বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ধর্মীয় স্থাপনা

দক্ষিণ সিয়াটলের মদিনা মসজিদ

ফেরদৌস জাহান

দক্ষিণ সিয়াটল। এখানকার মসজিদগুলোতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। প্রথম প্রথম আমার অবাক লাগত।  এত মুসলমান। প্রশান্তিতে মন আমার ভরে যেত। একমাত্র ধর্মের সুশীতল ছায়ায় মানুষের শান্তি। সে শান্তি খোঁজে এখানেও মানুষ।

শুক্রবার মসজিদে নামাজ পড়ছি। শান্ত, শিল্পী, মনির ও আমি। মেয়েদের নামাজের জায়গা আলাদা। রুমের ভিতর ভারী পর্দা। কোনায় কোনায় সযত্নে রক্ষিত কোরআন শরিফ, তসবিহ। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ। এক পাশে লাউড স্পিকার। পুরো নামাজ, দোয়া দরুদ ইমাম সাহেবের কণ্ঠ উচ্চারিত প্রতিটি কক্ষে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান নারী-পুরুষ প্রায় সবাই এখানে নামাজ পড়তে আসে। আমার পাশেই নামাজ পড়ছিলেন এক মহিলা। বয়স্ক। কিন্তু বোঝা যায় না। গায়ের রং কালো। সাউথ আফ্রিকার মনে হলো। নামাজ শেষে তিনি আমাকে কিছু বললেন। আমি বুঝতে পারলাম না কি বলছেন। তবে তার মুখে আমি ‘কালেমা’ শুনতে পেলাম। তসবিহ হাতে তিনি বারবার সিজদা দিচ্ছেন ইশারায় আমাকেও দিতে বলছেন। আমিও বসে বসে দোয়া দরুদ পড়ছি।

আমার অন্য পাশে নামাজ পড়ছিল অল্প বয়সের এক মেয়ে। হালকা, ফর্সা, কাটা কাটা চেহারার মিষ্টি মেয়ে। ইন্ডিয়ান। ও আমাকে বলল তুমি তো ওর (আফ্রিকান মহিলা) কথা বুঝতে পারছ না। তো ওর কথা শুনছ কেন? কেমন একটা বিরক্তির ভাব মেয়েটির চোখে মুখে। আমি হেসে মেয়েটিকে বললাম, পৃথিবীর যে যেখানেই অবস্থান করি না কেন, যে ভাষায় কথা বলি না কেন ধর্মীয় বন্ধনে আমরা সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি। ভ্রাতৃত্ববোধ সহমর্মিতা ও আন্তরিকতায় আমরা একে অপরের পরিচিত। তাই ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে ওই আফ্রিকান মহিলা আর আমি বাঙালি এক হয়ে গেছি। এতেই আমার আনন্দ। এতেই আমার শান্তি।

ইসলাম সারা জাহানের মুসলমানদের একমাত্র বিশ্বজনীন ধর্ম, ইহ-পরকালের সর্বপ্রকার শান্তি ও কল্যাণের মূল চাবিকাঠি। দুনিয়ার সব মুসলমানকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করা ইসলামের উদ্দেশ্য।

সেদিনও ছিল শুক্রবার। মসজিদে নামাজ শেষে দোয়া দরুদ পড়ছি। মিষ্টি সুরে কে যেন বলল, আসসালামু আলাইকুম। ওয়ালাইকুম সালাম বলে তাকালাম। সুশ্রী দীর্ঘ তনু, ডাগর চোখ মায়াভরা এক মেয়ে। সাদা এপ্রোনে সারা শরীর ঢাকা। মাথায় ওড়না এমনভাবে বাঁধা মুখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এক কোনায় বসে নামাজ পড়ে চলে গেল। মেয়েটিকে কেন যেন আপন কেউ মনে হলো। এই আমেরিকায় থ্যাংকু-উ, হাই ছাড়া আর সবই তো বেমানান। আমাদের দেশের মতো ধর্মের অনুশাসন, দেশের কালচার এখানে নেই। মেয়েটা ভাবিয়ে তুলল আমাকে।

সেদিন ফিরছি ঝধভব ধুি থেকে। কিছু কেনাকাটা করে গাড়িতে উঠতেই পাশের গাড়ির ভিতর থেকে কে যেন বলল আসসালামু আলাইকুম। তাকিয়ে দেখি মসজিদের সেই মেয়েটি। ওরাও এসেছিল শপিংয়ে। মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করার তাগিদ অনুভব করে শিল্পীকে বললাম। পরের শুক্রবার কথা হলো। একদিন পরিচয় হয়ে গেল। মসজিদেই। নামাজ শেষে ওর সঙ্গে অনেক কথা বললাম। অনেক পরিচয়ের মাঝে এটাও আমার সঞ্চয়।

আমেরিকার আদি বাসিন্দা ওরা। ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। আশ্চর্যের কথা নিজ ধর্মের প্রতি ওদের কোনো আস্থা বা আকর্ষণ কোনোটাই ছিল না। ছিল না কোনো অনুরাগ। ‘কোরআন শরিফের’ ইংরেজি অনুবাদ ওদের প্রথম আকৃষ্ট করেছিল। ইসলাম ধর্মের ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতায় মুগ্ধ হয়ে শবেবরাত, কদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা অনুষ্ঠানে প্রায়ই অংশগ্রহণ করত। এভাবে ইসলাম ধর্মের গভীরতায় আকৃষ্ট হয়েই নিজ ধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর একদিন ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এখন ওরা মুসলমান। মনে-প্রাণে একত্বে বিশ্বাসী। ওদের সন্তান-সন্ততি সবাই মুসলমান। ধর্মান্তরিত হওয়ায় ওরা স্বজনহারা গোত্রহারা।

বেশ আছে মেয়েটি স্বামী সন্তান আর ধর্ম নিয়ে। নামাজ-রোজা, দান-খয়রাতের ভিতর ওরা পেয়েছে স্রষ্টার নৈকট্য। এদের জীবনে এসেছে শান্তি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। সুষ্ঠু জীবন বিধান। এর আকর্ষণ সর্বত্যাগী।

মেয়েটির নাম জেসমিন আজরা রুশনি। একটি বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, সহূদয় ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি সুপরিচিত। এসবির ও তৌহিদ দুই ছেলের সুন্দর সংসার। বিত্তশালী এলাকা দক্ষিণ সিয়াটলে সমৃদ্ধ শহর মদিনায় ওরা থাকে। মদিনা নামকরণের সুন্দর তথ্যটুকুও ওর কাছ থেকেই পেয়েছি। ছোট ছোট কয়েকটি শহর নিয়ে বেধঃবৎ সিয়াটল। এই সিয়াটল শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে সবচেয়ে সম্পদশালী সুন্দর শহরটিই, মদিনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে রূপবতী শহর এ মদিনাতেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনাঢ্য বিল গেটসের বাড়ি। অনেক অনেক দিন আগে।

আমেরিকার একজন বর্ষীয়ান মহিলা চাকরিরত ছিলেন সৌদি আরবে। প্রতি বছর হজব্রত অনুষ্ঠানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সমাবেশ ঘটে। ধনাঢ্য এ মহিলা প্রায় সময় অংশগ্রহণ করতেন এবং সহস্র কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমের অন্তরের আলোক ধারায় তিনি অভিভূত হয়ে পড়তেন।  নিজ দেশে ফিরে তিনি তাদের এলাকাটির নামকরণ ‘মদিনা’ রাখার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এলাকার বিত্তশালী প্রভাবশালী মহলে। তার এ আবেদন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সানন্দে গ্রহণ করে এলাকাবাসী অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ লেফ ওয়াশিংটনের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা মনোরম স্থানটির নামকরণ করেন ‘মদিনা’।

     লেখক :  যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

সর্বশেষ খবর