সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা
পাঠক কলাম

জাটকা নিধন বন্ধ করুন

ড. ফেরদৌসী বেগম

জাটকা নিধন বন্ধ করুন

সেই ছোট্টবেলা সমৃদ্ধিশালী একটি গ্রাম, টাকা পয়সায় নয়, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধিশালীর কথা বলছি। বৈশাখে বাড়ি যেতে হতো, বাবা বড় ব্যাংকার কিন্তু কাঁচা আম, ঘুড়ি উড়ানো, চৈত্যের পুকুর সেচা, আর গ্রামের হাটে মেলাতে যাওয়ার জন্য চারটা ফেরি পার হয়ে আমাদের গ্রাম যেতে হতো। মোট তিন বার আমরা বাড়ি যেতাম এই বৈশাখে, বর্ষায়, শীতে। এই তিনবার যাওয়ার মধ্যে দুই ঈদেও বাড়ি যেতাম। বাবা গ্রামের বিভিন্ন পুকুরে জাল মেরে মাছ ধরতেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে যেতাম। সুতরাং আমি জাল মারা, মাছ ধরা সবই পারি। বর্ষায় আরও একটা মজার খেলা হতো, কাদা মাটিতে হাডুডু খেলা। আমি তাও খেলতে জানি। আর শীতকালে পিঠা, খেজুরের রস চুরি তা দিয়ে ফিন্নি রান্না, শুকনো মাঠে গোল্লাছুট, দারিয়াবান্দা, বউ-ছুঁই, ফুটবল। আমরা গ্রামে যেতাম, বৈশাখে বর্ষা আর শীতে সবই আব্বার সখ পূরণের জন্য এবং চৈত্র সংক্রান্তি শেষে বৈশাখের প্রথম দিন সকালে বাবা হাটে যেতেন, হাটের সঙ্গে বসত বৈশাখী মেলা। আমরাও সেই মেলায় যেতাম। বড় লাই (বাঁশের বড় ঝুড়ি) ভরে বাজার করতেন। একটাতে থাকত বড় দুটা কাতল মাছ আর একটাতে থাকত সবজি, মিষ্টি, দই ও অন্যান্য তেল মসলা। মাছ আনার পর মেজ দাদি (বাবার চাচি) একটু রং লাগিয়ে বৈশাখী ছোঁয়া দিতেন, বাবার সঙ্গে আমরাও যেতাম হাটে, বৈশাখী মেলা ছোট চরকি, মাটির ঘোড়া, পুতুল, পালকি, বাঁশি, কানের দুল, কাঁচা আম কাটার বাটাইল (ছুরি), ঝিনুক বাঁশি, তাল পাতার পাখা কিনে আনতাম।

সকালে নাস্তা করতাম বিন্নি ধানের খই, শালী ধানের চিঁড়া, দই, বাতাসা দিয়ে মেখে খেতাম। এক গ্লাস দুধ খেয়েই সবাই দল বেঁধে হাটে যেতাম, হাট থেকে ফিরে পুকুরে ঝাপাঝাপি গোসল, তারপর সেই কাতল মাছ দিয়ে লাল চালের ভাত, বড় টুকরার মাছ, সেই মাছের মাথা মুগডাল দিয়ে মুড়িঘণ্ট, মিষ্টি পাটের শাক, শেষ পাতে রসগোল্লা, দই, নারিকেলের পায়েস খেয়ে উঠতাম। তারপর ঘুড়ি উড়ানো সেই চৈত্যের (পাতর) চষা ক্ষেত। এই পাতর থেকে ওই পাতর ঘুরে বেড়াতাম। মাঝখানে কাঁচা আমের ভর্তা, তরমুজ, ভাঙ্গি খেতাম। সন্ধ্যায় ওই মাছের আঁশগুলো গোলাপি আর সবুজ রং করে শুকাতে দিতাম আর গ্রামের মহিলারা উঠানে এসে জড়ো হতো বাবা শরৎ বিভূতি ভূষণের উপন্যাস পড়ে শোনাতেন। মেজ দাদি পুথি পড়তেন, ছোট ছোট সবাই আমরা নাচ গান করতাম। রাতে গরুর মাংস অথবা পালা মুরগি দিয়ে ভাত খেতাম, শেষ পাতে দুধ আর আগের বছরের আমসত্ত্ব দিয়ে ভাত খেতাম। রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা মনে পড়ে যেত ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলি দলি। সন্দেশ মাখিয়ে ভাতে, হাপুসহুপুস শব্দ তাতে, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে’। রাত গভীর হলে দাদিরা পিঠা বানাতে বসতেন সকালের জন্য।

বড় মাছ খাওয়ার ব্যাপারে ঐতিহ্য ছিল বলা হতো যত আঁশ তত আশ অর্থাৎ নতুন বছরের মাছে যত আঁশ হবে তত টাকা হবে এবং আশা পূরণ হবে। নববর্ষের প্রথম দিন যত ভালো খাওয়া যাবে বছরজুড়ে সে রকম ভালো খাওয়া হবে। আমরা এই রং করা আঁশগুলো মালা গেঁথে ঘরে ঝুলিয়ে রাখতাম, নববর্ষে লাল নীল কাগজ দিয়ে ঘর ও উঠান সাজাতাম।

আমি বিগত ২০ বছর ধরে ঢাকা শহরের এক অদ্ভুত কালচার দেখছি। রমনা বটমূলে একটা সময়ে আমরা যেতাম তখন এগুলো ছিল না। অদ্ভুত এক কালচার মাটির সানকিতে পান্তা ইলিশ ভর্তা শুঁটকি। অনেক দিন ধরে এ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেছি। আরে ভাই এ তো গরিবি ব্যাপার। সবাই যেখানে সিলভারের বাসন ছেড়ে মেলামাইন আর কাচের বাসনে খাচ্ছে, খালি পা ছেড়ে সেন্ডেল পরছে, খালি গা ছেড়ে গেঞ্জি শার্ট পরছে, যেখানে এই কোন পিছনে ফেরা! এ তো ঐতিহ্য নয়। পান্তা কি বাঙালির ঐতিহ্যের খাওয়া? আর এই সময়ের ইলিশ, এ তো ঝাটকা খাওয়া, আর ডিডিটি মাখানো শুঁটকি। এটা তো সবচেয়ে বড় অপসংস্কৃতি। আমাদের জাটকা নিধন সংস্কৃতি, এটাও বন্ধ করতে হবে। আমার ড্রাইভার বলছে, ম্যাডাম মেয়েটা ধরেছে পান্তা ইলিশ খাবে, একটা ইলিশ ১৫০০ টাকা। যদিও সেদিন প্রথম আলোতে দেখলাম ১৭ হাজার টাকায় একটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে। (নির্ঘাত অবৈধ টাকা)। ধন্যবাদ ভোলার জেলা প্রশাসক। আপনি এ নববর্ষে জাটকা কথিত ইলিশ নিধন বন্ধ করেছেন। অপসংস্কৃতি থেকে ভোলাবাসীকে মুক্তি দিয়েছেন।

কেউ বুঝে না ইলিশ দিয়ে পান্তা মাখলে তো হাত তেল তেল হয়ে যাবে, খেতেও ভালো লাগবে না। আসুন আমরা নববর্ষে এসব পান্তা ইলিশ শুঁটকি খাওয়া বন্ধ করে বছরের প্রথম দিন ভালো খাই। গরম ভাত, রুই, কাতল, মিষ্টি, দই, তরমুজ, খই, মুড়ি, চিঁড়া, পায়েস, কাঁচা আম এসব খেয়ে সমৃদ্ধিশালী হই। নিজে ভালো থাকি, সবাইকে ভালো রাখি। ‘যত আঁশ তত আশ’ এ স্লোগান পৌঁছে দিই বাংলার ঘরে ঘরে। আসন্ন বৈশাখের আগাম শুভেচ্ছা সবাইকে।

লেখক : গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর