মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্বাধীন দেশে দাস্য মানসিকতা কাম্য নয়

মোশাররফ হোসেন মুসা

যেদিন অষ্টম পে-স্কেল ঘোষিত হয় সেদিন পত্রিকার দোকানে কোনো পত্রিকাই অবিক্রীত থাকেনি। শোনা গেছে, সব পত্রিকা চাকরিজীবীরা কিনে নিয়ে গেছে। তারা অন্যদিন পত্রিকা না কিনলেও সেদিন কিনেছেন শুধু কার কত বেতন বৃদ্ধি পেল, নতুন কি কি সুবিধা যোগ হলো ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে জানার ও পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার জন্য। ঘোষিত পে-স্কেলে তাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতেও তারা সন্তুষ্ট নন। তারা বেতন স্কেল পরিবর্তন ও বেতন বৈষম্য দূর করাসহ নানা ধরনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অন্য চাকরিজীবীদের মতো আন্দোলন শুরু করেন। সর্বোচ্চ গ্রেডের দাবিতে ক্লাস বর্জন ও মিছিল-মিটিংও করেছেন তারা। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকের পর তাদের কর্মসূচি কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখেছেন। আমরা জানি, একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের মজুরি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য ও কৃষি উপকরণের দাম প্রায় সমান সমান। চাকরিজীবীদের কারও মুখে শোনা যায়নি, ‘আমাদের বেতন যথেষ্ট। এ মুহূর্তে বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। যাদের শ্রমে দেশ এগুচ্ছে তাদের ব্যবস্থা আগে হোক।’ বাস্তবে এর বিপরীতটাই দেখছি। তাদের ‘চাওয়া’ নির্ভর মানসিকতা (Labor mentality) স্বাধীন দেশে এভাবে বিদ্যমান থাকা কতটা যৌক্তিক প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেহেতু একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে কোনো শাসক থাকেন না, প্রজাও থাকে না। সেখানে সবাই মালিক সবাই সেবক। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পরেও কেন যে আমরা উপনিবেশিক মনোবৃত্তি থেকে বেরুতে পারছি না এটাই এখন গবেষণার বিষয়।

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্ট্যাটল বলেছেন, ‘সব চাকরিই মনকে শুষে নেয় ও হীন করে তোলে।’ অ্যারিস্ট্যাটল দাস যুগের দার্শনিক ছিলেন। সে সময় দাসদের ও গৃহপালিত পশুদের একই চোখে দেখা হতো। তিনি চাকরিজীবী বলতে রাজ কর্মচারী ও সৈন্য-সামন্তদের বুঝিয়েছেন। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক শাসকের দার্শনিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সে জন্য তাদের অবসর ও স্বাধীনতা উভয়ই প্রয়োজন। বর্তমান যুগের চাকরিজীবীরা বেতনভুক্ত কর্মচারী হলেও আগের মতো পরাধীন নয়। তারা প্রতি কর্ম দিবসে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মতামত দিতে পারেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষকরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া আইনবিরোধী নয়। বহু শিক্ষক রয়েছেন যারা বিরোধী দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। সে জন্য তাদের আন্দোলন হওয়া উচিত অভিভাবক সুলভ। তারা ক্লাস বর্জন ও মিছিল-মিটিং করে প্রমাণ করেছেন তারা বেতনের মাপকাঠিতে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে চান। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘শিক্ষকেরা মহান পেশার মানুষ। তারা কেন নিজেদের আমলাদের সঙ্গে তুলনা করেন। তারা তো নিজেরাই নিজেদের কর্মে অনেক বড়। ... উনারা সচিবের সমান কেন মর্যাদা চান? সচিবদের সঙ্গে কী অধ্যাপকদের তুলনা চলে? কোনো সচিবকে কী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে তুলনা করা হয় (আ.অর্থনীতি, ৫ জানু ’১৬)’। শিক্ষকদের বক্তব্য হলো, তারা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছেন না। বর্তমান পে-স্কেলে গ্রেড অনুযায়ী মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ধাপ ‘প্রফেসর’ পদটি তৃতীয় গ্রেডে নামানো হয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষক বলেছেন, তারা যদি কোনো কাজ না করে থাকেন তাহলে বিসিএস পাস প্রতিভাবানরা আসে কোত্থেকে? সবার জানা রয়েছে, এদেশে বড় বড় দুর্নীতির পিছনে তথাকথিত প্রতিভাবানদের সক্রিয় ভূমিকা থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কাজ করেন না’ শীর্ষক এক কলামে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনীত কিছু অভিযোগ খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। অভিযোগগুলো হলো— তারা ক্লাস নেন না, পড়ান না, নিজেরাও পড়েন না। ছাত্রদের শেখাবেন কি! তাদের কোনো গবেষণা নেই। পৃথিবীর ১০০টি কিংবা ১০০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই কেন ইত্যাদি (প্র.আলো, ১২ জানুয়ারি ’১৬)। তিনি উপরিউক্ত অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে যতই যুক্তি দেখান না কেন, আমরা অভিযোগগুলোর পক্ষে বহু প্রমাণ দেখতে পাই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পিছনে প্রতি বছর গড়ে প্রায় দুই লাখ টাকা ব্যয় হয় (যদি শিক্ষকদের বেতন, অবকাঠামো ব্যয়, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিলসহ অন্যান্য সিস্টেম কস্ট যোগ করলে এ ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের জুনিয়র স্কলার হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু তারা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পোড়ান, ক্লাস-রুম ভাঙচুর করেন, সিট দখল করেন, কেন্টিনে ফাও খান ইত্যাদি দেখলে মনে হয় না তাদের মধ্যে মালিকানাবোধ (ঙহিবত্ংযরঢ় সবহঃধষরঃ) আছে। তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে— সার্টিফিকেট নাও, তদবির করে একটি সরকারি চাকরি বাগাও। অথচ স্বায়ত্তশাসনের পূর্ব শর্ত হলো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী থাকা। নিম্নআয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বহু শিক্ষিত যুবক আছেন, যারা সরকারি চাকরির চেয়ে বেসরকারি চাকরিকেই বেশি পছন্দ করেন। তারা নতুন নতুন ব্যবসাসহ বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এমতাবস্থায় পরাধীন আমলের মনোবৃত্তি ধারণ করে চাকরি করা মোটেই উচিত হবে না। আমাদের রাজনীতিকরাও কি ‘চাই-চাই’ মানসিকতা থেকে মুক্ত নন। জাতীয় সংসদের লবিতে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে এমপিদের মিছিল করার ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, তারা যদি মিছিল করেন তাহলে সমাধানকারী কর্তৃপক্ষ কারা? এটাও শতভাগ সত্য যে, রাজনীতিতে অসুস্থতা থাকলে সেই অসুস্থতা থেকে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই মুক্ত থাকে না। সেই অসুস্থতা থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে-সেটির দিশা দেখানোর দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণের জায়গা।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর