সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

আসমা কিবরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা

ওয়ালিউর রহমান

আসমা কিবরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা

আসমা কিবরিয়ার আকস্মিক মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই ছিল তীব্র কষ্টের। যদিও তিনি সুস্থ ছিলেন না কিন্তু তার উদ্যম ছিল অসাধারণ। কখনোই আশা ছাড়েননি তিনি। কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও তাকে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

কিছুদিন আগেই গোটা জাতি সিলেটে চলমান বিচার কার্যক্রমের পর্যবেক্ষক ছিল— শাহ এএমএস কিবরিয়ার অভিযুক্তদের খুনের বিচার। আসমা কিবরিয়া জানতেন কীভাবে ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধ ছিল তার স্বামী শাহ এএমএস কিবরিয়া, বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও এসকাপের সিইও হত্যার ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য একটি যুদ্ধ। আসমা কিবরিয়া এই যুদ্ধ করেছেন দৃঢ়তা এবং সংকল্পের সঙ্গে। তিনি হাল ছেড়ে দেননি। তিনি কখনোই ভুলে যাননি শাহ এএমএস কিবরিয়ার ওপর ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারির কাপুরুষোচিত হামলার স্মৃতি। যার পিছনে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির নির্দেশনায় মুফতি হান্নানের সন্ত্রাসী দল আর হাওয়া ভবন।

আসমা কিবরিয়া, বিচারের দাবিতে দেশে ও বিদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মানববন্ধনের আয়োজন করেন। হাজার হাজার মানুষ ৩এ ধানমন্ডির সামনে তার সঙ্গে একাত্মতা জানাতে জড়ো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ অফিসও সেখান থেকে বেশি দূরে ছিল না। আসমা ছিলেন একজন শিল্পী, তিনি ন্যায়বিচারের জন্য করা সেই মানববন্ধনের একটি কাব্যিক নাম দিয়েছিলেন ‘শান্তির জন্য নীলিমা’। ধানমন্ডি লেকের টলটলে পানির পাশে তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে বিচারের জন্য হাজারো মানুষের আকুতি সেদিন অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল।

সেই সময় মাসের পর মাস চলা সেই মানববন্ধন ছিল একপ্রকার যুদ্ধ, কারণ তা ছিল মূলত আসমার গভীর অঙ্গীকারের প্রতিনিধিত্বকারী। তিনি দেখা করেছিলেন তত্কালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে। তিনি সমর্থন করেন এই কার্যক্রম এবং আশ্বস্ত করেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপরাধীদের বিচার হবে। মানববন্ধনে আমি মাঝে মাঝে কিছু বিদেশির যোগদানও লক্ষ্য করেছি। এমনকি আমার পোলিশ ভাবি মার্গারেট আমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে এসে আসমা কিবরিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তিনি শুধু একজন চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একজন ভালো গায়িকা। রবীন্দ্র সংগীত ছিল তার প্রিয়। তার প্রোগ্রামে অন্যান্য দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চ্যান্সারিপ্রধান হিসেবে আমার প্রায়ই যাওয়া হতো। দূতাবাসের অন্য মহিলারাও আসমা কিবরিয়ার সঙ্গে যোগ দিতেন। সেসব সন্ধ্যা প্রায়ই মধ্যরাত পর্যন্ত স্থায়ী হতো। আসমা কিবরিয়া ছিলেন একজন স্ত্রী, একজন মা এবং অসাধারণ অতিথিপরায়ণ। আমি এসব গুণাবলি একসঙ্গে একজনের মাঝে খুব কমই দেখেছি। আসমা কিবরিয়া খুব কমই শাহ্ কিবরিয়ার সঙ্গে বিতর্কে জড়িত হতেন। তাদের বিতর্ক ছিল খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। কোনো প্রকার উত্তেজক কথা হতো না। এটা আমাকে প্রায়ই জেন অস্টেনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের ডারসি এবং এলিজাবেথের মধ্যকার মজার ও বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিত। আসমা কিবরিয়ার বেকারি রান্না ছিল চমত্কার। তার বড় রান্নাঘর ও ডাইনিং রুমের আড়ালে ছোট একটি রান্নাঘর ছিল। আসমা সেখানে সুস্বাদু সব বেকারি আইটেম তৈরি করতেন। পরিবারের জন্য রান্না করা সেসব খাবারে মাঝে মাঝে আমাদেরও বিশেষ আমন্ত্রণ থাকত।

তার বাসায়, মাসে অন্তত তিনবার কূটনৈতিক মধ্যাহ্ন এবং নৈশভোজের আয়োজন করা হতো, পররাষ্ট্র সচিব আজিজ আহমেদ যেমন আমাকে নিজ হাতে কূটনৈতিক নোট লেখা শেখান তেমনি আসমা কিবরিয়া ও শাহ্ কিবরিয়া আমাকে কূটনীতির শিষ্টাচার অতি সূক্ষ্মভাবে শেখান।

আসমা কিবরিয়া সব সময় প্রাণোচ্ছল থাকতেন। খুব কমই তাকে চুপচাপ দেখা যেত। একবারই আমি তাকে গভীরভাবে চিন্তিত হতে দেখেছি। তার একটি অপারেশনের জন্য কিবরিয়া তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার আগে তারা উভয়ে তাদের বাসভবনে আমাদের যেতে বলেন এবং অনুরোধ করেন তাদের দুই সন্তান রেজা ও নাজলিকে দেখাশোনা করার জন্য। অবশ্যই আমাদের কোনো দ্বিধা ছিল না এবং আমরা আশ্বাস দিই আসমা ভাবীকে বাচ্চাদের দেখাশোনার কোনো ত্রুটি হবে না। রেজা ও নাজলি দুজনই ছিল খুবই ভদ্র। আমার খুবই ভালো লাগে যে তারা এখন সেই আগের মতোই আছে। তাদের একসঙ্গে দেখলে আমার চোখে রূপকথার ছোট সুন্দর পরিবারের ছবি ভেসে ওঠে। একজন নারী হিসেবে, একজন স্ত্রী হিসেবে এবং একজন মা হিসেবে আসমা কিবরিয়ার কোনো তুলনা ছিল না।

রাজনৈতিক সমাবেশে শাহ্ কিবরিয়ার জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর, আসমা কিবরিয়াকে যতটুকু সম্ভব সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমর্থন করেছেন। আসমা কিবরিয়া প্রায় একক প্রচেষ্টায় ট্রায়াল শুরু করিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় যে, ট্রায়ালটির শেষ দেখে যেতে পারলেন না।

আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের এবং জেলে নিহত চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে চেষ্টা করছি। আমরা এখন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অপরাধের বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনকারীদেরও আইনের শাসনে আনছি এবং আশা রাখি আমরা শাহ্ কিবরিয়ার হত্যাকারীদের বিচারও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। আসমা কিবরিয়ার স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। বর্তমানে ‘বাংলাদেশ  হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কাউন্টার টেররিজম’-এর চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর