শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্বপ্নগুলো যেন হারিয়ে না যায়

প্রভাষ আমিন

স্বপ্নগুলো যেন হারিয়ে না যায়

ছেলেটি চুপচাপ থাকত। হৃদয়জুড়ে রাজ্যের অভিমান। সেই অভিমান থেকেই কবিতা লিখত। ভালোবাসত ক্রিকেট। বাংলাদেশ বলতেই অজ্ঞান। ছেলেটির মা কবিতা-ক্রিকেট বুঝতেন না। তার সব ধ্যান-জ্ঞান ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তিনি সারাক্ষণ ছেলেকে বকাঝকা করেন পড়াশোনার জন্য। এসব নিয়ে ছেলেটির অভিমান আরও তীব্র হয়। ছেলেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মা ছেলের জন্মদিনটিও ভুলে যান। অভিমানে ছেলেটি কান্নায় বুক ভাসায়।  এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা। দারুণ খেলে জিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু মা তবুও পড়াশোনার জন্যই চাপ দেন। কেন তিনি বাংলাদেশের জয়ে উল্লসিত নন, কেন হাততালি দিচ্ছেন না— এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে তর্ক বাধে ছেলেটির। মায়ের হাতে অনেক কাজ। খেলা নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। এ নিয়ে বকা দেন ছেলেকে। এবার ছেলের অভিমান বাঁধ ভেঙে যায়। বাংলাদেশের জয় যাকে উল্লসিত করে না, তার সঙ্গে আর থাকার কোনো মানে হয় না। বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। চলে যায় ধানমন্ডি লেকে। মায়ের প্রতি তীব্র অভিমানে ভেসে যাচ্ছে বুক। আস্তে আস্তে লেকের পানিতে নেমে যায় ছেলেটি। চোখের জল আর লেকের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আস্তে আস্তে অতল জলে হারিয়ে যায় ছেলেটি।

এই হলো আমাদের অভিমানী অর্জুনের গল্প। পুরো নাম সুদীপ্ত দত্ত অর্জুন। এবার তার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। অর্জুনের বাবা অসীম কুমার দত্ত কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমাদের সন্তানের ইমোশনটা আমরা বুঝতে পারিনি। নিজেদের খুব ব্যর্থ মনে হচ্ছে। মামলা করবেন কিনা জানতে চাইলে অসীম দত্ত বলেন, কার বিরুদ্ধে মামলা করব। করলে তো নিজের বিরুদ্ধেই মামলা করতে হবে। অসহায় এই পিতার হাহাকার আমার বুকে বিঁধেছে। গভীর বেদনায় আর্দ্র হয়ে যায় আমার হৃদয়।

অর্জুনের মা ছন্দা দত্ত নিশ্চয়ই ছেলের ভালো চাইতেন। বনশ্রীর অরনী আর আলভীর মা মাহফুজা মালেক জেসমিনও নিশ্চয়ই তার সন্তানদের ভালোবাসতেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা ছিল তার মধ্যে। এখনো পুরো রহস্যটা আমরা জানি না। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় উদ্বিগ্ন হয়েই মাহফুজা তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন। এ দুটি ঘটনাই আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। আমরা কি আমাদের সন্তানদের নিয়ে বেশি ভেবে ভেবে নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছি? আমরা কি সন্তানদের মনের কথা না বুঝে ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেবে তাদের বর্তমানকে অন্ধকার করে ফেলছি? আমরা কি বুঝে না বুঝে তাদের মেরে ফেলছি বা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি?

অর্জুন পড়ত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজে। অরনী পড়ত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। আর আলভী পড়ত হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে। তিনটিই দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন প্রতিষ্ঠানে চান্স পাওয়াটাই কঠিন। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়েও বাবা-মাদের এত উদ্বেগ কেন? দেশের লাখ লাখ শিশু-কিশোর তো স্কুলে যাওয়ারই সুযোগ পায় না, ভালো স্কুল তো অনেক পরের কথা। কিন্তু আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা নিজেরা অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগী। সেই নিরাপত্তাহীনতার বোধ ছড়িয়ে দিই সন্তানের ওপর। আমরা নিজেদের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে চাই সন্তানের মাধ্যমে। নিজেরা যা হতে পারিনি, তা বানাতে চাই সন্তানকে। কিন্তু আমরা বুঝতে চাই না, প্রতিটি মানুষ আলাদা, মানুষের পছন্দ আলাদা। ছন্দা দত্তের কাছে ক্রিকেট মানে সময় নষ্ট, অর্জুন দত্তের কাছে ক্রিকেট মানেই জীবন। এই গ্যাপ আমরা কমাতে পারি না। বরং তা বাড়তে বাড়তে এমন দূরত্ব তৈরি করে, সন্তান হয়ে যায় অচেনা। আমরা বুঝতে চাই না, সময় বদলে গেছে। আমরা আমাদের ছেলেবেলার সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের সন্তানদের বড় করতে চাই। আগে সন্তানকে স্কুলে দেওয়ার সময় অভিভাবকরা শিক্ষকদের বলতেন, মাংসগুলো আপনার, হাড্ডিগুলো আমার। তখন যত কড়া, তত ভালো শিক্ষক। কোন শিক্ষক কয়টা বেত মারেন, মারতে মারতে কে বেত ভেঙে ফেলেন, কোন শিক্ষক ডাস্টার ছুড়ে মারেন, কোন শিক্ষক মাথায় গাট্টা মারেন, কোন শিক্ষক কত সৃজনশীলভাবে শাস্তি দিতে পারেন; সেটাই ছিল মানদণ্ড। এখন যুগ পাল্টে গেছে। শারীরিক শাস্তি তো দূরের কথা মানসিক নির্যাতনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আমরা কিন্তু ঘরে সন্তানের ওপর নির্যাতন চালিয়েই যাচ্ছি। তোমাকে কিন্তু এই হতে হবে, সেই হতে হবে, অমুকের রেজাল্ট কেন তোমার চেয়ে ভালো হলো, তোমাকে তো আমরা সবই দিচ্ছি— এমনতর হাজার প্রশ্ন প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে আমাদের সন্তানদের শৈশব, কৈশোর। আমরা বুঝতে চাই না, জানতেও চাই না; আমার সন্তান কী ভালোবাসে, তার কী পছন্দ। স্কুল-কোচিং-পরীক্ষায় আমরা সন্তানের পুরো সময়টা ঠেসে দিই। সেখানে গান নেই, কবিতা নেই, খেলা নেই, বই নেই; আছে শুধু অনন্ত চাপ।

আপনি নিশ্চয়ই আপনার সন্তানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ভালোবাসা আপনার সন্তান নিতে পারছে কিনা, তাতে তার ভালো হচ্ছে কিনা, সেটা একটু ভেবে দেখুন আগে। শুধু ভালো স্কুলে ভর্তি করলে, ভালো শিক্ষকের কাছে পড়ালে, ভালো বাসায় রাখলে, ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়ালেই ভালোবাসা হয় না। সন্তান কী চায়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। তাকে ভালোবাসতে হবে তার মতো করে। তেমন শিক্ষা দিন, যাতে আপনার সন্তান ভালো-মন্দের পার্থক্যটা ধরতে পারে; তাহলে আর তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে হবে না। সন্তানের ওপর আস্থা রাখুন, তাকে বিশ্বাস করুন। তার ভালোলাগার জায়গাগুলো বের করুন, তার শক্তির জায়গাটা জাগিয়ে দিন। সব শিশুর মেধা এক রকম নয়। সবাই ভালো রেজাল্ট করবে না। কেউ অঙ্কে ভালো, কেউ ইংরেজিতে ভালো, কেউ খেলায় ভালো, কেউ ভালো গায়, কেউ ভালো আঁকে। যার যেটা ভালো লাগে, তাকে সেটাই করতে দিন। শুধু জিপিএ-৫ এই জীবনের সার্থকতা নয়। জিপিএ-৫ এর পেছনে ছোটাতে গিয়ে সন্তানের শৈশব-কৈশোর, বর্তমান-ভবিষ্যৎ ধ্বংস করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি আপনার সন্তানের ওপর নজর রাখবেন। সে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কেমন পড়াশোনা করছে। কিন্তু সেটা যেন গোয়েন্দাগিরি না হয়। সে যেন বুঝতে না পারে, আপনি তাকে অবিশ্বাস করছেন, সন্দেহ করছেন।

প্লিজ আপনার স্বপ্ন আপনার সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। তাকে তার মতো স্বপ্ন দেখতে দিন। সে যাতে বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, সে ব্যাপারে তাকে অনুপ্রেরণা দিন। সন্তানদের নিয়ে আনিসুল হকের অনুবাদে কাহলিল জিবরানের কবিতার কয়েক লাইন

‘তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।

জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।

তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।

এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।

তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,

কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।

তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।’

তাদের ওপর আমাদের স্বপ্ন চাপিয়ে দেব না। কিন্তু সন্তানদের ঘিরেই আমাদের সব স্বপ্ন। তাদের সাফল্যে আমাদের আনন্দ, তাদের কৃতিত্বেই আমাদের গর্ব।  আমাদের সেই স্বপ্নগুলো যেন অর্জুনের মতো, অরনীর মতো, আলভীর মতো হারিয়ে না যায়।

লেখক : সাংবাদিক

 ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর