সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

অবিস্মরণীয় বিচারপতি মোরশেদ

কাজী সালাহউদ্দীন

অবিস্মরণীয় বিচারপতি মোরশেদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আমাদের আইনের ইতিহাসে তিনি বেঁচে থাকবেন একজন নির্ভীক, সেই সঙ্গে প্রগাঢ় বুদ্ধি এবং মেধায় অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তিনি আইনজীবীদের অনুপ্রেরণার উৎস। তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিচারালয়ের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। গভীর মানবতাবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আবদুস সালিক ছিলেন তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। এক সময় বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা আফজালুননেছা মরহুম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভগ্নি।

সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে মোরশেদের পূর্বপুরুষ বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ওয়ার্ন হেস্টিংসের শাসনামলে মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ নামে তার একজন পূর্বপুরুষ সদর দেওয়ানি আদালতের সভাপতি ছিলেন। মাতা আফজালুননেছা ইসলামিক ইতিহাসখ্যাত ও সিরিয়ার শাসক তথা আরব বিশ্বের উজ্জ্বল নক্ষত্র বীর যোদ্ধা খালিদ বিন ওয়ালিদের বংশ পরম্পরায় আগা বাকের খান যিনি বাংলায় মোগল শাসনামলে গভর্নর ছিলেন। যার নামানুসারে ওই সময় বাকেরগঞ্জ জেলার নামকরণ হয় তারই বংশধর।

যুদ্ধ-উত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ-ভারতে মানবতার সেবায় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম সংস্থাটির মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। দেশভাগের আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি, যা ২১ দফারই সারাংশ হিসেবে ইতিহাস বেত্তাদের কাছে বিবেচিত। ঊনসত্তরে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফা দাবির প্রতিপাদ্য যে একই সূত্রে গাঁথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দাবি প্রণয়নে যার প্রজ্ঞা, মেধা এবং মনন ক্রিয়াশীল ছিল তিনি অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান এক স্মৃতিচারণে এ প্রসঙ্গে লেখেন : ‘মনে পড়ে সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে স্টেজে তার পাশে বসবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করেছিলেন তার জলদমগ্ন কণ্ঠস্বরে, আর আমি পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ নিবেদিত একটি কবিতা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম বিচারপতি মোরশেদের সুলিখিত ভাষণ। সেই ভাষণ ছিল কুিসতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনো মনে পড়ে তার সেই ঋজু দীর্ঘ দণ্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগাঢ় উচ্চারণ, মনে হয় এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, সেই আলোকময় মণ্ডপে চিত্ত যেথা ভয়শূন্য।’

১৯৬৮ সালে যখন কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান তখন তার কৌঁসুলি স্যার উইলিয়ামস্-এর সবচেয়ে নিকটতম সহকর্মী ছিলেন বিচারপতি মোরশেদ। প্রথম সাক্ষাতে বিচারপতি মোরশেদ টম উইলিয়ামসেক বলেছিলেন : ‘আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাব।’ জবাবে টম উইলিয়ামস্ তাকে বলেছিলেন : ‘একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি। সুতরাং আপনি আমার উপদেষ্টা হিসেবেই কাজ করবেন।’ টম উইলিয়ামস্ যতদিন ছিলেন ততদিন বিচারপতি মোরশেদকে তিনি প্রধান বিচারপতি বলেই সম্বোধন করতেন।

পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে রাউন্ড টেবিলে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানালে বিচারপতি মোরশেদের পরামর্শে রাউন্ড টেবিলে যেতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু হয়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘চল চল ক্যান্টনমেন্ট চল’, ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’ ইত্যাদি গগনবিদারী স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান এবং নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর গণআন্দোলনে পাকি শাসকের গুলিতে নিহত হন। ফলশ্রুতিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্তভাবে মুক্তিলাভ করেন এবং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দেন।

বিচারপতি মোরশেদ সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে কোনোদিন বিচ্ছিন্ন হতে দেননি। তার মেধা এবং প্রজ্ঞার বলে তিনি বিচারকের মনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মনের সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষের মৌলিক অধিকারকে মূল্য দিতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠীর কাতারে না দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ কারণেই প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে জনগণের সম্মান এবং ভালোবাসা তিনি লাভ করেছিলেন। বর্তমান সময়ের এই ক্রান্তিকালে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের গৌরবোজ্জ্বল জীবন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনাসমূহ প্রকাশের ব্যবস্থা অচিরেই নেওয়া প্রয়োজন আমাদের জাতীয় স্বার্থেই। এতে দেশ জাতি উপকৃত হবে। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি মোরশেদ এই সুন্দর সুশোভিত পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তার জন্মদিনে জানাই অনন্ত শ্রদ্ধা। কারণ তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, বাতিঘর।

সর্বশেষ খবর