায় দেখেছি, যেখানে অপরাধ ও অপরাধীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শুধু ভয়াবহই নয়, একই সঙ্গে অমার্জনীয়। জাতির পিতার হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমান, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি দেখেছি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি দেখেছি। ১১ জন তরুণীকে ধর্ষণের পর খুন করা শতাব্দীর ঘৃণ্যতম খুনি রসু খাঁর ফাঁসি দেখেছি। অথচ এসব দাগি, কুখ্যাত, ঘৃণ্য, পেশাদার খুনিদের পাশে ঐশীর নামটি ‘খুনি’ হিসেবে লিখতে বিবেকে বাধে। আদালতের রায়ে ঐশী নির্দোষ না হলেও তার খুনি হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো, তা আমরা জানতে পারিনি। পেশাদার খুনিদের মতো একই মঞ্চে, একই দড়িতে হয়তো অচিরেই ঐশীর ফাঁসি হবে। প্রতিষ্ঠা পাবে আইনের শাসন। তবে বিবেক যদি জানতে চায়, ‘সুশাসন ও সুন্দর জীবন’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সোনার বাংলার স্বপ্ন আমরা সেই একাত্তর থেকে দেখেছি, তার কী হবে? ঐশীর ফাঁসি কি প্রজন্মকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারবে?

ঐশী-মামলায় আইনের অনুশীলন হয়েছে; বিবেকের নয়! আইনের চোখে ঐশী মোটা দাগের একজন খুনি হলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে প্রাণ পেল ‘গভীরের অপরাধীরা’, যাদের রুখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রের অবকাঠামোগুলো। ঐশী উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। সেখানে কী হবে তা আগাম বলা অসম্ভব। আমাদের বিশ্বাস করা উচিত, যদি তার ফাঁসির রায় বহাল থাকে তাহলে তার মৃত্যু আমাদের পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য আলাদা কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। পক্ষান্তরে সে রায় হবে সবার ‘দায়মুক্তির রায়’। আমাদের বিশ্বাস করা উচিত, আজ জীবদ্দশায় ‘মৃত যে ঐশী’ কারাগারে আছেন, সরকার তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জন্য তিনি অবশ্যই একটি মূল্যবান সম্পদ। প্রজন্মের প্রতিনিধি মৃৃদুভাষী জীবন্ত ঐশীর মাঝে লুকিয়ে আছে বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়, অন্যায়, অসুন্দর আর অপরাধ জগতের বিবিধ প্রশ্নের অজানা উত্তরগুলো। ভবিষ্যতে সতর্ক হওয়ার জন্য উত্তরগুলো সমাজবিজ্ঞানী, সরকার এবং আমাদের পরিবারগুলোর জানা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের শুধরাতে হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পরিবারের তৃণমূল পর্যন্ত। কোনো পরিবারই ‘ঐশীদের’ হারাতে চায় না। অন্ধকারের চোরাগলিগুলো চিনে নিতে আগামীর ঐশীদের সুযোগ দেওয়া উচিত। ফাঁসির আসামি ঐশী আমাদের সে কাজে সহযোগিতা করতে পারেন। ঐশীই পারেন প্রজন্মকে আলোর পথের সন্ধান দিতে! চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নে মরণোত্তর দেহদান যেমন একটি ‘মানবিক’ সিদ্ধান্ত, তেমনি রাষ্ট্রের কাছে বিনীত প্রার্থনা— ‘এ দেশের কোটি কোটি তারুণ্যকে রক্ষার লক্ষ্যে একজন জীবিত ঐশীকে দান করা হোক সমাজ গবেষকদের হাতে। মানবিকতার প্রশ্নেই শুধু নয়; মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকড় উন্মোচনে গবেষণার স্বার্থে ঐশীকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। যে অবক্ষয় ঐশীর মতো হাজার হাজার তারুণ্যকে অপরাধ ও অন্ধকার জীবনে উৎসাহিত করছে, তার কারণ ও ধরনগুলো আমাদের জানা দরকার, যা ঐশীর সহযোগিতায় মনো ও সমাজবিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করতে পারেন। ভুলের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয়গুলো স্থির করার সুযোগ পাওয়া সভ্য সমাজের অধিকার। একজন ঐশীকে ফাঁসির মাধ্যমে রাষ্ট্র, সমাজ তথা পরিবারের দায়মুক্তি দেওয়ার যে সংস্কৃতি তা পরিহার করা উচিত। সোনার বাংলাদেশ গড়ার মূলমন্ত্র হোক আমাদের সততায়-সভ্যতায়; অনৈতিক অবক্ষয়ে নয়!

লেখক : সাংবাদিক।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর