পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয়গুলো জানেন।’ (সূরা আল মুমিন : ১৯) অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর কাছে আসমান ও জমিনে কোনো কিছুই গোপন থাকে না।’ (সূরা আলে ইমরান : ০৫) উল্লিখিত আয়াত দুটির মাঝে মহান রাব্বুল আলামিন নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে অতি সামান্য আলোকপাত করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা সব বস্তুর ওপরে সমানভাবে বিদ্যমান— চাই তা প্রকাশ্য হোক বা অপ্রকাশ্য হোক, ভিতরে হোক বা বাইরে হোক, জমিনে হোক বা আকাশে হোক। এক কথায় তিনি সর্বদা সব জায়গায় সমানভাবে বিদ্যমান। তিনি সবকিছু জানেন, শুনেন ও দেখেন। তাঁর আয়ত্তের বাইরে সৃষ্টিকুলের কিছুই নেই। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা যেখানেই থাক আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা হাদিদ : ০৪) মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা) বলে পবিত্র কোরআনে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বস্তুত সৃষ্টির সেরা ওই মানুষ, যে আপন নফসের সার্বক্ষণিক হিসাব নেয় এবং নফসকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখে। তার মাধ্যমে নফস পরিচালিত হয়। সে নফসের দ্বারা পরিচালিত হয় না। কারণ একজন মানুষ যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমি দীন-ইসলামের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কর্ম করব না। আল্লাহ ও তাঁর হাবিব রসুল (সা.) যেভাবে জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন ঠিক ওইভাবে পরিচালনা করব। এমন ব্যক্তি অবশ্যই দীনি কাজ করার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে হাজারো সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। তিরমিজি শরিফের এক হাদিসে এসেছে, হজরত আবু ইয়ালা শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন : ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি যে তার নফসের হিসাব নেয় এবং পরকালের জন্য কাজ করে। আর নির্বোধ ওই ব্যক্তি যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে, আবার আল্লাহর কাছেও আশা-আকাঙ্ক্ষা করে।’
বাস্তবিকই যদি প্রতিটি মানুষ অন্যের হিসাব নেওয়ার আগে নিজের হিসাব নিত তাহলে পৃথিবীর বুক থেকে অশান্তি দূর হয়ে যেত এবং শান্তির হাওয়া প্রবাহিত হতো। বিশ্বে এমন অনেক মানুষ আছে যারা অন্যের সমালোচনায় বড় পারদর্শী। কিন্তু নিজের ভিতরে যে কত সমস্যা বিদ্যমান সেদিকে তার কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। এ জন্য গ্রাম-গঞ্জে একটি প্রবাদবাক্য আছে, ‘অন্যের চিন্তা বাদ দিয়ে আপন চরকায় তেল মাখ’। অর্থাৎ তুমি অন্যের গিবত-শেকায়েতের পেছনে তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে নিজের দুনিয়া ও পরকালকে সুন্দর করার ফিকির কর। দীনি দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে আদায় কর। তোমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব নাও। তুমি কি করছ ও কি বলছ হিসাব করে বল এবং হিসাব করে চল।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2016/APRIL/01-04-2016/2a.jpg)
প্রতিটি মানুষের উচিত রাতে ঘুমানোর আগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপন কর্মের হিসাব নেওয়া। হিসাবের মধ্যে নেকির পাল্লা যদি ভারী হয় তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে আর গুনাহের পাল্লা ভারী হলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করবে। আগামীতে যাতে এমন গুনাহের কাজ না হয় তার জন্য দৃঢ় সংকল্প করবে এবং নিম্নের হাদিসগুলোর ওপর আমল করবে। এক. হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি একদিন রসুলের (সা.) পেছনে (কোনো সওয়ারের উপর) বসা ছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন : ওহে খোকা, ‘আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহর (নির্দেশাবলীর) রক্ষণাবেক্ষণ ও অনুসরণ কর, আল্লাহও তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। মহান আল্লাহর হক আদায় কর, তাঁকেও তোমার সঙ্গে পাবে। যখন কোনো কিছু চাইবে তো আল্লাহরই কাছে চাও। আর যখন তুমি সাহায্য চাইবে তা আল্লাহরই কাছে চাও। আর জেনে রাখ, সব সৃষ্টজীব একসঙ্গে মিলেও যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবে মহান আল্লাহ যা তোমার ভাগ্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন তাছাড়া কোনো উপকার করতে পারবে না। আর তারা যদি একসঙ্গে মিলে তোমার ক্ষতি করতে চায়, তবে মহান আল্লাহ যা তোমার ভাগ্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন তাছাড়া কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে এবং কিতাবাদি শুকিয়ে গেছে। অর্থাৎ তকদিরের লিখন শেষ হয়ে গেছে।’ (তিরমিজি শরিফ) দুই. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘বাজে কাজ ও কথা পরিহার করা মানুষের (ফিতরি) সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত।’ (তিরমিজি) প্রিয় পাঠক! প্রতিটি মানুষ চায় একটি সুন্দর জীবন এবং সুন্দর পরিবেশ। সুন্দর জীবন ও সুন্দর পরিবেশ অন্যে তৈরি করে দেবে না। আমার পরিবেশ আমাকেই তৈরি করে নিতে হবে। মানুষ পরিবেশের দ্বারাই গড়ে ওঠে। আমি যদি আলোচ্য হাদিসগুলোর ওপর আমল করি, তাহলে আমার দেখাদেখি আমার ঘরের প্রতিটি সদস্যও আমল করতে শুরু করবে, তাদের দেখাদেখি মহল্লার অন্য লোকেরাও আমল করতে শুরু করবে। এভাবে ধীরে ধীরে একদিন সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে। তাই আমাদের উচিত আমাদের ঘরে কোরআন ও হাদিসের তালিমের ব্যবস্থা করা। একটা সময় ঠিক করে নেই যে, প্রতিদিন এই সময়ে ঘরে তালিম হবে। ঘরের প্রতিটি সদস্য যাতে তালিমে শরিক হয় সেদিকে খেয়াল রাখি। ঘরের জরুরি কাজ থেকে ফারেগ হওয়ার পর এভাবে যদি আমরা ঘরের সদস্যদের দীনি কাজে ব্যস্ত রাখি তাহলে তাদের মনে কোরআন-হাদিসের প্রতি মুহব্বত বসবে, দীনি কাজ করার জযবা তৈরি হবে, নিজেই নিজের আমলের হিসাব নিতে শিখবে। আর শরিয়তের বাইরের কার্যকলাপ থেকে নিজেরাও বিরত থাকবে এবং আপন সন্তানসহ অন্যদেরও এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখবে। এভাবেই সারা জাতি একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ উপহার পাবে। আল্লাহপাক আমাদের আত্মপর্যবেক্ষণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।