সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

আমাদের গৌরবোজ্জ্বল রাজনীতি ও যুব সমাজ

মোস্তফা মোহসিন মন্টু

আমাদের গৌরবোজ্জ্বল রাজনীতি ও যুব সমাজ

গণমানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া বিশ্বের কোথাও কখনোই কোনো সংগ্রাম, সংস্কার বা বিপ্লব সম্ভব হয়নি। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এদেশের যুবসমাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সিপাহি বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ দেশের যুব সমাজই এগিয়ে এসেছে। তিতুমীর থেকে শুরু করে মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা প্রত্যেকেই ইতিহাসের বর্ণোজ্জ্বল বিশেষ্য পদবাচ্য। শুধু তাই নয় দেশ বিভাগের পর সদ্যলব্ধ পাকিস্তানে প্রথমেই পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী আঘাত হানে বাঙালির সংস্কৃতি তথা ভাষার ওপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার ভাষা ‘বাংলার’ পরিবর্তে ‘উর্দু’কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে প্রথমেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলার ছাত্র তথা যুবসমাজ। ক্রমান্বয়ে সম্পৃক্ততা বাড়ে জনমানুষের। কেবল ভাষাই নয়, পশ্চিমাদের শোষণ ও নিপীড়নমূলক বিভিন্ন কার্যকলাপ ও অর্ডিন্যান্স জারির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার হয় এদেশের ছাত্র সমাজ। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল, আর রাজনৈতিক দলসমূহ সংগঠিত করতে থাকে এদেশের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ও সংগঠনকে। তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের সম্পৃক্ততা পেতে ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সেদিন পালন করেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাদেরই কীর্তিময় গৌরবগাথা স্বর্ণোজ্জ্বলে লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়।

সেদিন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় সব পেশাজীবী মানুষ ও সংগঠন সব ধরনের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ছিল দুর্বার। প্রতিবাদ প্রতিরোধে ছিল দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। সেদিন প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্র ও যুবসমাজ ভ্যানগার্ডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সৃষ্টি করে ইতিহাসে নতুন ধারা। বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ঘটলেও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বৈরতান্ত্রিক হস্তক্ষেপে গণতান্ত্রিক জয়যাত্রাকে ব্যাহত করা হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে শুরু হয় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। বিভিন্ন শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে চলতে থাকে ক্রমাগত আন্দোলন। হামিদ খান প্রণীত কুখ্যাত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে নতুন করে সংগঠিত হতে থাকে ছাত্রসমাজ। শুরু হয় শিক্ষা আন্দোলন। গণতন্ত্র পুুনরুদ্ধার আন্দোলন। বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিক আন্দোলনের রেশ ধরেই পরবর্তীতে ছয় দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন-গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করলে সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থানের। স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত করা হয় বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে। আদায় করা হয় ৭০-এর নির্বাচন।

সমগ্র বাঙালি জাতি এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও ৬ দফার পক্ষে অভূতপূর্ব রায় দেয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাঙালিরা বিজয়ী হলেও ক্ষমতার প্রশ্নে টালবাহানা শুরু করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। গণতন্ত্রের জয়যাত্রাকে ব্যাহতকরণই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। অ্যাসেম্বলি কল করা সত্ত্বেও, বারবার তা বন্ধ ঘোষণা সমগ্র বাঙালি জাতিকে করে তুলেছিল ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত। এরই মধ্যে সামরিক বাহিনী, পুলিশ, তদানীন্তন ইপিআরসহ সর্বস্তরের বাঙালি সরকারি অফিসারের সঙ্গে বিমতাসুলভ আচরণ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ, দেশব্যাপী উর্দুভাষী মানুষগুলো সাধারণ মানুষদের সঙ্গে করছিল বৈষম্য ও হিংস্রতামূলক আচরণ, সর্বোপরি ঢাকায় এসে আলোচনার নামে ইয়াহিয়া-ভুট্টোগংদের সময়ক্ষেপণ আর ওদিকে গোপনে চলছিল বাঙালি নিধনের সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র।

অগ্নিঝরা উত্তাল মার্চ। দেশব্যাপী অস্থিরতা বিরাজমান। টানটান উত্তেজনা সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল তখন আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার মতো বিস্ফোরন্মুখ। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হলো পল্টনে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরই মধ্যে ঘনিয়ে এলো ৭ মার্চ। রমনার রেসকোর্স থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিব ঘোষণা দিলেন-‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। সে এক অবিশ্বাস্য বাংলাদেশ! বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সর্বত্রই চলছে অসহযোগিতা। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের গভর্নরকে শপথবাক্যও পাঠ করাননি প্রধান বিচারপতি। গভর্নর হাউসও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। পুরো পূর্ব বাংলাতেই চলছে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত অসহযোগ। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেল পূর্ব বাংলার এক অপূর্ব রূপ!

আলোচনা চলছে। আর অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্রের সমাহার ও ভাণ্ডার গড়া হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টগুলোতে। ষড়যন্ত্র টের পেয়ে ছাত্র-যুবারাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, ঢাকার কেরানীগঞ্জসহ দেশের সর্বত্রই শুরু করল ট্রেনিং-দেশমাতৃকার রক্ষার সুকঠিন ব্রতে। ঘনিয়ে এলো ২৫ মার্চ। সবার অগোচরে ইয়াহিয়া ভুট্টো রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল। নির্দেশ দিয়ে গেল গণহত্যার- যা ইতিহাসে অপারেশন সার্চ লাইট নামে পরিচিত।

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এদেশের ছাত্র-যু্বক, কৃষক-শ্রমিক, মেহেনতি জনতাসহ সর্বস্তরের আপামর জনসাধারণ রুখে দাঁড়াল সশস্ত্র পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।

দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী বাংকারে-বাংকারে যুদ্ধ করে, এক সাগর রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি ছিনিয়ে আনে তার স্বাধীনতাকে। বিশ্ব মানচিত্রে সৃষ্টি হলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। নাম বাংলাদেশ।

১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। সামনে অনেক কাজ। দেশ পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন। ড. কামাল হোসেনকে দেওয়া হলো জ্বালানি, খনিজ ও পেট্রোলিয়াম ও আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যানের গুরু দায়িত্বও অর্পিত হলো তার ওপর। খুবই স্বল্প সময়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন করলেন ড. কামাল হোসেন। অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এরপর বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে দায়িত্ব দিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও। তিনি জাতিসংঘ, ওআইসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় সদস্যপদ গ্রহণসহ একশরও অধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ড. কামাল হোসেন। আন্তর্জাতিক ঈড়হহবপঃরারঃু তৈরির মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে যখন একটি নতুন রাষ্ট্রের শুভ যাত্রা শুরু হলো; ঠিক তখনি সাম্রাজ্যবাদ ও ৭১-এর পরাজিত শক্তি সপরিবারে হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে। স্থগিত হলো সংবিধান। গণতন্ত্রের রথযাত্রা থমকে দাঁড়াল। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের খড়গ নেমে এলো পুুনর্বার বাঙালির জাতীয় জীবনে। রাষ্ট্রের সর্বত্রই চলছে তখন চরম বিশৃঙ্খলা। কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে। একে একে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদেরও হত্যা করা হলো। ৮১ দিনের খলনায়ক মোশতাকের বিদায়। তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের ছত্রছায়ায় ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হলেন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। এ সময়টা ছিল ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ‘অন্ধকার যুগ’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রতিদিনই ছিল সান্ধ্য আইন। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে যত হত্যাকাণ্ড, ক্যু সংঘটিত হয়েছে-কোনোটারই বিচার করা যাবে না শর্তে পাস করা হলো ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ।’ সেনাশাসক জিয়া ঘোষণা দিলেন ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ. যথারীতি করাও হলো তাই। রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাঙনের পাশাপাশি দলছুট, লোভী, নীতি-আর্দশহীন লোকদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ছত্রছায়ায় গঠন করলেন প্রথমে ‘জাগদল’ পরে বাজাদল বা ইঘচ. মেধাবী ছাত্রদের ‘হিজবুল বাহার’-এ নিয়ে গঠন করলেন ছাত্রদল। কলমের পরিবর্তে মেধাবী ছাত্রদের হাতে তুলে দিলেন অস্ত্র। হত্যা, গুম, খুন চলতেই থাকল। মিথ্যা মামলা, হুলিয়া, বিচারের নামে প্রহসন, জেলখানাগুলোতে নিপীড়ন ছিল দৈনন্দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি, সেনাবাহিনীতে অসংখ্য ক্যু। জাপানি বিমান হাইজ্যাকের প্রাক্কালে-বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত বেশ কয়েকটি যুদ্ধ বিমানকে ধ্বংস করা হয় এবং বিমান ও সামরিক বাহিনীর দেড় শতাধিক ট্যালেন্ট অফিসারকে হত্যা করে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্বল করে তোলে। অন্যদিকে পুনর্বাসিত করতে থাকে ৭১-এর পরাজিত শক্তিকে। যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার থেকে মুক্তি, রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীসহ চিহ্নিত সাত-আটজন রাজাকারকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয় আর অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের ফাঁসি, কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতাদের কষ্টকর জীবন নির্বাহ। মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ক স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নিষিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও গানগুলো নিষিদ্ধ। পাকিস্তানি ঢংয়ে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ বেতারের স্থলে, রেডিও বাংলাদেশ। সরকারি গণমাধ্যমে কোথাও ‘পাক-হানাদার’ কথা ব্যবহার করা যাবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে নব্য পাকিস্তান বানানোর উন্মত্ততায় লিপ্ত সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান।

স্বৈর-সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিলেন— ‘গড়হবু রং হড় ঢ়ত্ড়নষবস’. অনিয়ন্ত্রিত অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটানো হলো রাজনীতিতে। পচনের চোরাগলিতে ঠেলে দেওয়া হলো আমাদের গৌরবোজ্জ্বল রাজনীতিকে।

১৯৮১-তে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হলেন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। এমনিতর অব্যবস্থা, হত্যা ও ক্যু এর মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বাংলার ক্ষমতার মসনদে দেখা গেল আরেক সেনাশাসক লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। ইতিহাসে যার বিশ্ব বেহায়ার খ্যাতি রয়েছে।

আবারও স্থগিত করা হলো সংবিধান। সাধারণ মানুষের পালনার্থে প্রতিদিনই ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল সামরিক বিধিগুলো। সামরিকীকরণ করা হলো সবকিছু। তারপর প্রথম ধাক্কাটিই এলো আবারও ছাত্রসমাজের ওপর। প্রণীত হলো ড. মজিদ খানের শিক্ষানীতি। সাধারণ ছাত্রসহ সব ছাত্রসংগঠন ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে সামনে রেখে সুসংগঠিত হতে থাকে। টের পেয়ে সামরিক জান্তা হুলিয়া, মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। অদমনীয় ছাত্রসমাজ তাদের দাবি নিয়ে ৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাভবনে স্মারকলিপি দিতে গেলে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় ছাত্রনেতা জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, দিপালি সাহাসহ অনেককে। শুরু হলো আন্দোলনের নতুন ধারা। ছাত্রদের পক্ষে সমর্থন, সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রম ও রূপরেখা তৈরির জন্য বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ও তদানীন্তন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. কামাল হোসেনের ৭, বেইলি রোডের বাসায় চলছিল রুদ্ধদ্বার বৈঠক। এখান থেকে গ্রেফতার হলেন ড. কামাল হোসেনসহ বঙ্গবন্ধু কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সংগ্রামী নেত্রী জোহরা তাজউদ্দীন, জননেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ অর্ধশতাধিক জাতীয় নেতা।

এভাবে গ্রেফতার, হত্যা চলতেই থাকল এক দশক। ধ্বংস হলো শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দলছুট রাজনীতিকদের প্রচণ্ড দাপট। লুটতরাজের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হলো বাংলাদেশ। তখন এটি একটি পরিপূর্ণ এক অকার্যকর রাষ্ট্র। প্রতিবাদ করতে গেলেই গুলি। জননেতা ময়েজউদ্দিন ভাই, সেলিম, দেলোয়ার, আবু ফাত্তাহ, দেলু, চট্টগ্রামে গণমিছিলে নির্বিচারে গুলি। দেশব্যাপী হত্যার উন্মত্ততায় মেতে উঠা রক্তলোভী শাসকের এক দশকে হাজার হাজার পরিবার হয়েছে সন্তানহারা, স্বামীহারা। ৮৭’র ১০ নভেম্বর যুবনেতা বাবুল আর নূর হোসেনের রক্তস্নাত পথ বেয়েই আসে নব্বই। জাহিদ আর ডা. মিলনের আত্মাহুতির মধ্যদিয়ে ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এই বিশ্ব বেহায়া রক্তলোভী সামরিক জান্তার।

আজ ২৬ বছর পরেও দুঃখ হয় নূর হোসেনের বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ কথাটির কি যথার্থ বাস্তবায়ন হয়েছে? ২৬ বছরে ডাকসু, ইউকসুসহ সারা দেশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে? কোটারি রাজনীতির স্বার্থেই কি মেধাবী ছাত্র নেতৃত্ব বিকাশের পথকে অবরুদ্ধ করে রাখছেন ৯০ পরবর্তী সরকারগুলো। গণতন্ত্রের স্বার্থে সংবিধানের দোহাই দেওয়া হলেও বর্তমান পার্লামেন্টের ১৫৪ জন সংসদ সদস্যই অনির্বাচিত।

ছাত্র-যুব, কৃষক-শ্রমিকের রক্তে অর্জিত গণতন্ত্র বারবারই কি মুখ থুবড়ে পড়বে? আশাহতের বেদনায় জনমানুষ কি বরাবরই গুমরে কাঁদবে? দুর্বৃত্তায়িত-সুবিধাবাদী রাজনীতির অবসান কি আদৌ হবে না?

এ অস্বাভাবিক গুমোট পরিস্থিতির অবসানের লক্ষ্যে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। আর এক্ষেত্রেও এগিয়ে আসতে হবে বাংলার ছাত্র ও যুবসমাজকেই। অগ্রবর্তী সৈনিকের মতোই পথ চলতে হবে, হাঁটতে হবে আলোর উৎস অভিমুখে।

লেখক : সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ও সাধারণ সম্পাদক, গণফোরাম।

সর্বশেষ খবর