বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

আসুন জাতীয় সাংস্কৃতিকে রক্ষা করি

শেখ নজরুল ইসলাম

আসুন জাতীয় সাংস্কৃতিকে রক্ষা করি

স্বাধীন-সার্বভৌম ঐতিহ্যের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো হাজার বছরের অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল, ঐতিহাসিক, সমৃদ্ধিশালী সাংস্কৃতিক অস্তিত্বই আমার জাতীয় ঠিকানা। স্রোতস্বিনী নদীর মতো বাধাহীন গতিবেগে বয়ে চলা, জোয়ারের জলে সব পূতিগন্ধময় আবর্জনা ধুয়ে-মুছে নতুন জনপদ সৃষ্টি করাই এর কাজ। এটি উত্তরোত্তর আবিষ্কৃত হবে, বিকশিত হবে, পৃথিবীর শুদ্ধ, সভ্য, সুন্দর কৃষ্টি-কালচার, শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, মানবিক ও আর্থ-সামাজিক নিরপেক্ষ ধর্মীয় মূল্যবোধের মহীমায় বিশ্বকে করবে আলোকিত। দেওয়া-নেওয়ার বন্ধনে, যা কিছু ভালো, সত্য-সুন্দর, সৃষ্টিশীল, অনুসরণীয় নিরাপদ ও কল্যাণকর তা গ্রহণ করবে, আর যা কিছু মন্দ, অসুন্দর, ক্ষতিকর, অকল্যাণকর তা বর্জন করবে! তা সেটা যতই মূল্যবান ও গ্লামারাস হোক না।

প্রায় চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং তত্কালীন ৯৯ ভাগ মানুষের সর্বাত্মক সমর্থন ও নির্যাতিত রক্তের বেদিতে দাঁড়িয়ে আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এটা কোনো ব্যক্তি বা একটি দলের অবদান নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শিকড় প্রোথিত আছে প্রতিটি জাতীয়তাবাদী মানুষের হূদয় থেকে হূদয়ের গভীরে। তা হঠাত্ গজিয়ে ওঠা কোনো আনকালচার, অর্বাচীন, অবৈধ অর্থের অধিকারী রাজনৈতিক তস্করের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না। গ্লোবালাইজেশনের দোহাই দিয়ে উন্মুক্ত আকাশ অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের বহু দিনের কষ্টার্জিত জাতীয় সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একে রক্ষা করা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের জাতীয় দায়িত্ব। প্রয়োজন এই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ।

এ জন্য প্রথমেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। সে জন্য চাই নির্বিবাদ, নিঃস্বার্থ, দেশপ্রিয় মানুষের জাতীয় ঐকমত্য। আজকের কোমলমতি কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের ৯০ ভাগ প্রতিনিয়ত অপসংস্কৃতির ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। ওরাই জাতির ভবিষ্যত্। ওদের বাঁচাতে হলে জাগ্রত বিবেকবান, সমাজসেবক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, ইমাম, পূজারি, মন্দির, মসজিদ এবং ভজনালয়ের শুদ্ধ আত্মার শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। সব স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয়তাবাদের দেশপ্রেমের জ্ঞানের আলো বিতরণ করতে হবে।

যেমন দেশে অকাল বন্যা, সাইক্লোন, সুনামি বা কোনো মহামারী রোগে জনপদ আক্রান্ত হলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জাতি ধর্ম ভুলে মানুষ মানুষের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেমন করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সব ভেদাভেদ ভুলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মৃত্যুঞ্জয়ী আত্মপ্রত্যয়ে খালি হাতে শুত্রুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন তো পাকিস্তানি হানাদার এবং তার দোসরদের খালি চোখে চেনা যেত, কিন্তু এই অপসংস্কৃতির অলৌকিক ঘাতক ব্যাধি ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসীদের ক্যান্সার রোগে পুরো জাতিকে নীরবে নিভৃতে তিলে তিলে গ্রাস করছে। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সমন্বিত প্রচেষ্টায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

আমাদের দেশ ছোট, কিন্তু জাতি অনেক বড় : ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এখনো ভালো মানুষের অভাব নেই। আমাদের জাতীয় সংবিধানে লেখা আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অর্থাত্ জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক। সুচিন্তক রচনাকারীদের রাষ্ট্রীয় স্লোগান পেট্রলবোমায় পুড়ছে। মরছে ওরাই যারা সংবিধানও বুঝে না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতও নয়, যাদের সাংস্কৃতিক শিষ্টাচার নেই, রাজনৈতিক ঐতিহ্য নেই। কিছু অশিক্ষিত উগ্র মস্তিষ্কের উচ্চাভিলাষী মানুষ, বহু নিরীহ নিঃস্বার্থ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ধার-দেনার এই স্বাধীন দেশে চৈর্যবৃত্তিকার ও কিছু লুটেরা মহাজন এই অভাগা দেশের ভাগ্যবিধাতা বনে যাচ্ছে।

চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম। সভ্যতা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, ওটা ঘরে তৈরি হয়। একে কষ্ট করে অর্জন করতে হয় এবং সংরক্ষণ করতে হয়। একটি নবজাতক শিশুর জন্য ঘরই তার মন্দির, মসজিদ, গির্জা। যে মা-চাচির হাতে শিশু প্রতিপালিত হয় তিনি ওই শিশুর ভবিষ্যত্ নির্মাতা, যার মা ভালো, তার সন্তান ভালো। যার সন্তান ভালো তার দেশ ভালো। জাতি নির্মাতা মা পেতে হলে চাই সুন্দর সুস্থ পরিবেশ কিন্তু কোথায় সেই সুস্থ পরিবেশ! ক্ষমতা দখলের রাজনীতির মাঠে মানুষ মেরে তার শরীরের ওপর নৃত্য করে বাহাদুরি দম্ভ প্রদর্শন, একটি নিরীহ হিন্দু ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করে উপরমহলকে খুশি করা আগুনে নিরীহ শিশুকে পুড়িয়ে মেরে ক্ষমতা দখলের রাজ্যে মানবতা তথা মাতৃস্নেহের মূল্য কোথায়। তাই তো বিশ্ববরেণ্য মনীষীরা, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড ’শ, সক্রেটিস, ডেল কার্নেগি ম্যাক্সিম গোর্কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, সন্তানকে সুসন্তানরূপে মানুষ করতে চাইলে বাড়িতে কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি, যুবতী মেয়ের চিত্তাকর্ষক ছবি রাখা যাবে না। পিতা-মাতাসহ পরিবারের সবাইকে সুশৃঙ্খল ও অত্যন্ত সংযমী হতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই সংযম। কোথায় আজ সভ্য সাংস্কৃতিক পরিবেশ। এদেশের প্রতিটি মানুষের হূদয় মস্তিষ্কে উন্মাদনার ঔদ্ধত্যে অস্থির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা সভ্যতার নামাবলী গায় দিয়ে মানবতার মিথ্যা অজুহাতে আমাদের লোহিত কণিকায় ঢুকে গেছে। অর্থনীতির ভাষায়, ক্রিয়েটেট স্ক্রাসিটি অর্থাত্ কৃত্রিম অভাব তৈরি করে আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিরীহ জনগণের ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে জাতীয় চরিত্র হনন করে ঋণের ঔরসে বিকলঙ্গ শিশুর জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে দাঙ্গা হানাহানির ফোকর গলে অস্ত্র ও অর্থের অদৃশ্য কালো হাত আমাদের হূিপণ্ড ও কিডনিগুলো অকেজো করে দিচ্ছে।

গত প্রায় ৬৮ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূমে পরবাসী। নিরীহ নারী শিশুর অশ্রুজলে মরুভূমির তপ্ত বালু শীতল হচ্ছে। নিষ্পাপ নবজাত শিশুটি জন্মে মায়ের লাশের পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজের রক্ত নিজেই পান করছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক শিকারের বলি সিরিয়ার নিষ্পাপ শিশু তিন বছরের আয়লানের ভেসে আসা লাশ সমুদ্রপাড়ের বেলাভূমিকে বিশ্ববিবেকের নোনা জলে সিক্ত করেছে। এটা কোনো সভ্য সংস্কৃতির উদাহরণ নয়, মানবতা উচ্ছন্নে গেল বলে যারা আমাদের শিশুর মুখে বিষাক্ত ফিডিং ধরিয়ে দিচ্ছে ওরা অপসংস্কৃতির নরকের কীট।

‘হায়রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়’

ঘাতকের বুলেটে আহত মানুষ বা পশুর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধা যায়। কিন্তু যে ঘাতক ব্যাধি প্রতিনিয়ত বিনোদনের উছিলায় শ্বাস-প্রশ্বাসে হূদয়-মস্তিষ্ক অলক্ষে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তার প্রতিকার কী?

যান্ত্রিক সভ্যতার আবিষ্কারে পুরো পৃথিবী ছোট একটি রিমোট কন্ট্রোলের আন্ডারে বিজ্ঞানী ও সাম্রাজ্যবাদীরা চাইলে ওই রিমোট টিপে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

ওই রিমোট টিপলে কি না দেখি? বিদেশি চ্যানেলে- বেওয়াচ নামক বিদেশি অনুষ্ঠানে উপরে-নিচে মাত্র চার ইঞ্চি কাপড় পরে গোপন অঙ্গ প্রদর্শনের নির্লজ্জ সেক্স দেখানোর ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। ওই সি বিচেই একদল সেক্সি যুবক-যুবতী প্রায় উলঙ্গ দেহে সূর্যস্নানের উছিলায় নগ্ন দেহ দেখিয়ে নষ্টামির আহ্বান জানাচ্ছে। প্রতিদিন বিদেশি মেয়েদের রাগবি খেলা, রেসলিং, ইনজেকশন দিয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আমাদের কোমলমতি যুবক-যুবতীদের নষ্টামির তীব্র আহ্বান জানাচ্ছে। এটাই কি সাংস্কৃতিক সভ্যতা? এই সব ক্ষতিকারক কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য প্রতিনিয়ত আমরা দেখব কেন?

পার্শ্ববর্তী বন্ধু দেশের বেশ কয়েকটি হিন্দি ও বাংলা চ্যানেলে ভারতসহ বিশ্বের যৌবনবতী সুন্দরী আকর্ষণীয় ফিগার সমৃদ্ধ মেয়ে যারা মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স হয়েছে বা হয়নি ওই সেলিব্রেটিদের গোপন অঙ্গের সুড়সুড়ি প্রদর্শন আমাদের ৯০ ভাগ যুবক-যুবতীর চরিত্র হনন করছে। এটাই আকাশ অপসংস্কৃতির আগ্রাসন। সবার ঘরেই যুবক-যুবতী ছেলেমেয়ে আছে। ওদের এই অকাল ধ্বংস দেখে আমাদের আত্মা আঁতকে উঠে না? নাকি আমরা সবাই বিবেকের কবরে আত্মসমর্পণ করেছি?

কোথায় আমার রাখাল মাঝির কণ্ঠে উদাস করা ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি, আব্বাস উদ্দিন, হাছন রাজা আর লালনের আধ্যাত্মিক আত্মশুদ্ধির সুরের মূর্ছনা। আমার দোতরা তানপুরা আজ বিষাক্ত ধুলায় ধূসরিত আজ। টিভি খুলে প্রতিনিয়তই মধুর সুরে পবিত্র কোরআন, ত্রিপিটক, গীতা পাঠের হূদয় পবিত্র করা আহ্বান যতটুকু শুনি তারচেয়ে অনেক বেশি শুনি হূদয় মাতানো, মন ভোলানো ‘নাচ মেরি যাঁ ফাটাফাট’, ‘চুম্মা চুম্মা দে দে’, ‘চলিকা নিচে কেয়া হে’, ‘শিলাকি জওয়ানি’ উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে বিশেষ করে জি বাংলাসহ আরও অনেক চ্যানেলে আমাদের মা-বোনেরা ছেলে-মেয়েরা ঘরে বসে অত্যন্ত গ্লামারাস সেক্সি চেহারার পোশাক ও প্রায় উলঙ্গ সিনেমার নায়িকাদের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি ভুলতে বসেছে এবং গুরুজন ও মুরব্বিদের শ্রদ্ধা করতে ভুলে যাচ্ছে। আজ সভ্যতা ভব্যতা নির্বাসনের পথে। তাই তো সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বাহন চলচ্চিত্র আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এদেশের প্রায় ১৪০০ সিনেমা হল বন্ধ হতে হতে এখন মাত্র ২৫০-এ এসে ঠেকেছে। এর জন্য দায়ী চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট লোকেরা, সিনেমা হল মালিক এবং সরকার। যদিও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করেছেন, সিনেপ্লেক্স তৈরি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাকে ধন্যবাদ জানাই। শুধু ঘোষণা দিয়েই এ চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা করা যাবে না। সে জন্য চাই চলচ্চিত্র শিল্পের সব মানুষের সংস্কৃতি প্রেম ও সমন্বিত ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা।

গত রমজানে ‘স্টার জলসা চ্যানেলে’ ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’ সিরিয়ালে ‘হাম তোমহারি পাখি’ অনুষ্ঠানে পাখি নামক সালোয়ার-কামিজ ব্যবহার করত। ওই সালোয়ার-কামিজ বাজারে কিনতে না পেরে চারটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, দুইটি মেয়ে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে। এই অপসংস্কৃতির অভিশাপ থেকে যুব সমাজকে রক্ষার জন্য দুজন আইনবিদ ওই জি বাংলা চ্যানেল বন্ধের জন্য হাইকোর্টে মামলা করেন বিজ্ঞ দুজন বিচারক উক্ত পে চ্যানেল বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই আদেশ না মেনে চ্যানেল ব্যবসায়ী আজও তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। হায়রে দেশ হায়রে স্বাধীনতা।

কোথায় একাত্তরের মা জননী, মুক্তিসেনার দল। যাদের পবিত্র রক্তে অর্জিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা একুশে ফেব্রুয়ারি। যাদের সংগ্রামে ৬৬র শিক্ষানীতি বাতিল হয়। যাদের রক্ত ঘামে উত্থিত হয় ঊনসত্তরের গণআন্দোলন। যাদের আত্মত্যাগে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামী অংশগ্রহণে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ ও জাতীয় পতাকা। আজ কোথায় সেই ইতিহাস সৃষ্টি করা ছাত্র সেনার দল। 

আজ শিক্ষাঙ্গনগুলো শুধুই জ্ঞানের ভজনালয় নয়, ওখানে দখলদারি রাজনৈতিক মণ্ডপ ছাত্রবাসগুলো হয়েছে অস্ত্রের ভাণ্ডার।

কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভ্রাতৃবন্ধনে বোনেরা ঋদ্ধ হয় না, ধর্ষণের সেঞ্চুরিতে কলুষিত হয় শিক্ষাঙ্গন। ওরা আজ অপরাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার। ওদের রক্তে জ্ঞানের তাপস ফল্গু ছড়ায় না। ওদের ধমনিতে শিশিরের শব্দের মতো সন্ত্রাসের রক্তকণিকা ঢুকে গেছে। ওরা নষ্ট রাজনীতির শিকার। ওরা দলীয় অঙ্গ সংগঠনের সদস্য। ওরা মিছিলে যায়, মিটিংয়ে যায়, অস্ত্র হাতে ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করে বোমা ফাটায়। ভাইয়ের বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে। করে শত মায়ের বুক খালি। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল অতীত আজ কলঙ্কিত ধূসরিত। সমাজের চোখে ওরা অপরাধী। ওরা দখল করে হল, জমি, বসতভিটা, মসজিদ, মন্দির ও শ্মশানের স্থান। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? সমাজ, রাষ্ট্র এবং আমরা সবাই। কোনো সভ্য মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না। এসবই উন্মুক্ত অপসংস্কৃতির ফসল।

ধার করে ধনী হওয়া যায়। কিন্তু ধার করে জ্ঞানী হওয়া যায় না। বিদেশিদের অর্থে, অস্ত্রে, কুপরামর্শে নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক আসন দখল করা যায়। কিন্তু জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি আর গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দেওয়া যায় না।

সে জন্য চাই শিক্ষা, জ্ঞান, পরমত, সহিষ্ণুতা এবং ত্যাগের মহিমা। ইচ্ছা করলেই একজন ‘মাও সে তুং’, ‘মাহাথির মোহাম্মদ’, ‘নেলসন মেন্ডেলা’, ‘অমর্ত্য সেন’ বা ‘ড. মোহাম্মদ ইউনুস’ হওয়া যায় না। সে জন্য চাই মহান দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক দর্শন ও মহত্ আদর্শ।

আকাশকে উন্মুক্ত রেখে শতাধিক বিদেশি চ্যানেলে অপসংস্কৃতির অবাধ প্রদর্শনীর মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে সভ্য ও সমৃদ্ধির পথে নেওয়া যাবে না।

সময় থাকতে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি জাতীয় সংস্কৃতির যুদ্ধে জেগে উঠতে হবে। ঝড়, বন্যা, সুনামিতে ধ্বংস হওয়া জনপথ আবার নতুন করে গড়ে তোলা যায়। হাজার বছরের তিল তিল করে গড়ে উঠা জাতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হলে তাকে এক জনমে গড়ে তোলা যায় না।

তাই আসুন দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা করি। ৭১-এর মতো জাতীয় চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আর একটি যুদ্ধ করি। সব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ।

লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার, গীতিকবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সর্বশেষ খবর