বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মঠবাড়িয়া কি অশনি সংকেত?

তুষার কণা খোন্দকার

মঠবাড়িয়া কি অশনি সংকেত?

পাবনা-নগরবাড়ি হাইওয়ের পাশে দ্বারিয়াপুর মডেল প্রাইমারি স্কুল। ১৯৭২ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসের এক সকালে এলাকার লোকজন দেখল স্কুলঘরের বারান্দায় একজন মানুষ মরে পড়ে আছে। মানুষটির হাঁ করা মুখের চারপাশে ডোমা নীল মাছির পাল ভিনভিন করছে। মৃতের গলায় তুলসীর মালা। মালার নিচে কালো কালচিটে দাগ দেখে বোঝা গেল লোকটি আচমকা হার্টঅ্যাটাকে মরেনি।  তাকে কেউ গলা টিপে মেরেছে। লোকটার পরনে খাটো ধুতি, গলায় তুলসীর মালা। লাশের পাশে জড়ো হওয়া মানুষগুলো এসব চিহ্ন দেখে বুঝল লোকটা হিন্দু। মৃতের পরিচয় জানার জন্য আশপাশের গ্রামে যেখানে হিন্দু পরিবারের বাস সেখানে খবর পাঠনো হলো। তাদের অনেকে এসে মৃত লোকটাকে দেখে বলল, লোকটি তাদের অচেনা। এলাকাবাসীর জন্য লোকটার পরিচয় খোঁজার দায়িত্ব সেখানেই শেষ হয়ে গেল।

১৯৭২ সালে সদ্য যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে একটি মরদেহ নিয়ে লোকজন অনেক সময় নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি ছিল না। একাত্তর সালের নয় মাস এই মানুষগুলো দিনরাত একটানা মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস করেছে। সে কারণে মৃত্যু নিয়ে লোকজনের মধ্যে এক রকম গা সওয়া ভাব ছিল। ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দেশে মৃত্যুর মিছিল থেমে ছিল না। যুদ্ধোত্তর অরাজক পরিস্থিতিতে দেশে খুনাখুনি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কাজেই একটি মানুষের মৃত্যু কিংবা অপমৃত্যু নিয়ে কেউ সেদিন আহা-উহু করছিল না। স্কুলঘরের বারান্দায় পড়ে থাকা মরদেহের বিধি-ব্যবস্থা কী হবে সেটি নিয়ে তারা চিন্তিত ছিল। বেলা বাড়লে বাচ্চারা স্কুলে ক্লাস করতে আসবে। কাজেই স্কুলঘরের বারান্দায় মৃতদেহ ফেলে রাখা যাবে না। তাই বলে, অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে লাশ ডাঙ্গায় ফেলে রেখে লোকজন কতক্ষণ অপেক্ষা করবে। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে মরদেহে পচন ধরতে সময় লাগবে না। সঙ্গত কারণে লোকজন একটি মরদেহের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সেদিন উতলা হয়ে উঠেছিল।  

দ্বারিয়াপুর বনেদি শিক্ষিত মানুষের গ্রাম। সেখানে সমবেত মানুষগুলোর বুঝবুদ্ধি আর দশটা গ্রামের অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের মতো নয়। তারা বুঝল, মৃত মানুষটি ঘাতে কিংবা অপঘাতে যেভাবেই মারা পড়ুক বিষয়টি পুলিশের নজরে আনা দরকার। তারা ভেবেছিল, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আপাতত আইনের শাসন নেই, তবে ভবিষ্যতে হয়তো আইনের শাসন কায়েম হতে পারে। আইনের শাসন যদি কায়েম নাও হয় তবুও সাবধান থাকা ভালো। আইনের শাসন কায়েম না হলেও পুলিশের শাসন কায়েম হওয়ার আশঙ্কা তারা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার সাহস পেলেন না। দেশে পুলিশের শাসন কায়েম হলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপতে পারে। পুলিশ মৃত ব্যক্তির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আদালতে সোপর্দ করবে এবং আদালত আইন অনুযায়ী হত্যাকারীদের শাস্তি দেবে এমনটি কেউ আশা করেছিল কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে তারা জানত, পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা। গ্রামবাসী কোনো অপরাধ না করলেও গ্রামের স্কুলের বারান্দায় যখন লাশ পাওয়া গেছে তখন গ্রামের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেছে। মুরব্বিরা ভেবেছে, আজ হোক কাল হোক আইনের দোহাই তুলে পুলিশ লাশ নিয়ে ঝামেলা পাকাতে পারে। কাজেই গ্রামের মানুষ অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতের জন্য কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। ভবিষ্যতে ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সবদিক বিবেচনা করে সমবেত মুরব্বিরা বললেন, অচেনা মানুষের মরদেহ নিয়ে খামখেয়ালি চলবে না।  লোকটি কে সেটা আমরা জানি না। লোকটা খুন হয়েছে কিনা সেটাও আমাদের অজানা। তবে এটি একটি অপমৃত্যুর ঘটনা। অপমৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া অন্যায়। মৃত্যুর ঘটনা থানায় গিয়ে পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আইন অনুযায়ী লাশের বন্দোবস্ত করুক।

মুরব্বিদের কথা মেনে নিয়ে জোয়ান ছেলেরা ছুটল সুজানগর থানায় পুলিশকে খবর দিতে। থানায় আসা-যাওয়ার লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে দুপুরের পরে লোকগুলো ফিরে এসে বলল, থানার পুলিশ মৃত লোকটির দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। বলেছে, দেশে এখন লাশের ছড়াছড়ি। চারদিকে হরহামেশা বেপরোয়া খুনখারাবি চলছে। একটা থানায় আমরা সামান্য কয়জন মাত্র পুলিশ। চারদিকে এত ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে কয়টা লাশ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে পারি, বল? তোমরা ভাগ্যবান গ্রামবাসী। তোমাদের গ্রামে যে লাশটি পড়ে আছে ওটি বেওয়ারিশ। আশপাশের গাঁয়ে লাশের কোনো দাবিদার তোমরা খুঁজে পাওনি। লোকটার ঠায়-ঠিকানা যেহেতু অজানা সেহেতু মাটিতে গর্ত করে লাশ পুঁতে ফেলতে তোমাদের কেউ নিষেধ করতে আসবে না। কাজেই লাশটি তোমরা মাটির উপরে ফেলে না রেখে গর্ত খুঁড়ে মাটির তলে চাপা দিয়ে দাও। গ্রামে একটা লাশ পচলে দুর্গন্ধে তোমরাই বেকায়দায় পড়বে। জ্যৈষ্ঠের দুপুরে ঠাঠা রোদের দিকে চেয়ে পুলিশের কথার বাস্তবতা বুঝতে গ্রামের মানুষের বেশি বেগ পেতে হলো না। স্কুলের বারান্দায় পড়ে থাকা লাশের সৎকার করতে মুরব্বিরা পুলিশের বােল দেওয়া বুদ্ধি ঝটিতি কাজে লাগিয়ে ফেললেন। পুলিশের কথামতো কাজ করে মুরব্বিরা কোনো ভুল করেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ, সেই অপমৃত্যু নিয়ে কোনো দিন কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে আমি আজও শুনিনি।

২০১৫ সালে পত্রিকা খুললেই নরহত্যার খবর চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে খবরের শেষ অংশে ছাপা হয় ‘লাশ দেখে লোকজন পুলিশে খবর দেওয়ার পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য অমুক হাসপাতালে পাঠায়’। এমন খবর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭২ সালে দ্বারিয়াপুর গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনার ছবি আমার মনের মধ্যে ভেসে আসে। মনে হয়, আমাদের দেশের পুলিশ অনেক বিষয়ে অক্ষম হলেও একটি কাজে তারা দারুণ সক্ষমতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে পুলিশ খুনখারাবির ঘটনাস্থলে আসতে অস্বীকার করত। লাশ মাটিচাপা দিয়ে তারা সমস্যার সমাধান করতে চাইত। এখন দেশের পরিস্থিতি বদলে গেছে। আমাদের দেশের পুলিশ এখন লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানোর কাজটি কি সত্যি খুব কঠিন? কাজটি কঠিন না হলে ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠানো শিখতে পুলিশের সাড়ে চার দশক সময় লাগল কীভাবে! স্বাধীনতার পরে এত বছর ধরে সাধ্য সাধনা করে বাংলাদেশ পুলিশ এটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে। পুলিশের এই অর্জন হয়তো উন্নয়নের লগ বুকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এন্ট্রি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষ ভাবছে ভিন্ন কথা। দেশে খুনাখুনির এমন বাড়বাড়ন্ত দেখে লোকে ভাবছে, এই নারকীয়তার অবসান কবে হবে, কীভাবে হবে! দেশের মানুষ জানে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশে খুনখারাবির অবসান হবে না। কিন্তু আইনের শাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের শাসন তাওরাতে বর্ণিত স্বর্গীয় মান্না সালওয়া নয় যে, সেটি আসমান থেকে ঝরে পড়বে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সে কাজে বড় সহায়ক ভূমিকা পুলিশকেই পালন করতে হবে। পুলিশের বর্তমান সক্ষমতায় কি দেশে আইনের শাসন আশা করা যায়?

দেশে আইনের শাসন আছে কি নেই এমন প্রশ্নের জবাবে দেশবাসী সবাই ‘না’ জবাব দেবে। অদূর ভবিষ্যতে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে মানুষ বিশ্বাস করে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবও নেতিবাচক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। স্বাধীনতার পরে সাড়ে চার দশক পার হয়ে গেলেও পুলিশ দেশে আইনের শাসন কায়েম করার যোগ্যতা অর্জন করেনি।

দেশে আইনের শাসন কায়েম করার লক্ষ্যে পুলিশ প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করেনি বলেই দেশজুড়ে নরহত্যার মহাযজ্ঞ চলতে পারছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজে পুলিশ ষোলো আনা ব্যর্থ হলেও রাজনীতিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা দেশে পুলিশের শাসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রতি ষোলো আনা অনুগত থেকেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা যাচাই করে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে বাধ্য হয়েছে। পত্রিকার খবর পড়ে মনে হয়েছে কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় পুলিশ সরকারি লোক নৌকা মার্কার কথা অনুযায়ী কাজ করার দরকার মনে করেনি। অনেক এলাকায় পুলিশ কোনো একজন প্রার্থীর পক্ষে স্রেফ ভাড়াটিয়া বাহিনীর মতো আচরণ করেছে। পুলিশকে সরকারের অনুগত পেটোয়া বাহিনী আখ্যা দিয়ে পুলিশের দোষ সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার দিন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। দেশজুড়ে সন্ত্রাসের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন পায়নি। নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা দায়সারাভাবে দেখার সুযোগ নেই। সরকারকে নিরপেক্ষ বিবেচনায় পুলিশের ভূমিকা মূল্যায়ন করতে হবে। দেখতে হবে, পুলিশের সামর্থ্য কতটুকু মানুষের কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে আর তার কতখানি তারা তাদের নিজ খেয়ালমাফিক অপব্যয় করছে।

বর্তমান সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ ছাড়া, দেশজুড়ে ঘটতে থাকা খুন-রাহাজানিতে পুলিশের ভূমিকা জনগণ ভালোভাবে নিচ্ছে না। দেশে পুলিশের শাসনের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে, ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন না থাকলেও পুলিশের শাসন তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। ১৯৭২ সালে সব থানার দারোগা-পুলিশ জানত সামান্য জনবল এবং অস্ত্রের অতি সামান্য জোগানকে পুঁজি করে তারা থানার সব অপরাধ সামাল দিতে পারবে না। ১৯৭২ সালে পুলিশ তাদের অক্ষমতা মেনে নিয়ে জনগণকে জনগণের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল।

স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরে পুলিশে জনবলের সংকট যদি থেকে থাকে সেটি কৃত্রিম। সরকার চাইলে পুলিশের জনবলের অভাব নিমিষে পূরণ করে দিতে পারে।

পুলিশের দামি গাড়ি আছে, ব্যবহারোপযোগী অস্ত্রও আছে। তারপরও পত্রিকার পাতা খুললে দেখি লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নরহত্যার বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গেছে যে, আজকাল সরকারি দলের লোকজন খুনখারাবির বিচার চেয়ে মানববন্ধন করছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মঠবাড়িয়ায় যেভাবে মানুষকে হত্যা করা হলো সেটি সরকারের জন্য অশনি সংকেত।  সরকার এই সংকেত থেকে কী শিখবে সে দায়িত্ব সরকারের। জনগণ মঠবাড়িয়া ঘটনার বিচার দেখার জন্য অপেক্ষা করবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর