শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

সত্যের সন্ধানে এক সাহাবি (রা.)

মুফতি আমজাদ হোসাইন

সত্যের সন্ধানে এক সাহাবি (রা.)

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সুরাতুল হজ্জ : ১০৭) তাফসিরে ইবনে আসাকিরে রয়েছে রসুল (সা.) বলেন, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমত। তাফসিরে ইবনে কাসিরে রয়েছে রসুল (সা.) বলেন, আমি আল্লহর প্রেরিত রহমত, যাতে (আল্লাহর আদেশ পালনকারী) এক সম্প্রদায়কে গৌরবের উচ্চাসনে আসীন করি এবং (আল্লাহর আদেশ অমান্যকারী) অপর সম্প্রদায়কে আল্লাহর আজাবের কথা শুনাই। বস্তুত সৃষ্টিগতভাবে মহান রাব্বুল আলামিন যাদেরকে দান করেছেন রহমত ও সত্য সন্ধানের প্রবল স্পৃহা, শত বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে যারা পেয়েছিলেন রহমত ও আলোর পথের দিশা, সেই তাওহিদের পিয়াসী সত্যের সন্ধানী অসংখ্য অগণিত সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে হজরত সালমান ফারসি (রা.) ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন পারস্য দেশের ইসফাহান নগরের নিকটস্থ এক গ্রামের জনৈক অগ্নিপূজারী বাসিন্দার নয়নমণি। পিতা যেহেতু আগুনের পূজা করত তাই ছেলেকে আগুন জ্বালানোরা কাজে নিয়োজিত করে নিজের কাছে আবদ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু সত্যসন্ধানী সালমানের মনে ইবাদতের তৃপ্তি কোনোভাবেই আসছিল না। সঠিক পথের দীক্ষা পাওয়ার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে পাগলের মতো ঘুরছিলেন। চষে বেড়ালেন মোসেল, নাছীবাইন, আমুরিয়াসহ প্রমুখ দেশসমূহে। অনেক খ্রিস্টান আলেমের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেন। পরিশেষে আমুরিয়া নামক এলাকার এক আলেম উনাকে উপদেশ দিলেন যে আরব দেশে দীনে ইব্রাহিমের অনুসারী এক নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তুমি যদি সত্যের সঠিক সন্ধান পেতে চাও অবশ্যই তাঁর সান্নিধ্য গ্রহণ করে তাঁর থেকে সঠিক পথের  শিক্ষা লাভ করবে। তিনিই হবেন শেষ নবী ও  শ্রেষ্ঠ নবী। তাঁর পরিচয় চারটি নিদর্শন দ্বারা তুমি জানতে পারবে। এক. নবুয়্যত প্রাপ্তির পর তিনি যে শহরে হিজরত করবেন সে শহরে অনেক বেশি খেজুর গাছ হবে। দুই. ছদকার (যাকাতের) মাল তিনি নিজের জন্য গ্রহণ করবেন না। তিন. হাদিয়ার মাল গ্রহণ করবেন। চার. তাঁর দুই কাঁধের মাঝে নবুওয়তের সীলমোহর থাকবে। এ কথাগুলো শ্রবণে সালমানের মনে আশার আলো উদিত হলো। মনে-প্রাণে প্লান করলেন কীভাবে পাওয়া যায় সেই রহমতের নবীকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এক বণিক দলের সঙ্গে রহমতের নবীর তালাশে বের হয়ে গেলেন আরব দেশের উদ্দেশ্যে। সমূহ বিপদাপদ পাড়ি দিয়ে মদিনার নিকটবর্তী স্থান ওয়াদিউল কুরা নামক এলাকায় এসে পৌঁছলেন। কিন্তু বণিক দল নিজেদের দাস বলে মদিনার  এক ইয়াহুদির নিকট তাকে বিক্রি করে দিল। এখানে খেজুর গাছের আধিক্য দেখে তাঁর বিশ্বাস জমলো যে, আখেরি নবী এদেশেই হিজরত করে আগমন করবেন।

কায়মনে ইয়াহুদি মনিবের সেবা করছেন আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন কর্ণকুহরে শুনতে পাবেন শেষ জামানার নবী এখানে হিজরত করতে এসেছেন। পরিশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। একদিন সালমানের মনিবের বাগানে এসে এক ব্যক্তি তাকে জানাল যে, আখেরি জামানার নবী মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে এসেছেন। তা শ্রবণে সালমানের আনন্দের সীমা রইল না। বাঁধভাঙা আনন্দের বন্যা যেন মনের কুঠরিতে বয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন আমুরিয়ার আলেমের উপদেশ অনুযায়ী চারটি বিষয়ের প্রথমটি তো পেয়ে গেলাম বাকি রইল তিনটি। এই তিনটিও যাচাই করতে হবে। আগ্রহী সালমান একে একে বাকি তিনটি যাচাই করার পর পবিত্র মোহরে নবুওয়ত দেখামাত্র সালমান নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না। ঝাঁপিয়ে পড়ে মোহরে নবুওয়তকে চুম্বন করতে লাগলেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন অত্যন্ত স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি কে বা তোমার পরিচয় কি? সালমান কাঁদতে কাঁদতে নিজের জীবনের সব  অশ্রুভেজা কাহিনী  খুলে বললেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন সব শুনে সালমানের ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং কালিমা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে নিলেন। কিন্তু হজরত সালমান ফারসি (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পরও স্বাধীন হতে পারেননি। কারণ তিনি তো এখনো এক ইয়াহুদির গোলাম রয়ে গেছেন।  রসুল (সা.) তাকে বললেন তোমার মনিবকে গোলামির মূল্য দিয়ে তুমি স্বাধীন হয়ে যাও। হজরত সালমান ফারসি (রা.) রসুল (সা.)-এর কথা অনুযায়ী তাঁর মনিবকে মুক্তির প্রস্তাব দিলে মনিব তিনশত খেজুর গাছের চারা লাগানো ও পাঁচ ছটাক স্বর্ণের শর্তে মুক্তির জন্য রাজি হলো। রসুল (সা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি সাহাবায়ে কেরামদের মাধ্যমে তিনশত চারা গাছের ব্যবস্থা করে স্বহস্তে গাছগুলো লাগিয়ে দিয়ে বাকি স্বর্ণগুলোও আদায় করে হজরত সালমান ফারসি (রা.)-কে গোলামির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আনলেন। হাদিসে এসেছে জান্নাত যাদের জন্য আগ্রহী তাদের মধ্যে হজরত সালমান ফারসি (রা.) অন্যতম। আমরাও যদি দীনি শিক্ষার জন্য বা দীন ইসলামকে পাওয়ার জন্য কোরবানি বা মুজাহাদা করি ইনশা আল্লাহ আমরাও সঠিক পথ ও শান্তির পথের দিশা পেয়ে যাব। পরকালে নেয়ামত বহুল জান্নাতে  আল্লাহর দিদার পাব। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে হজরত সালমান ফারসি (রা.)-এর মতো দীনের জন্য মুজাহাদা করার তাওফিক দান করুন।  আমিন।

     লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর