এবার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে উপচেপড়া ভিড় ছিল না। ২৭ মার্চ মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে আদালত অবমাননার দায়ে দুই মন্ত্রী দণ্ডিত। তারা থাকবেন, কি থাকবেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন। এসব নিয়ে বড় অশান্তিতে আছি।
১৬ মার্চ মঙ্গলবার দিল্লি ছিলাম। না হলে ওইদিনই টুঙ্গিপাড়া যেতাম। পিতার কবরে গেলে, ফাতিহা পাঠ করলে কেন যেন খুবই ভালো লাগে, ভারী বুক পাতলা হয়, শ্বাস নিতে আরাম লাগে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল পিতার কবরের পাশে জুমার নামাজ আদায় করি। কিন্তু কেন যেন হচ্ছিল না। কবরে ফাতিহা পাঠ ও জুমার নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। কর্নেল শওকত, সাবেক মন্ত্রী শামসুল হক টুকু আরও কার কার জন্য ঠিক সময়ে ফেরি ছাড়েনি, দেরি করেছিল। তাতে টুঙ্গিপাড়ায় নামাজ আদায় করতে পারিনি। পথে ভাটিয়াপাড়ায় নামাজ পড়েছিলাম। তাই বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদারদের ঝাঁপিয়ে পড়ার দিন ২৫ মার্চ শুক্রবার টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। বেশ ভালো লেগেছে, শান্তি ও তৃপ্তি পেয়েছি। টাঙ্গাইল থেকে চমচম নিয়ে গিয়েছিলাম। নামাজিদের দিয়ে মসজিদের সামনে নিজের হাতে বিলাচ্ছিলাম। বাচ্চারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। বড় আনন্দ পেয়েছি তাতে। এক প্লাটুন পুলিশ থাকে মাজার পাহারায়। তাদেরও দিয়েছি। যাওয়ার পথে ফেরিতে তেমন ভিড় ছিল না। মাদারীপুরের বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির আর শিবচরের আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান সিরাজ ছিলেন। দুজনই সজ্জন ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এখনো মুখোমুখি বসে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বন্ধুর মতো কথা বলতে পারে বহুদিন পর দেখলাম। বেশ ভালো লাগল।
৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নির্বাচনব্যবস্থাকে দারুণ কলঙ্কিত করেছে। নির্বাচন পদ্ধতি তছনছ, খানখান হয়ে গেছে। ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত। সেখানেই সংসদ বৈধতা হারিয়ে ফেলেছে। তারপর যে ১৪৭ আসনে নির্বাচন হয়েছে, সেখানেও লোকজন ভোট দিতে যায়নি। ২-৩ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি, ৫০ কেন্দ্রে তো একটিও না। তার পরও নির্বাচন কমিশন বলেছে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের কথামতো অর্ধেক আসনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়লে এ পার্লামেন্ট মাত্র ২০ শতাংশ জালিয়াতির ভোটে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু ২০ শতাংশ ভোটে যাই হোক বিশ্বস্বীকৃত পার্লামেন্ট হতে পারে না। যদিও ব্যর্থ প্রধান বিরোধী দলের কারণে সরকার এখনো টিকে আছে। কিন্তু তাদের বুকের জোর, আত্মার বল খুব একটা বেশি নেই। ঠিক এমন একটা সময় বেশ কয়েক বছর পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয়েছে। একটা দলের কাউন্সিল সেই দলের শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালনের মতো। কিডনি রোগীর জন্য সপ্তাহে দু-তিন বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। রাজনৈতিক দলের সম্মেলন প্রায় তেমনি। কিন্তু এবার বিএনপির যে সম্মেলন হয়েছে তা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের জন্য শুভ নয়। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নির্বাচিত। জাতীয় নির্বাচনে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া যায়নি, এ ক্ষেত্রেও তা অনুকরণ করা হয়েছে। তারপর ১৯ মার্চ সম্মেলন, একে সম্মেলন না বলে একটি বড়সড় কর্মিসভা বললেই মানানসই হতো। দিল্লি ছিলাম বলে যেতে পারিনি। থাকলেও যেতাম কিনা বলা যায় না। কারণ গণতন্ত্রের কথা বলে যেখানে গণতন্ত্রের গলা টেপা হয় সেখানে যেতে ইচ্ছা করে না। সম্মেলন হলো, কাউন্সিলর ডেলিগেটসের সামনে ১০টা নাম প্রস্তাব করা হলো না, অনুমতি নেওয়া হলো না। সব করবেন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান। কাউন্সিল থেকে স্থায়ী কমিটির ১০ সদস্যের অনুমোদন নিলে কী হতো? প্রতিটি জেলা থেকে দু-এক জন প্রতিনিধি তো সেন্ট্রাল কমিটিতে নেওয়াই হবে। সেসব জেলা প্রতিনিধির ২০-২৫ জনকে কাউন্সিলে সম্মতি নিয়ে নিলে কী এমন ক্ষতি হতো? কত বছরের ভারযুক্ত সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব। ভারে ভারে তার নুইয়ে পড়ার অবস্থা। তাকে কাউন্সিলে ভারমুক্ত করা যেত। তাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মহাসচিব করার ইচ্ছা থাকলে সেটাই করতেন, তাও তো কিছু ভাবা যেত। বিএনপির কত প্রবীণ নেতা এখন বলছেন, দলীয় কর্মীদের নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি গভীর আস্থা থাকায় সব ভার তার কাঁধে বা মাথায় দিয়ে গেছেন। আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন রামু মারুয়া নামে এক পশ্চিমা কুলিকে দেখতাম দুই-আড়াই মণের চিনির বস্তা অবলীলায় নিয়ে যেত। মহাসচিবের ভার তো তার চেয়েও বেশি। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রগাঢ় আস্থা আছে এটা কে অস্বীকার করবে? কেউ করবে না। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা নেই, এটা বললে তো চলবে না। ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এতদিন যে চেঁচামেচি বিএনপি করেছে এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তা একেবারে অসাড় হয়ে গেছে। বিএনপি কর্মীদের গভীর আস্থার কারণে যদি বেগম খালেদা জিয়া কাউন্সিলরদের ভোট ছাড়াই সব করতে পারেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যারা দেশ স্বাধীন করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আমাদের পক্ষে তো বলতেই পারেন, ভোট-টোট আবার কী? দেশের আপামর জনসাধারণের গভীর আস্থা ও ভালোবাসায় তিনি দেশের সব দায়িত্ব তার নিজের হাতে তুলে নিয়ে সানন্দে পরিচালনা করছেন, এটাকে কোন যুক্তিতে খণ্ডন করা হবে? বিএনপির কাছে কোনো সাবলীল যুক্তি আছে বলে তো আমার মনে হয় না।
২৪ মার্চ স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হলো— এ নিয়ে দেশবাসীর অনেক প্রশ্ন। নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগারদের জন্য এটা আওয়ামী পুরস্কার হলে কেউ কোনো আপত্তি করত না। কিন্তু তার পরও মাদারীপুরের আসমত আলী খানকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া কেন যেন কাঁটা কাঁটা ঠেকছে। মরণোত্তর সেই পুরস্কার আবার তার ছেলে শাজাহান খানের হাতে দেওয়ায় বুকের ভিতর কেমন যেন একটা চাপ বা ব্যথা বোধ করছি। শাজাহান খানের বাবার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। বঙ্গবন্ধু তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। এখনকার মতো তখন অবহেলিত ছিলাম না, অনেকের হৃদয়ে বেশ জায়গা নিয়েছিলাম। আসমত আলী খান খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। দু-এক বার হাত চেপে বলতেন, ‘ভাই, আপনাকে সবাই ভালোবাসে। মনে হয় জাদু জানেন। আমার ছেলেটাকে একটু ঠিক করে দেন না। বঙ্গবন্ধুর কাছে যে মুখ দেখাতে পারি না।’ তার আন্তরিক আকুতি আমায় মুগ্ধ করত। দু-এক বার বলেছি আমি কী করব? নিজের ছেলে নিজে ঠিক করতে পারেন না। আমি কী করে ঠিক করব? তার পরও বলতেন, আপনি পারবেন। পারতাম কি পারতাম না কোনো চেষ্টা করিনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। কতবার শাজাহান খানকে ডেকে বলেছেন, ‘ভালো করে লেখাপড়া কর। বিলেতে যা, তারপর রাজনীতিতে আয়। আমি তোর জন্য ব্যবস্থা করে দেব।’ বঙ্গবন্ধুর কথা শাজাহান খান শোনেননি বরং গণবাহিনী করে তাকে খুন করার চেষ্টা করেছেন বা রাস্তা বানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যা পারেননি আজ তার কন্যা আমার বোন জননেত্রী তা পেরেছেন। বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করেছেন, খুনের রাস্তা করেছেন তাদের প্রায় সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন, এটা নিশ্চয়ই তার সফলতা। কিন্তু তার কোনো কাজ কলঙ্কিত হোক তা আমি চাই না। স্বাধীনতা পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে যিনি উপস্থাপন করছিলেন, ভদ্রলোক মাঝে মাঝেই পাকিস্তান হানাদারদের আল্লাহ রসুল কোরআনের মতো পাক পবিত্র ‘পাকবাহিনী, পাকবাহিনী’ বলছিলেন। মনে হচ্ছিল পাকবাহিনী বলতে পেরে তিনি কেমন একটা গর্ববোধ করছিলেন। হানাদাররা যদি পাক হয় তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা কি নাপাক? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটুও কি ভেবে দেখবেন না?
লেখক : রাজনীতিক