বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দ্বিধাহীন চিত্তের সেই দেশপ্রেমিক আবদুর রাজ্জাক

বাহালুল মজনুন চুন্নু

দ্বিধাহীন চিত্তের সেই দেশপ্রেমিক আবদুর রাজ্জাক

ইতিহাসের খেরো খাতায় জ্বল জ্বল করছে আবদুর রাজ্জাকের নাম। তিনি বিদ্রোহী, তিনি বিপ্লবী। তিনি দেশমাতার সেই সূর্য সন্তান, যিনি নিজ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞানে দেশের স্বাধীনতার জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নির্দ্বিধায়। দেশের তরে নিরলস সংগ্রামের এক মূর্ত প্রতীক তিনি। তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত।  আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত এমনই একজন লড়াকু সৈনিক যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে দেশের আপামর জনসাধারণের দুঃখ কষ্ট লাঘবে কাজ করে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এমনকি ব্যক্তি জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে কখনোই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত্ হননি। তাই তাকে বঙ্গবন্ধুর নির্ভেজাল আদর্শিক কর্মী বলা হয়। এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্লোভ, সত্, ত্যাগী, সাহসী, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী এবং সফল রাজনীতিবিদদের নামের উচ্চারণকালে ভেসে ওঠে তার নাম।

মনে পড়ে সেই ১৯৬৮ সালের কথা। ওই বছরই প্রথম তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র ছিলাম। ফরিদপুরের কোর্ট-কাচারি এলাকায় তার সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছিল। ঢোলা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরিহিত সেই সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা আবদুর রাজ্জাককে দেখে মনে হয়েছিল যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ত। সারা জীবন তাকে সেই সন্তরূপেই দেখে এসেছি। ওই দিন তিনি আমাকে যেভাবে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তাতে আমি বিস্মিতই কেবল হইনি, অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম তার কর্মী হয়ে দেশের তরে কাজ করার। যে কোনো কর্মীর জন্যই এ ভালোবাসা অনুপ্রেরণার। কখনো শিশুর মতো, কখনো পিতার মতো, কখনো ভ্রাতা, কখনো বা বন্ধুর মতো তিনি ছিলেন আমাদের সঙ্গে আমাদের অনুপ্রেরণা দাতা হয়ে।

সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি আজীবন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্ন আমাদের মাঝে সঞ্চারিত করেছেন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। তার দেশপ্রেমের চেতনার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলাম তারই ভালোবাসা আর প্রেরণায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি আমাদের ডেকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও এ দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হবে। তার সেই ‘বলা’ আমাদের উজ্জীবিত করেছিল যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। তার সফলতা তিনি নিজেই কেবল দেশপ্রেমিক ছিলেন না, তার কর্মীদের মাঝেও সঞ্চারিত করেছিলেন দেশপ্রেম।

কোনো একক বিশেষণে তাকে ভূষিত করা যায় না। দেশপ্রেমে, পরিশ্রমে, রুচিবোধে, সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায়, সৌজন্যে এবং উদারতায় আবদুর রাজ্জাক এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পরিশ্রম এবং আত্মত্যাগের ব্রত ছিল জীবনভর। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের সুখ-দুঃখ, কল্যাণ এবং মঙ্গলে থেকেছেন পাশে পাশে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, সাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভেবে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, সামরিক জান্তা শাসনের বিরুদ্ধে একাগ্রচিত্তে লড়াই করেছেন। আবদুর রাজ্জাকের পুরো জীবনটাই কেটেছে সংগ্রাম-আন্দোলনে, কারাগারে, স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং দেশ গড়ার মহান ব্রতে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। তাই তো বঙ্গবন্ধু একবার এক বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, অনফঁত্ জধুুধশ রং সু ড়িত্শবত্. ঐব রং ড়িত্শরহম ষরশব ফবারষ. এখানে বঙ্গবন্ধু আবদুর রাজ্জাকের নিরলস শ্রমকে ইঙ্গিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহছায়ায় যে কয়জন কীর্তিমান স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে আমৃত্যু নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবদুর রাজ্জাক তাদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ছিলেন শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্ন পূরণে ছিলেন শীর্ষযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু তাকে এতই বিশ্বাস করতেন যে, বাকশাল গঠনের পর সংগঠনের তিন সেক্রেটারির অন্যতম সেক্রেটারি করেছিলেন আবদুর রাজ্জাককে। আজীবন আবদুর রাজ্জাক সেই বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন সব লোভ-লালসাকে তুচ্ছ করে। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লড়াকু সৈনিক, একজন একনিষ্ঠ শিষ্য। নিজেও সর্বদা বলতেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর একজন শিষ্য, এটাই আমার একমাত্র পরিচয়।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তিন-চারজন সংগঠকের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক অন্যতম। শুধু স্বাধীনতা-উত্তর কিংবা মুক্তিযুদ্ধকালীনই নয়, তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও ছিলেন একজন সফল সংগঠক। যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন দেশে পথচলা শুরু করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে শপথ নিয়েছিলেন, সেই পথে তিনি সংগঠিত করেছিলেন সাংগঠনিকভাবে দলকে। দীর্ঘ কয়েক যুগে যারা আওয়ামী লীগের কর্মী তাদের অধিকাংশই আবদুর রাজ্জাকের হাত ধরে এসেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তিনি আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে নিরলস কাজ করে গেছেন। ১৫ আগস্ট পরবর্তী টানা ২৭ মাস তাকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কারাগারে থেকেই তিনি দল চালাতেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী যে দুঃসময় গেছে, যে দুর্যোগ ঘটেছে জাতীয় জীবনে, সে সময় রাজপথের প্রতিবাদী মিছিলের বাইরে ছাত্রদের সংগঠিত করতে হয়েছে। কারাগার থেকে তিনিই তা পরিচালনা করতেন। পঁচাত্তর পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা, নানা প্রলোভন দেখিয়েও তাদের অনুগত করতে পারেনি। শত নিপীড়নেও তিনি কাবু হননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে অন্য অনেকে হাত মেলালেও তিনি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। আমৃত্যু তাকে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নিবেদিত এক প্রাণ হিসেবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলতে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দেশে-বিদেশে অনেক চক্রান্ত হয়েছিল। এখনো হচ্ছে। এই যেমন দিন দুয়েক আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শহীদদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এটা এমন একটা সময়ে তিনি এ মন্তব্য করেছেন, যখন আমরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার কথা ভাবছি। তার এ মন্তব্য যে পাকিস্তানিদের খুশি করার জন্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। মাতা-পুত্র যে পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী এগুলোই তার প্রমাণ। এ জন্য তারা নানা সময়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করে আসছেন। এসব দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আবদুর রাজ্জাক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য মাঠ, রাজপথ দখল করে রেখেছিলেন আবদুর রাজ্জাক। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। নব্বই দশকের শুরুতে শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য আবদুর রাজ্জাক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। তার অনেক আকাঙ্ক্ষা ছিল, তিনি এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাবেন। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। ইতিমধ্যে সেই সময়কার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত গোলাম আযম জেলখানাতেই মারা গেছে। সাঈদীকে আজীবন থাকতে হবে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সামনে নিজামীর রায়। এ ছাড়া অন্যসব রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচার চলছে। তিনি তা দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন আজ এদেশে হচ্ছে। এদেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ক্রমশ উচ্ছেদ ঘটছে। তরুণ প্রজন্ম আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে বলীয়ান যা আবদুর রাজ্জাক সবসময়ই কামনা করতেন।

পরশ্রীকাতরতা, প্রতিহিংসা, দ্বেষ-বিদ্বেষ ইত্যাকার কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি দৃঢ়চেতা আবদুর রাজ্জাককে। মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন, আবদুর রাজ্জাক তা বাস্তবায়নে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার রাজনীতিক হিসেবে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন সাম্প্রদায়িকতাকে। তাকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের অন্যতম পুরোধা বলা যায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তার কাছে সবাই ছিল সমান। এমনকি যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ব্যতীত অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিও তিনি ছিলেন উদার। এ কারণে দেখি যারা তার প্রতিপক্ষ, তার সঙ্গে যাদের মতের মিল হয়নি, তারাও তার উদারতার জন্য প্রশংসা করতেন। নানা মত ও পথের অধিকারীরাও সশ্রদ্ধ চিত্তে তাকে সম্মান জানাতেন। তিনি কখনোই বিরোধী পক্ষের ওপর কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন না। আবার আদর্শিক ব্যাপারে কারও সঙ্গে আপসও করতেন না। সৌম্য-শান্ত মুখে, মার্জিত ভাষায় এবং সৌজন্যবোধের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি যা আমাদের আজকের যুগের রাজনীতিবিদদের জন্য অনুকরণীয়।

মানব জীবনের পরমতম পাওয়া হলো লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠা। খুব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব লোভকে অতিক্রান্ত করা, সততার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করা। আবদুর রাজ্জাক পেরেছিলেন। ’৭৫-পরবর্তী সরকার তাকে অনেক প্রলোভন দেখালেও তিনি লোভের ফাঁদে পড়েননি। মন্ত্রী হয়ে যখন অনেকে বাড়ি গাড়ি, টাকার পাহাড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকেন, তিনি তখন ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। মন্ত্রী থাকাকালীন যারাই তদবিরে যেতেন, তিনি তাদের বলতেন, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কিছুই করা যাবে না। মন্ত্রী হয়েও নির্লোভ থাকায় চিকিত্সাকালীন আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি।

ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক। ১৯৬২ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্রসংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। তার আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সহ-সম্পাদক ছিলেন। শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে তার বিরুদ্ধে জারি হয়েছিল হুলিয়া। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালের একাংশ পর্যন্ত ছিলেন জেলে। ১৯৬৩ হতে ৬৫ পর্যন্ত ছিলেন ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে সারা দেশে জনপ্রিয় করতে সীমাহীন পরিশ্রম করেছিলেন। এ জন্য তাকে কারাগারেও যেতে হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুসহ আবদুর রাজ্জাককে মুক্ত করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। অসম্ভব মেধাবী ও নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় এ নেতা দুবার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যমত এ সংগঠক বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রয়েছে তার। ওই সময় গঠিত মুজিব বাহিনীর একজন সংগঠক ও রূপকারও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারের (মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের একজন) দায়িত্ব পালন করেছেন। দেরাদুনে ভারতের সেনাবাহিনীর জেনারেল উবানের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া এ বীর যোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষকও ছিলেন। তার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব আবদুর রাজ্জাক অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন অর্থাত্ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করার ডাক দেন, তখন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আবদুর রাজ্জাক সারা দেশে বাকশালকে সংগঠিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

তিনি ছিলেন নেতৃত্বের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল একজন ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি যেমন দেশের জন্য কাজ করে গেছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে দেশের তরে কাজ করে গেছেন।

১৯৪২ সালের ১ আগস্ট শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার দক্ষিণ ডামুড্যা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আবদুর রাজ্জাক সব সময় শরীয়তপুরবাসীর কল্যাণে কাজ করে গেছেন। শরীয়তপুর ছিল অনগ্রসর একটি জেলা। সেই জেলা আজ অনেক অগ্রসর, অনেক উন্নত। আর তা হয়েছে আবদুর রাজ্জাকের কারণেই। তবে তিনি শরীয়তপুরের গণ্ডির মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। জাতীয় নেতা হিসেবে সারা দেশের মানুষের জন্যই কাজ করে গেছেন। দেশের জন্য, সংগঠনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে করতে একটা সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আবদুর রাজ্জাক। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন তিনি। লন্ডনের একটি নয়, দুটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন কয়েক মাস। চিকিত্সায় অর্থাভাব দেখা দিলে তার বন্ধুরা মিলে তার সংস্থান করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতাল থেকে তার সঙ্গে আমার প্রায়শই টেলিফোনে আলাপ হতো। দেশ, জাতি, রাজনীতি নিয়ে তার ভাবনার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, ‘চুন্নু আমি আরও কিছু দিন বাঁচতে চাই। আমার দেশের মানুষের জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে।’ কিন্তু তার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না। যেদিন তিনি জানতে পারলেন, অপারেশন করার মতো শারীরিক অবস্থাও তার নেই, সেদিন তিনি পুরো ভেঙে পড়েছিলেন। লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। যখন চিকিত্সকরা বুঝলেন, জীবন রক্ষার আর কোনো উপায় নেই তখন শরীর থেকে খুলে নেওয়া হলো লাইফ সাপোর্ট।

সেই দিনটি ছিল শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর। ঢাকায় খবর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে পড়ি শোকে। কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছিল। বটবৃক্ষের মতো স্নেহ, ছায়া, মমতা এবং জীবন চলার দিকনির্দেশনাদাতা আর নেই, এমনটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল। আজ রাজ্জাক ভাই নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তার আদর্শ।  মৃত্যু তাকে নিয়ে গেছে, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের চেতনায় বলীয়ান হওয়ার শক্তি।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। 

সর্বশেষ খবর