শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

ক্ষমাশীলতা একটি বড় গুণ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ক্ষমাশীলতা একটি বড় গুণ

ক্ষমা করতে পারার রেওয়াজ শেখায় ধর্ম। মহান আল্লাহর সহস্র গুণের এটি একটি। যে আত্মায় ক্ষমা করার গুণটি থাকে সে আত্মা পুরস্কৃত হয় খোদার দরবারে। যখন মানুষ খোদাকে ভুলে পাপ সাগরের উত্তাল তরঙ্গে ডুবতে থাকে, প্রভু তখন নিজ করুণায় মানুষের মধ্য থেকেই প্রিয় বান্দা নির্বাচন করেন। যার হৃদয় কোমল, ব্যবহার নম্র, ক্ষমা যার অভ্যাস আল্লাহ তাকেই নবী হিসেবে মনোনীত করেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ছিলেন ক্ষমার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহতায়ালা নিজ অনুগ্রহে তার হাবিবকে মায়া-মমতা-ক্ষমাসুলভ চারিত্রিক গুণ দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহম্মাদ! এটা আল্লাহর দয়া যে, তুমি তাদের প্রতি কোমল। তুমি যদি তাদের প্রতি কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার চারপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদের অন্যায় আচরণ ক্ষমা করে দাও এবং আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ (সুরা আল ইমরান : ১৫৯।) আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে রসুল (সা.) কে আত্মসংশোধনমূলক ক্ষমা শিখিয়েছেন। অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া সহজ কিন্তু তার জন্য প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা অনেকেই অপরাধীকে ক্ষমা করে দিই ঠিক কিন্তু আল্লাহর কাছে তার বিচার দাবি করি। উন্নত হৃদয়বৃত্তের অধিকারী ছাড়া অপরাধীকে ক্ষমা করে তার জন্য মহান প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্ভব নয়। রসুল (সা.)-এর এমন মহান দরদী হৃদয় ছিল বলেই মানুষ তার চারপাশে ভিড় করেছিল। রসুলের (সা.) একান্ত সেবক হজরত আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, আমি দীর্ঘ ১০ বছর রসুলের (সা.)-এর খাদেম ছিলাম। তিনি কখনো আমাকে বিরক্ত হয়ে ‘উহ’ বলেননি। কোনো করণীয় কাজ না করলে অথবা অপ্রয়োজনীয় কাজ করে ফেললে ধমক তো দূরের কথা ‘এমনটি কেন করলে’— এ কথাও জিজ্ঞেস করেননি। (বুখারি ও মুসলিম।) রসুল (সা.)-এর উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘(নবী হে!) নিশ্চয়ই আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলম : ৪।)

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রসুল (সা.) কখনো কোনো খাদেম-দাসকে মারেননি। কোনো স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেননি। এমনকি জিহাদের ময়দান ছাড়া কোনো মানুষকে আঘাতও করেননি। দুটি বিষয় থেকে একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিলে তিনি তুলনামূলক সহজটি গ্রহণ করতেন। ব্যক্তিগত কারণে কখনো তিনি কারও থেকে প্রতিশোধ নেননি। (মুসনাদে আহমাদ।) রসুল (সা.)-এর ক্ষমা ও উদারতা সম্পর্কে সিরাতে ইবনে হিশাম থেকে একটি ঘটনা বলছি। খয়বরে ইহুদিদের শোচনীয় পরাজয়ের পর জয়নব বিনতে তাহারাত, সম্ভ্রান্ত ইহুদি রমণী ভেড়ার গোশত রান্না করে রসুল (সা.)-কে দাওয়াত করেন। রসুল (সা.) এবং বিশর বিন বারা (রা.) খাওয়া শুরু করলেন। খাবার মুখে দিয়েই রসুল বিষক্রিয়া বুঝতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে খাবার ফেলে দিলেন। বিশর (রা.) কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছটফট করে মারা গেলেন। ধারণা করা হয় এটা খুব শক্তিশালী বিষ ছিল। আর রাহিকুল মাখতু এবং আল বিদায়া ওয়ান নেহায়াসহ প্রায় সব সিরাত প্রণেতা লিখেছেন— এ ঘটনার তিন বছর পরও রসুল (সা.) মৃত্যুর সময় এ বিষের তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন। এ ঘটনার পর সাহাবিরা মহিলাকে গ্রেফতার করে রসুল (সা.)-এর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকলেন। আদেশ পাওয়া মাত্রই নবী হত্যা চেষ্টার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে মহিলার।

রসুল (সা.) মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, জয়নব! তুমি কি আমাকে হত্যার জন্য এমনটি করেছ? মহিলা বলল, হ্যাঁ। রসুল (সা.) বললেন, কেন করেছ? মহিলা বলল, আপনি যদি রাজা বা বাদশাহ হন তবে এ বিষে মারা যাবেন। আমরা আপনার থেকে মুক্তি পাব। আর যদি নবী হন তবে আল্লাহ আপনাকে বিষের কথা জানিয়ে দেবেন। রসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমাকে আমার ওপর বিজয়ী কিংবা আমাকে হত্যা করার শক্তি দেননি। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠল, হে আল্লাহর রসুল (সা.) আমরা কি তাকে হত্যা করব না? রসুল (সা.) বললেন, না। তাকে ছেড়ে দাও।

বিশ্বব্যাপী আজকের মুসলমানদের অধঃপতনের অন্যতম কারণ তারা ক্ষমার আদর্শ ভুলে গেছে। ব্যক্তি জীবন থেকে আন্তর্জাতিক মহলে মুসলমানরা ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার বদলে প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে। ধার্মিকরা অধার্মিকদের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ অধার্মিকদের প্রেম ও ক্ষমার মাধ্যমে প্রভুর পথে ফিরিয়ে আনাই ছিল প্রকৃত ধার্মিকের প্রধান দায়িত্ব। খোদার বান্দাকে খোদার পথে না এনে কাফের-ফাসেক বলে যে দূরে সরিয়ে দেয় সে প্রকৃত ধার্মিক নয়। ধর্ম কি জিনিস তা সে জানতে পারেনি। হতে পারে সে বড় আলেম, জাকের, আবেদ, পীর কিন্তু সে ধার্মিক নয়, মুসলিম নয়। ডা. লুত্ফর রহমান বলেন, ‘যে ধার্মিক অহঙ্কারবশত বেনামাজি বা পাপী অবোধকে ঘৃণা করে— তাকে ধার্মিক বলা যায় না। ধার্মিকের প্রাণে প্রাণীর জন্য দরদ থাকা চাই।’ মহান আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করার গুণ দান করুন এবং সৃষ্টি জীবের প্রতি দরদী হওয়ার তাওফিক দান করুন।  আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর