সোমবার, ৭ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা

আমির হোসেন

সাতই মার্চ, ১৯৭১ সকাল থেকেই মুক্তিকামী মানুষের স্রোত আছড়ে পড়ছিল রেসকোর্সে। বেলা যতই বাড়ছিল, ততই বেড়ে চলছিল জনতার কলেবর। দুপুরে রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। অনেকের হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা, কুড়াল, রামদা, এমনকি দু-একজনের হাতে রাইফেল। কী ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতিকে দেন মুক্তির কোন পথনির্দেশ, তাই শুনতে নগরী উজাড় করে এসেছে সব বয়সের, সব পেশার, সব স্তরের মানুষ। স্বামীর সঙ্গে এসেছে কুলবধূ, তরুণ-কিশোরের হাত ধরে এসেছে প্রৌঢ়া জননী বা বৃদ্ধা দাদি। দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছে কারখানার শ্রমিক, ক্ষেতের চাষি, অফিসের কর্মচারী, ছাত্র-যুবক, সাধারণ মানুষ। চোখে-মুখে তাদের মুক্তি স্বপ্ন, কণ্ঠে কণ্ঠে শত্রুর বুক কাঁপানো ধ্বনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।

নির্ধারিত সময় বেলা ২টার বেশ কিছু পরে বঙ্গবন্ধু পৌঁছলেন রেসকোর্সের বক্তৃতামঞ্চে। ইতিহাস সেখানে থমকে আছে যুগনায়ক শেখ মুজিবের হাতে নতুনভাবে আবর্তিত হওয়ার আকুল প্রতীক্ষায়। দশ লক্ষাধিক মানুষের গগনবিদারী স্লোগানের মধ্যে বঙ্গবন্ধু দুই হাত তুলে জনতাকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানালেন। মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর আগেই বঙ্গবন্ধু শুনলেন রেসকোর্সের জনসমুদ্রের রায় : ‘সব কথার শেষ কথা- বাংলাদেশের স্বাধীনতা।’ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন, এটাই ছিল জনতার প্রত্যাশা। এটাই ছিল দাবি।

কিন্তু না। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না বঙ্গবন্ধু। সামান্য অসতর্কতার জন্য যাতে গোটা জাতির এই বিরাট অভ্যুত্থান, এই জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সাফল্য বিঘ্নিত বা ব্যাহত না হয়, তারই জন্য বঙ্গবন্ধু নিলেন এক সর্বজন প্রশংসিত, সময়োচিত রাজনৈতিক কৌশল। একদিকে তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংকট উত্তরণের উপায় হিসেবে আলোচনার পথ খোলা রাখলেন, অপরদিকে দিলেন স্বাধীনতা আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথনির্দেশ। রেসকোর্সের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্নে চারটি শর্ত আরোপ করে বলেন, ‘(১) সামরিক আইন তুলে নিতে হবে, (২) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, (৩) সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং (৪) অবিলম্বে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর ভেবে দেখবো অ্যাসেম্বলিতে যাব কি-না।’

সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জনতার প্রতি নির্দেশ দেন, ‘লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’ চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতির ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের ওপর আমার নির্দেশ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ মুক্তিকামী বাঙালির চিরঞ্জীব স্বপ্ন বাস্তবায়নের দুর্জয় প্রতিজ্ঞায় সাড়ে সাত কোটি বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরকে নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

নেতার কণ্ঠ তলিয়ে গেল জনতার সমস্বর স্লোগানে। উপরে বাংলার উদার আকাশ, নিচে রমনার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মুক্তির অধীর আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল, উত্তাল জনসমুদ্র। মঞ্চের পাশে বাতাসে উড়ছে বাংলাদেশের নতুন পতাকা। বসন্তের শেষ বিকালে সোনালি সূর্য যখন রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে— যেন বিধাতার আশীর্বাদ। ‘আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। জয় বাংলা।’ বাংলার আকাশ-বাতাস আর ১০ লাখ মানুষকে সাক্ষী রেখে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আত্মদানের এই পবিত্র অঙ্গীকারের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শেষ করেন।

এই ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা রিপোর্ট করার দুর্লভ সুযোগ যেসব সাংবাদিকের হয় তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কভার করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে শুনতে, তার সেই বিপ্লবী রূপ দেখে শুধুই অভিভূত হয়েছি। মুখোমুখি হয়েছি নিজেরই প্রশ্নের : এ কোন শেখ মুজিব? কত অসংখ্য জনসভায় তাকে বক্তৃতা করতে দেখেছি, কতদিন কত বক্তৃতা তার শুনেছি, রিপোর্ট করেছি। কিন্তু ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই রুদ্ররূপ আর কোনোদিন দেখিনি, কোনোদিন শুনিনি তার এমন তেজোদৃপ্ত ভাষণ। এমন অপরূপ রূপে আবির্ভূত হওয়ার, এমন অমোঘ বাণী নিয়ে আত্মপ্রকাশের সুযোগ ইতিহাস এক একজন যুগনায়ককে বোধ হয় এমনিভাবে একবারই দেয়। একদিনই দেয়। বঙ্গবন্ধুর জন্য এই দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ।

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেদিন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে স্বাধীনতাকে জাতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে প্রকাশ্য ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি এটাও দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি বা তার সহকর্মীরা যদি আর কোনো নির্দেশ দিতে না পারেন, তবু বাংলাদেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। ওদের (পাকিস্তানি সৈন্যদের) ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। এসব কথা বলার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামেরই দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা চলে আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত ‘গ্যাটিসবার্গ এ্যাডরেস’-এর সঙ্গে। ‘গ্যাটিসবার্গ এ্যাডরেস’-এর বিবরণ বই-পুস্তকে পড়েছি। রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছি একেবারে কাছে বসে। আমাদের জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই ভাষণ ছিল আব্রাহাম লিংকনের সেই ভাষণের মতোই ঐতিহাসিক এবং সম্ভবত তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ। ভাব, ভাষা, আবেগ ও ওজস্বিতায় অনন্য এবং রাজনৈতিক তাত্পর্যের দিক থেকে অতুলনীয় ৭ মার্চের এই ভাষণটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। এই ভাষণে তিনি যা বলেছেন তার সামান্য হেরফের হলে বাঙালি জাতির ইতিহাসই অন্যভাবে লিখিত হতো। দেশবাসী তখন তার কাছে স্বাধীনতার ডাক প্রত্যাশা করছিল। বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন তার ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ না বলতেন তাহলে মানুষের মনে ভয়ঙ্কর হতাশার সৃষ্টি হতো এবং সম্ভবত ওইদিন রেসকোর্স ময়দানেই ‘জনগণমন অধিনায়ক’ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সমাধি রচিত হতো। অপরদিকে তিনি যদি সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে হয়তো সেই মুহূর্তেই রেসকোর্সে আর্মি অপারেশন চালিয়ে পাইকারি গণহত্যার সূচনা করা হতো। রেসকোর্সকে পরিণত করা হতো বধ্যভূমিতে। আর একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হতো বঙ্গবন্ধুকে।

তাই অনিবার্য সংঘাত যতটা সম্ভব বিলম্বিত করে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় করে নেওয়ার জন্যই বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর কথা বলে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ধ্বনি তোলেন এবং ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তুলে ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এটা ছিল আসলে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণেরই সুস্পষ্ট নির্দেশ। আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতির স্বাধিকার সংগ্রাম রূপান্তরিত হয় স্বাধীনতার সংগ্রামে।

লেখক : ডেইলি সান-এর উপদেষ্টা সম্পাদক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর