শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশনা

মাওলানা মুহাম্মাদ মিজানুর রহমান, সিনিয়র পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। এসব নিয়ামতের মধ্যে সুসন্তান হচ্ছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে— আল্লাহ তোমাদের থেকেই তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের যুগল হতে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছেন। তবুও কি তারা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে এবং তারা কি আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? (সূরা নাহল, ১৬ঃ৭২)।

আল্লামা শাওকানী (র.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, এ আয়াতের মর্ম হলো, আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজস্ব প্রজাতির মধ্য থেকেই জোড়া বানিয়েছেন— যেন তোমরা তার সঙ্গে অন্তরের সম্পর্কের ভিত্তিতে মিলিত হতে পার। কেননা, প্রত্যেক প্রজাতিই তার স্বজাতির প্রতি মনের আকর্ষণ বোধ করে। আর ভিন্ন প্রজাতির প্রতি তার মনে অনুরূপ আকর্ষণ থাকে না। মনের আকর্ষণ ও বিশেষ সম্পর্কের কারণেই বংশ বৃদ্ধি হয়ে থাকে।

আল্লামা আলূসী (র.) তার তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ধনসম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায় আর সন্তান-সন্ততি হচ্ছে বংশ তথা মানব প্রজাতি রক্ষার উপায়।

সন্তান জন্মের পরপরই পিতামাতার ওপর তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের কতগুলো হক বা অধিকার কার্যকর হতে থাকে এবং তখন থেকেই সে হক অনুযায়ী আমল করা পিতা-মাতার কর্তব্য হয়ে যায়। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন— ‘পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের হক বা অধিকার হচ্ছে প্রথমত তিনটি : এক. জন্মের পরপরই তার জন্য একটি উত্তম নাম রাখা। দুই. জ্ঞানবুদ্ধি হলে তাকে কোরআন তথা দীন শিক্ষা দেওয়া। তিন. প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার বিয়ের ব্যবস্থা করা।

নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন— ‘পিতা-মাতা সন্তানকে ভালো আদব-কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা উত্তম কিছু উপহার দিতে পারে না।’

শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধার। কাজেই আদর্শ সমাজ ও উন্নত পরিবেশ গঠন করতে হলে শিশুরা কেমন করে উন্নত চরিত্র এবং অনুপম আদর্শের অধিকারী হতে পারে সে বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। কেননা, শিশুদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে না পারলে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। যদি কারও আখলাক-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায় তবে এর কারণে সে নিজেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং এ ক্ষতির প্রভাব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সব কিছু পরিব্যাপ্ত হয়ে উপরোক্ত ক্ষেত্রসমূহে বিরাট অকল্যাণ ডেকে আনে। কাজেই শিশুর চরিত্র গঠনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সদা সচেতন থাকা আবশ্যক। কোরআন ও হাদিসে শিশুদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে জোর তাগিদ রয়েছে। চরিত্র গঠন বলতে তাদের মধ্যে আখলাকে জমিমা তথা দুষ্টু চরিত্রের প্রতি ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি করা এবং আখলাকে হামিদা তথা উন্নত চরিত্র মাধুরীর দ্বারা তাদের বিভূষিত করা বুঝায়। সন্তান-সন্ততিকে চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য একদিকে পিতা-মাতা যেমনভাবে সচেষ্ট থাকবেন এর পাশাপাশি তারা এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া করবেন। কেননা, আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের চেষ্টা কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না। কোরআন মাজিদে পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সূরা ফোরকানে আল্লাহর নেক বান্দাদের অন্যান্য গুণের সঙ্গে এ গুণটির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে— ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর যারা আমাদের জন্য হয় নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদের মুত্তাকীদের জন্য ইমাম বানিয়ে দাও। (সূরা ফুরকান, ২৫ঃ৭৪)। শিশুরা পিতা-মাতার কাছ থেকে জাগতিক ও নৈতিক শিক্ষালাভের সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি তাদের রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। এ অধিকার ইসলামে স্বীকৃত ও সুরক্ষিত। কাজেই পিতা-মাতা কোনো অবস্থাতে সন্তান হত্যা করতে পারবে না। এমনকি চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও নয়। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে— তোমরা তোমাদের সন্তানদের দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা কর না। তাদেরও আমিই রিজিক দিই এবং তোমাদেরও। তাদের হত্যা করা মহাপাপ। (সূরা বনী ইসরাইল ১৭ঃ৩১)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে— যারা নির্বুদ্ধিতার দরুন ও অজ্ঞানবশত নিজেদের সন্তানদের হত্যা করে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (সূরা আনআম ৬ঃ১৪০)। আরও ইরশাদ হয়েছে— যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? (সূরা তাকবীর ৮১ঃ৮-৯)। আল্লাহতায়ালা রসুলুল্লাহ (সা.)-কে নারীদের বায়য়াত গ্রহণকালে তাদের থেকে যেসব বিষয়ে শপথ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন তন্মধ্যে একটি ছিল সন্তান হত্যা না করা। ইসলামী শরিয়াতে শিশুর জীবন রক্ষায় পিতা-মাতার দায়িত্ব অপরিসীম। শিশু পিতা-মাতার কাছে এক পবিত্র আমানত। এ আমানত সম্পর্কে তারা অচিরেই জিজ্ঞাসিত হবে যদি পিতা-মাতা শিশুদের প্রতিপালনে মনোযোগী না হয়, তবে অবশ্যই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে— রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন— ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং প্রত্যেকেই আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। প্রতিটি মানুষ তার পরিবার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববান। তাকে এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদ ও সন্তানের ব্যাপারে দায়িত্ববান। সে এসবের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। মোট কথা, আল্লাহতায়ালা সবার জন্য তাদের সন্তান হত্যা হারাম করে দিয়েছেন।

বর্তমান সমাজে আশঙ্কাজনকহারে শিশু সন্তান হত্যা বেড়ে চলছে। এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের সবাইকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।  যারা শিশু হত্যা ও মানুষ হত্যার মতো অপরাধ করে চলছে তাদের প্রশাসনিকভাবে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সামাজিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর