সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

পৌর নির্বাচন ইসির নির্লজ্জতার উদগ্র প্রমাণ

নূরে আলম সিদ্দিকী

পৌর নির্বাচন ইসির নির্লজ্জতার উদগ্র প্রমাণ

৩০ ডিসেম্বর ২৩৪টি আসনে পৌর নির্বাচন হয়ে গেল। এই নির্বাচনে ইসিপ্রধানের লম্ফঝম্প, ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি এবং পক্ষপাতিত্বের দৃষ্টান্তই কেবল ফুটে ওঠেনি, বরং প্রকটভাবে প্রমাণিত হয়েছে ইসি একটি নিজস্ব সত্তাবিলুপ্ত ঠুঁটো জগন্নাথ। দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে দেখা গেছে পৌর নির্বাচনটি ছিমছাম এবং নিরুপদ্রব (কিছু ব্যতিক্রমভাবে) অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীক দিয়ে পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনের ফলাফলের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে বিন্দুমাত্র সত্যাশ্রয়ী হতে পারতেন, যদি অকপটে স্বীকার করতেন যে প্রশাসনের কোনো স্তরেই তার বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ তো ছিলই না, এমনকি একজন চৌকিদারও তার কথা শোনেনি। তারা ওনাকে কতটুকু বিভ্রান্ত করেছে এবং তার আদেশ-নির্দেশ (কতটা আন্তরিক ছিল বলা যাবে না) বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করেনি, এটি তিনি উপলব্ধি করেও নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এমন ভাব দেখালেন যে এত স্বচ্ছ, স্বতঃস্ফূর্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পৃথিবীতে খুব কমই হয়েছে। ইসির নিজস্ব প্রশাসনের লোকেরাও স্বীকার করবেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের নির্দেশনার বাইরে তিনি একটি চোখের পলকও ফেলতেন না। চাকরি রক্ষার জন্য এটিই মূল শর্ত। এটি আমরাও জানি। তবে নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ আস্ফাালন দিবালোকের মতো স্পষ্ট করেছে, তিনি লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছেন এবং এই পৌর নির্বাচন ইসির নির্লজ্জতার উদগ্র প্রমাণ! গণতন্ত্রের প্রতি যারা শ্রদ্ধাশীল, মৌলিক অধিকারকে যারা জীবনের স্পন্দন মনে করেন, মানুষের হৃদয়ের অনুরণনকে যারা নিজ হৃদয়ে অনুরণিত হতে শোনেন, তাদের কাছে নির্বাচনটি দলীয় প্রতীকে হলেও ইসির এহেন আচরণ কল্পনার আবর্তে কখনোই আসেনি।

নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে শুধু ২০-দলীয় জোটই নয়, অন্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এবং বিবেকাশ্রিত সুশীল সমাজ একটি কনভেনশন ডেকে ইসিকে কী করে শক্তিশালী, কার্যকরী ও নিরপেক্ষ রাখা যায় তার জন্য একটি জাতীয় কনভেনশন, ন্যূনতম পক্ষে কোনো পত্রিকা বা নিরপেক্ষ জনগোষ্ঠীর দ্বারা একটি গোলটেবিল অনুষ্ঠানেরও দাবি তুলেছিলেন। ক্ষমতার অসহনীয় দাম্ভিকতার কারণে ক্ষমতাসীনদের আঁতিপাঁতি, ছোট-মেজ-বড় নেতা, এমনকি যিনি কী সংগঠন, কী জোটের একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী, তিনি উপহাস-উপেক্ষা করে আবেদনটির প্রতি যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন— তাতে সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করেছে, মানুষ কতটা অসহায়, নিরাপত্তাবিহীন এবং মৌলিক অধিকার বিবর্জিত ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে নিমজ্জিত।

যখন আলোচনার দাবিটি প্রবল হয়ে উঠছিল, তখন তৃতীয় মাত্রার ১৫ ডিসেম্বরের টকশোতে কুশলী ও প্রতিভাপ্রদীপ্ত উপস্থাপক জিল্লুর রহমান আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি সমঝোতা চান? আমি ক্ষিপ্র উত্তর করেছিলাম, আমি দুই জোটের সমঝোতা, আসন ভাগাভাগি অথবা আধিপত্যের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না বলেই সমঝোতা নয়, বরং প্রতিহিংসার লেলিহান শিখা থেকে জাতি নিষ্কৃতি পাক ও একটি অজানা আশঙ্কার, চরম নিরাপত্তাহীনতার অতলান্ত থেকে বেরিয়ে আসুক— সেটিই চাই। সংঘাত বিবর্জিত রাজনীতি গণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করে— সাম্প্রতিককালের একই দিনে দুটি জনসভা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে রাজনৈতিক মদদ না হলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথা তুলতে পারে না, এ পৌর নির্বাচন ও ৫ জানুয়ারির সভাই সেটিকে সুস্পষ্ট করেছে।

জনান্তিকে জানিয়ে রাখি যখন ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান ঘোষণা দিলেন, মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র নয়, উন্নয়নই তার লক্ষ্য, তখন আমার মনে হয়েছিল পৌর নির্বাচনটির পরিণতি আসলে কী হতে পারে? আমার অনেক সুহৃদ, শুভাকাঙ্ক্ষী, যাদের অনেকেই সরাসরি দুই জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, তারাও প্রত্যাশা করেছিলেন নির্বাচনটি গণতন্ত্রের সূর্যালোকে বাংলাদেশকে সূর্যস্নাত না করলেও কিছুটা আশঙ্কাবিমুক্ত করবে।

একটি নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, সরকারের এবং বিরোধী দলের সুশৃঙ্খল আচরণ গণতন্ত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও নতুন পথপরিক্রমণের দ্বার উন্মোচিত করবে। একদিকে ২০-দলীয় জোটের গত বছরের টানা ৯০ দিনের অবরোধ; পেট্রলবোমা, গ্রেনেড হামলায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত এবং সহস্রাধিক মানুষ আহত হওয়াতে ২০-দলীয় জোটকে মানুষ জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। অন্যদিকে প্রশাসনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা ও সংসদের অভ্যন্তরে একটি অকুতোভয় হৃদয়ের অনুপস্থিতি। সংসদের যে কোনো অধিবেশনের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয়ের শতকরা ৮০ ভাগই স্তাবকতা, অর্চনা, বন্দনা, চর্বিত চর্বণ আর অবশিষ্ট ২০ ভাগ সময় বিরোধী জোটের নির্মম ধোলাই এবং ক্ষেত্রবিশেষে অশ্রাব্য-অশ্লীল আলোচনা।

আরেকটি নিবন্ধে আমি অতি বিনম্রচিত্তে ক্ষমতাসীন জোটের নেতাকে আরজ করেছিলাম যে, পৌর নির্বাচনের অধিকাংশ আসনও দৈবক্রমে বিরোধী জোট পেয়ে গেলেও তাতে তো সরকার পরিবর্তন হয়ে যাবে না। তবে প্রমাণ হবে, জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারটি কোন স্থানে অবস্থান করছে। দুষ্ট চক্রের মতো ক্রমাগত ভুল বোঝাতে বোঝাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতার চতুর্পাশে মস্কো-পিকিং তো বটেই, সর্বহারা, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, গণবাহিনীর নেতৃত্ব তাকে প্রায়শ সবক দিতেন, যে কোনো রকমে ২০-দলীয় জোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায় তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি এতটাই প্রকট হবে যে তা রোধ করা প্রচণ্ড দুঃসাধ্য হবে। তাই রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশালের মতো বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না। এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত সত্য, সুবিধাভোগী বিভিন্ন দলের দলছুট ব্যক্তিত্বের সমাহার ও সামরিক-ব্যক্তিত্বের হাতে গড়ে ওঠা বিএনপির কাছে ত্যাগী ও সাহসী কর্মীর ঝুঁকি নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ফলে আন্দোলন কিংবা নির্বাচন কোনো ক্ষেত্রেই তাদের সফলতা তো আসেই না বরং সাংগঠনিক দুর্বলতাকে প্রকট করে তোলে। বিএনপির চরম এ ব্যর্থতাকেই ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বলার সুযোগ পেয়েছে, যারা আন্দোলন করতে পারে না, সন্ত্রাস তাদের একমাত্র সম্বল। তারা নির্বাচনেও জিততে পারে না। পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম খালেদা জিয়াকে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, এই নির্বাচনটি জয়-পরাজয়ের লক্ষ্যে নয় বরং প্রতি সাংগঠনিক জেলায় ৫০০ করে কর্মী তৈরি করার সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিন, যারা স্বেচ্ছা কারাবরণের মানসিক প্রতীতি ও প্রত্যয়বোধ উজ্জীবিত থাকবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে থেকেছেন এটা বাস্তব, কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে আত্মত্যাগী কর্মী কয়টি তৈরি করতে পেরেছেন সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষের উদাহরণ আমি দিয়েছিলাম। খাদি আন্দোলন, লবণ আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন— এ উপমহাদেশে দৃষ্টান্ত রেখেছে কীভাবে এ ধরনের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীর শক্তি তৈরি করা যায়। আমি এটাও বলেছিলাম যে, ৬০ দশক থেকে শুরু করে, বিশেষ করে ছয় দফা প্রদানের পর স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দীর্ঘ পথপরিক্রমণে কেমন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকার ছাত্রলীগ একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে সমগ্র জাতিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি চেতনার মোহনায় একাকার করে দিয়েছিল, সেটিও উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে কখনোই প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, নির্যাতন-নিগ্রহের পরোয়া করি না বলেই আমি দুর্নীতির দীপ্তিহীন আগুনে দগ্ধীভূত এ জাতির পক্ষে আমৃত্যু কথা বলে যাব। আমি আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার শত্রু নই, আর খালেদা জিয়ার সঙ্গে তো আমার মিত্রতার প্রশ্নই ওঠে না। ’৯১ সাল থেকে আমি অদ্যাবধি লক্ষ্য করছি সরকারি জোট তো বটেই, বিরোধী দল থেকেও একটিবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো বজ্র ওঠেনি। চেষ্টা যতই করা হোক না কেন, দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অতলান্ত থেকে দেশ ও জাতিকে তুলে আনতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুকে সম্মুখে রেখে আমরা যারা একটি শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ চেয়েছিলাম তাদের দাবি যে, দ্রুতবিচার আইন বসিয়ে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করুন। তাতে দুর্নীতি তো কমবেই, মানুষ সাহস পাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। সংবাদপত্র, শিক্ষক, ছাত্র, সুশীল সমাজ আজ এতটাই ম্রিয়মাণ যে, দুর্নীতির তাণ্ডবলীলায় সমাজের প্রতিটি স্তর বিধ্বস্ত হলেও কেউ সাহস করে কথা বলছে না। আমরা বিবেকের কাছে, আল্লাহর কাছে দায়মুক্ত হতে পারছি না। আমি স্থির প্রত্যয়ে বিশ্বাস করি, ইতিহাস সত্যের বাহক। সক্রেটিস হেমলক পান করেছিলেন, কিন্তু মিথ্যার সঙ্গে আপস করেননি। আমি মুসলমান। দীনের দিকে তাকালেও দেখি, অমানুষিক নির্যাতন-নিগ্রহ, লোভ-প্রলোভনের মধ্যে তারা আল্লাহর নির্দেশ থেকে একটু সরে আসেননি এবং শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হয়েছেন।

তাই আল্লাহর কাছে আমার নিষ্কলুষ ফরিয়াদ, আমৃত্যু মানুষের হৃদয়ের অনুরণনকে আমি উচ্চারণ করবই। যেমন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনা ও বিশ্বাসের উত্তরাধিকার ও চারণ কবি ছিলাম, সেই জায়গা থেকে যেন কখনোই সরে না যাই।

লেখক : স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা

সর্বশেষ খবর