বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে মানুষ

ডক্টর তুহিন মালিক

জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে মানুষ

এক. ‘আমি ছোট, আমাকে মারবেন না’— এই কথাটি সিএনজি অটোরিকশার পেছনে প্রায়শঃই দেখা যায়। তিন চাকার এই ছোট যানটি সড়ক-মহাসড়কের আজরাইলদের ভয়ে বড় বড় বাংলা হরফে লিখে রাখে ‘মামা, ধাক্কা দিয়েন না’। অন্যদিকে ‘মামারা’ ছোটদের প্রতি কোনোরকম দয়ামায়া দেখাতে যেন অপারগ। তাদের সোজা কথা, ‘ওই সিএনজিচালক আমার সঙ্গে তর্ক করছিল। আমার বাসের সঙ্গে তার অটোরিকশা লাগায় জরিমানা চেয়েছিল। গাড়ির সামনে পথ আগলে ছিল। তাই তাকে পিষে দিয়েছি।’ ঠাণ্ডা মাথায় এভাবে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাতে বসা একটা মাছি মারার মতো কি নির্লিপ্ত অনুশোচনাহীন স্বীকারোক্তি বাসচালক মজিদের! আর এভাবেই সে গত সপ্তাহে উত্তরার ব্যস্ততম রাস্তায় হাজারো মানুষের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে সিএনজি অটোরিকশাচালক ফারুককে পিষে মারে। লাইসেন্সবিহীন পাষণ্ড মজিদ ‘সর, নইলে পিষে দিব’ এই ঘোষণা দিয়েই সিএনজিচালক ফারুককে চাপা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে আধা কিলোমিটার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। আর ততক্ষণে সিএনজিচালকের ছিন্নভিন্ন নিথর দেহ পড়ে থাকে প্রকাশ্য রাজপথে। ফারুকের অটোরিকশার পেছনে কোনো আকুতি বাক্য লেখা ছিল কিনা জানি না। তবে তার লাশ যেন বর্ণমালার উজ্জ্বল হরফে বলতে চাইল, ‘আমি ছোট, আমাকে মারবেন না’।

আমাদের সমাজে এহেন পৈশাচিকতা শুধু কি ছোট অটোরিকশাচালকের প্রতি বড় দানবরা একাই ঘটাচ্ছে? আমরা নিজেরা কি প্রতিনিয়ত দুর্বলের প্রতি নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণের দায়ে দোষী নই? ঘাতকের বাসটিতে তো অন্ততঃপক্ষে অর্ধশত যাত্রীও ছিল। এদের মধ্যে একজনও কি সিএনজি ধাক্কা, তর্কাতর্কি, আধা কিলোমিটার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে পারেনি? প্রকাশ্য রাজপথের হাজারো মানুষ কি এই বর্বরতার পরিসমাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল? সব কৃতকর্ম সমাপ্তির পরই কেন পাষণ্ড বাসচালককে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো? প্রতিটি অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষগুলো আজ কেন এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে? এ জন্যই কি দুর্বৃত্তরা আজ এতটা বেপরোয়া? অযথা ঝামেলার মধ্যে নিজেকে না জড়িয়ে মুখ বন্ধ করে রাখার এই নবসংস্কৃতি বুমেরাং হয়ে না একসময় আমাদের নিজেদের দিকেই ফিরে আসে! প্রিয় বাংলাদেশ আজ কেন ক্রমাগত অমানুষের জনপদে ধাবিত হচ্ছে? দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু মানুষের সংখ্যা কেন দিন দিন এভাবে কমে যাচ্ছে?

দুই. সাম্প্রতিক সময়ে হঠাত্ করেই পুরো দেশে ক্রমাগত গুম, খুন, ধর্ষণ, মাদক, ক্রসফায়ার, সন্ত্রাস, জঙ্গি হামলা ও গণহত্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশুদের ওপর অমানবিক সব লোমহর্ষ হত্যাযজ্ঞ ঘটে যাচ্ছে। ১২ বছরের ফুটফুটে চেহারার নিষ্পাপ শিশু রাকিবকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পায়ুপথে হাওয়া দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নাড়িভুঁড়ি আর ফুসফুস ফেটে যাওয়া রাকিব চিত্কার করে বলছিল, ‘মামা আর দিয়েন না, মরে যাব’। কী অপরাধ ছিল ছোট্ট রাকিবের? এক গ্যারেজ থেকে অন্য গ্যারেজে কাজ করতে যাওয়ার ‘অপরাধে’ পায়ুপথে কম্প্রেসার মেশিনের হাওয়া ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি ফাটিয়ে হত্যা করতে হবে তাকে? চুরির অপবাদ দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে মারা হলো আরেক শিশু রাজনকে। পৈশাচিকতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে অবুঝ শিশুর মৃত্যুদৃশ্য পর্যন্ত ভিডিও করে সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ যেন মানুষ হত্যার এক মহাআনন্দযজ্ঞ! শুধু কি তাই? হত্যাকারীদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকার ‘স্পিডমানি’ নিয়ে স্থানীয় পুলিশ ঘাতককে সসম্মানে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুব্যবস্থাও করে দেয়। মামলা নেওয়া তো দূরের কথা উল্টা নিহত শিশুর বাবাকে পর্যন্ত পুলিশি নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়। মাগুরায় জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুমন সেনের হাতে গুলিবিদ্ধ হলো মাতৃগর্ভে থাকা আট মাস বয়সের শিশু। মাতৃগর্ভ পর্যন্ত আজ বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। শিশুটি জন্ম নিল পিশাচদের গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে। মাতৃগর্ভ থেকেই সে দেখল সমাজের নির্মম, কুিসত ও নিষ্ঠুর চেহারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে সুটকেসের ভিতর পাওয়া যায় ৯ বছরের শিশুর লাশ। মাছ চুরির অপরাধে বরগুনায় রবিউল নামে ১১ বছরের শিশুকে শাবল দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। জাতীয় ক্রিকেট দলের সেলিব্রেটি খেলোয়াড় শাহাদাতের মধ্যযুগীয় বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি ১১ বছরের ছোট্ট শিশু গৃহকর্মী হ্যাপি। এক বছর আগে এই শিশুটি যখন ১০ বছরের ছিল, তখন শাহাদাতের এক বছরের শিশুটির প্রতিপালনের দায়িত্ব এই শিশুটির কাঁধেই নিতে হয়। আর বড়লোকের বাচ্চার খাবারের রান্নার কোয়ালিটি ভালো না হলে গরিবের সন্তানের পেটেই যে লাথিটা পড়ে! মিসেস সেলিব্রেটিরা বেত দিয়ে গরিবের সন্তানদের পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দরিদ্রতার চিহ্নটা যেন এঁটে দেন এভাবেই! অথচ কী আশ্চর্য, পুরো জাতির ভালোবাসায় সিক্ত এই ক্রিকেটারের যে হাতে আমরা ব্যাট-বলের গৌরবকেই প্রত্যাশ্যা করি, আজ সেই হাতেই কেন এতটা নৃশংসতা! কে জানে, এরকম কতটা শাহাদাতকে আমরা নিজেদের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছি!

তিন. এই ঘটনাগুলো তো আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। আমরা কেনইবা সমাজের এসব সহিংসতা ধারণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম? দুর্বলের ওপর সবলের পেশিশক্তি প্রয়োগের এই উন্মত্ততাকে রুখবে কে? শক্তিমানরা কেন এভাবে শক্তিহীনদের ‘পিষে মারতে’ চায়? অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে যখন ‘তর্ক করার’ অপরাধ বলে সাব্যস্ত করা হয়, তখনই শক্তিবানরা ‘পিষে মারার’ যৌক্তিকতাকে খুঁজে পায়। আসলে এটা প্রতিবাদকারী আর ভিন্ন মতকেই ‘পিষে মারা’র নামান্তর নয় কি? বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতির বীষবৃক্ষ তো আমাদেরই সৃষ্টি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আজ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। সরকারের সামান্য সমালোচনায় প্রতিনিয়ত জেলে যেতে হচ্ছে মানুষকে। আসলেই কি মানুষের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে সমাজ থেকে? এই নির্মম, পাষণ্ড, অমানবিক সমাজকে কি বাইরে থেকে অন্য কেউ এসে জন্ম দিয়ে গেছে? নাকি এই সমাজ আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। বিবেক আর মানবতাবোধ কি বর্বর পৈশাচিকতার কাছে এভাবেই হার মেনে যাবে? রাষ্ট্রের সব আয়োজন কি শুধুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্যই তাড়া করে ফিরবে? পুলিশ বাহিনীতে হাজার হাজার নতুন নিয়োগ, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র, রাবার বুলেট আর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ সবই করা হচ্ছে কিন্তু মানুষের জীবনের নিরাপত্তার সরঞ্জামগুলো আজ কোথায়? ৫৪ ধারা আছে, ৫৭ ধারা আছে। কিন্তু শান্তিতে বেঁচে থাকার ধারা কোনটি?

চার. দেশে আইনের শাসন আজ পুরোপুরি বিপর্যস্ত। ক্ষমতার দাপট আর পেশিশক্তির কল্যাণে অপরাধীরা আইনের শাসনকে যখন নিজেরাই শাসন করতে থাকে তখনই বিপর্যয় ঘটে মানবতার। নীতিবোধ নিয়ে কথা বলা সমাজে যখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় নৈতিকতা তখন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অন্যায়কে তোষামোদ আর চাটুকারিতা যখন বৈষয়িক উন্নতির একমাত্র নির্ধায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, মানুষের মধ্যে তখন ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদটা খুবই সূক্ষ্ম হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের মধ্যে বর্বর হায়েনারা তখন পঙ্গপালের মতো হিংস্র হয়ে বেড়ে উঠে ক্ষমতাশীলদের তর্জনী বেয়ে। মাতৃগর্ভে থাকা শিশুকে পর্যন্ত গুলি করে তারা সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মাতৃগর্ভ পর্যন্ত এখন আর তাদের হাতে নিরাপদ নয়। আসলে মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকেই এই শিক্ষাটা নিয়েছে। মানুষ দেখছে পেশিশক্তি দিয়ে আর নির্যাতন করে নিজেকে বিজয়ী করাটা সম্ভব। শক্তিপ্রয়োগ করেও যখন বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায় তখনই সমাজে এরকম সব নারকীয়তার জন্ম হয়। যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা দিয়ে বলা হয় যে, ঘরে ঘরে বেডরুম পাহারা দেওয়া রাষ্ট্রের কাজ নয়, সেখানে নিষ্ঠুরতার লাইসেন্সপ্রাপ্তদের হাত কাঁপতে দ্বিধাইবা করবে কেন?

পাঁচ. আধুনিক সমাজে আমরা সভ্য হয়েছি ঠিকই। কিন্তু নিজেদের পরিবর্তনটাও ততটাই ভয়ঙ্করভাবে ঘটে যাচ্ছে। আর এ কারণেই আজ নীতি, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতার এমন আকাল সভ্য সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে। শিক্ষকের যে আলমারিতে বই থাকার কথা আজ সেই আলমারিতে কেন বিবস্ত্র ছাত্রীর সন্ধান মেলে? ঐশীদের হাতে কেন জীবন দিতে হয় পিতা-মাতাকে? ঐশীদের মৃত্যুদণ্ড হলেও, বদিদের কেন মুক্তিদণ্ড মেলে? ইয়াবার নেশার অপরাধীরা ফাঁসির দণ্ড পেলেও ইয়াবার যোগানদাতারা কেন দায়মুক্তি পায়? অথচ ‘জনগণের জানমালের কোনোই নিরাপত্তা নাই’ এই অভিযোগে সব দোষ ফেসবুকের ঘাড়ে চাপিয়ে বন্ধ করে দেই। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলুন কিংবা অনৈতিকতা, অশ্লীলতা, উসকানিমূলক প্রপাগান্ডা বা যৌন হয়রানির কথাই বলুন, ফেসবুক কি আসলেই এগুলোর জন্য একা দায়ী? আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, নীতি-নৈতিকতা, রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ কিংবা ভিনদেশি নগ্ন সংস্কৃতি, হাজার হাজার অশ্লীল পর্নো সাইট, ধর্ম বিদ্বেষী ব্লগ কি এগুলোর জন্য কম দায়ী নয়? ভারতীয় সিরিয়াল ও হিন্দি চ্যানেলগুলো কি আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের উচ্ছৃঙ্খলার জন্য কোনো প্রভাবই বিস্তার করছে না? 

ছয়. একটি আফ্রিকান গল্পের কথা বলি। ‘আফ্রিকায় প্রতিদিন ভোরে একটি হরিণ জাগছে। সে জানে সবচেয়ে দ্রুতগামী সিংহের চেয়ে তাকে দ্রুত দৌড়াতে হবে, নইলে তাকে মরতে হবে। আর অন্যদিকে প্রতিটি সকালে একটি সিংহও জাগছে। সে জানে সবচেয়ে ধীরগতি হরিণের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে হবে তাকে। নইলে তাকে না খেয়ে মরতে হবে। আপনি হরিণ না সিংহ, তাতে কিছুই যায় আসে না। নিজেকে বাঁচাতে চাইলে সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়াতে শুরু করতে হবে।’ আফ্রিকান এই গল্পের মতোই হিংস্র পশুর খাবারের শিকার হওয়ার আগেই আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে দ্রুত দৌড়াতে হবে। মানবতা ধীরগতি হয়ে পড়ছে সত্য, তবে মানবিকতা কখনো আত্মসমর্পণ করে না। মানবতাবোধ ঠিকই জেগে উঠে প্রত্যুষের দীপ্তিময় সূর্যের মতোই। যে জাতি একটি ফুলকে বাঁচাতে গিয়ে যুদ্ধ করে, একটি ফুলের হাসির জন্য অস্ত্র ধরে, তারা এভাবে বর্বর পাষণ্ডদের কাছে পরাজিত হতে পারে না কখনো।

     লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর