মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

বর্ষবরণ মানে শুধুই ‘ইলিশ’?

শাইখ সিরাজ

বর্ষবরণ মানে শুধুই ‘ইলিশ’?

গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝির কথা বলছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ কয়েক বছর হলো শুরু করেছি। এ রকম একটা সময়েই জাটকা নিধনের কথা জানলাম। তখন দেদার জাটকা নিধন হতো। আমার গ্রামের বাড়ি ইলিশের জেলা চাঁদপুর। মেঘনার ইলিশের প্রাচুর্যের খোঁজ জানি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই। যা হোক, জাটকা নিধন বন্ধের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজ শুরু হলো। নানান ধরনের স্লোগান সামনে এলো। ‘ইলিশ পোনা দেশের সোনা’, ‘যারা ধরে জাটকা ওদের ধরে আটকা’ ইত্যাদি। বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বেশ কয়েকটি উপকেন্দ্রের মধ্যে একটি ছিল চাঁদপুরে। তা ছিল মূলত ইলিশ গবেষণা কেন্দ্র। ওই গবেষণা কেন্দ্রের কার্যক্রম তুলে ধরতেই মেঘনায় বেশ কিছু কাজ করি। সে ধারাবাহিকতায় কক্সবাজারের সমুদ্রসংলগ্ন মত্স্য অবতরণ কেন্দ্র, বরিশাল মত্স্য অবতরণ কেন্দ্রেও কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। তখনই প্রথম জানতে পারি একটি পরিপূর্ণ মা ইলিশের পেটে অন্তত ১০ লাখ ডিম থাকে। তার মানে একটি ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরা মানে একই সঙ্গে ১০ লাখ ইলিশ নিধন করা। সঙ্গে সঙ্গে একটি জাটকা ধরা মানে পরিপূর্ণ একটি ইলিশকে নিধন করা অথবা আরও ১০ লাখ ইলিশের সম্ভাবনা আগাম নিঃশেষ করে দেওয়া। তাহলে প্রশ্ন আসে, কখন মাছ ধরা যাবে? স্বাভাবিক জবাব হচ্ছে, যখন মাছ পরিণত হবে। প্রাকৃতিকভাবেই সে খাদ্য উপযোগী হবে। সে সময়টি হচ্ছে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পূর্ণিমায় মা ইলিশ রক্ষার ১৫ দিন বাদ দিয়ে। তখন তা স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হয়ে উঠবে। সেটিই মূলত বাঙালির প্রিয় ইলিশ। জাটকা বা মা ইলিশ নয়। উল্লেখ্য, আগামী বছর থেকে মা ইলিশ রক্ষার এ সময়টি ১৫ দিনের পরিবর্তে ২২ দিন হয়ে যাচ্ছে। ১০ এপ্রিল আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মার্চ-এপ্রিলের জাটকা রক্ষার সময়টি বাদ দিয়ে সারা বছর ২৫ সেন্টিমিটার ওপরের আকারের ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

এ রকম প্রেক্ষাপটেই বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় বেঁধে দেওয়া হয় যখন ইলিশ ধরা যাবে না। প্রজনন মৌসুম ও জাটকার মৌসুমের মধ্যে অন্যতম। আগে থেকেই মত্স্য বিভাগের কিছু নিয়ম ও নির্দেশনা ছিল, যা আশির দশকে জোরেশোরে প্রচারও শুরু হলো। ২৫ সেন্টিমিটারের নিচে কোনো ইলিশ ধরা যাবে না। জালের ‘ম্যাশ সাইজ’ বা একটি খোপের আকার নির্ধারণ করে দিল। যে আকারের ফোকর দিয়ে ৯ ইঞ্চি আকারের মাছ সহজেই বেরিয়ে যেতে পারে। তখনই কারেন্ট জাল নিয়ে রব উঠল। সবাই জেনে গেল কারেন্ট জালই ইলিশ নিধনের সবচেয়ে কার্যকর ফাঁদ। মানুষের এমন ধারণা হলো যে, কারেন্ট জাল এমন একটি জিনিস যা পানির মধ্যে থাকলে এমন এক বিদ্যুৎ তৈরি করে, যা মাছকে আটকে ফেলে। আসলে মনোফিলামেন্ট নামে এক ধরনের স্বচ্ছ ও মিহি সুতায় তৈরি ওই জাল পানির সঙ্গে মিশে থাকে যা মাছ তো দূরের কথা মানুষের পক্ষেও খালি চোখে সহজে ঠাওর করে ওঠা কঠিন। যতদূর জানা যায়, ১৯৫০ সালে প্রথম পূর্ব বাংলা মত্স্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন পাস হয়। পরে পাঁচ-ছয় বার এ আইনে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়। এ আইনের ৩ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রণীত মত্স্যরক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৮৫-এর ৯ ধারা অনুযায়ী নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের নিচে ইলিশ ধরা ও বহন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ’৯০-এর দশকের শুরু থেকেই এ বিষয়ে জেলে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হতে থাকে। সরকারিভাবে দেশের প্রধান প্রধান নদীতীরবর্তী ২০ জেলার ৭৬টি উপজেলায় বিশেষ বিশেষ জলসীমাকে বছরের ছয় মাস অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। এ আইনি উদ্যোগগুলো ছিল কার্যকর ও ফলপ্রসূ। মানুষের মধ্যে বেশ সচেতনতা আসে। জাটকা নিধন থেকে জেলেরা আস্তে আস্তে সরে আসতে থাকে। ইলিশের প্রাচুর্য বাড়তে থাকে। হারিয়ে যাওয়া ইলিশের ঐতিহ্য আবার ফিরে আসতে শুরু করে। বছর বছর সরকার ইলিশ উৎপাদনের সাফল্যের বার্তা জানান দিতে থাকে। সরকারিভাবে ইলিশ রপ্তানিও বিভিন্ন সময় বন্ধ করা হয়, শুধু দেশীয় ইলিশের প্রাচুর্য সৃষ্টির আশা থেকে।

সুদীর্ঘ এ প্রসঙ্গ অবতারণার উদ্দেশ্য হলো, আমার জানা মতে মত্স্যরক্ষণ ও সংরক্ষণ আইনের নতুন কোনো সংশোধনী আসেনি। মাছ ধরাও সারা বছরের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঠিক এই নিষিদ্ধ মৌসুমের চূড়ান্ত সময়টিতে এসে বৈশাখ সামনে রেখে ইলিশ ধরার মহোৎসব শুরু হয়েছে সবখানে। আবারও ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্রগুলো নষ্ট করার তত্পরতা চলছে। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, শুধু বাংলা বর্ষবরণের একটি দিনের বাণিজ্য সামনে রেখে সারাটি বছরই সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা তত্পরতা চালাতে থাকেন ইলিশ নিয়ে। এখন বাজারে যেমন দেড়-দুই কেজি আকারের বরফ করা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলোর জোড়া বা একটির দাম হাঁকা হচ্ছে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ যেন এমন কিছু যা বছরের একটি দিন খেলে অমরত্ব লাভ করা যাবে। শহরের বিত্তশালী বা সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঢল নেমেছে ইলিশের বাজারে, যে কোনো মূল্যে ইলিশ কিনতে প্রস্তুত তারা। আর এ সুযোগে দেশের সব কটি নদী থেকে ছেঁকে তোলা হচ্ছে ছা ইলিশ, জাটকা ইলিশ, পোনা ইলিশ সব। ইলিশ নিয়ে মানুষের এ মাতামাতি দেখে মনে হচ্ছে বৈশাখ মানে ইলিশ উৎসব। ইলিশ ছাড়া বৈশাখ যেন অসম্ভব, ইলিশ ছাড়া বৈশাখ যেন রংহীন। কেন বাঙালির কি আর কোনো খাদ্যসামগ্রী নেই? বাঙালির ঐতিহ্যে দেশি সবজি, ফল, খিচুড়ি, ভাজি-ভর্তা, চিঁড়া-মুড়ি-নাড়ু-আচার এগুলো কি নেই? এগুলো কি বৈশাখের অনুষঙ্গ হতে পারে না?

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হচ্ছে ইলিশের প্রজনন মৌসুম আর মার্চ-এপ্রিল ইলিশের জন্য জাটকা মৌসুম। ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র মেঘনা হলেও জাটকা ইলিশের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র মেঘনার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের কীর্তনখোলা, ইলিশা, তেঁতুলিয়া, পায়রা, বিষখালী, আন্ধারমানিক ও শিবসা নদী এবং পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে খুলনার দুবলার চরের উপকূলীয় অঞ্চল। এ সময়ে নদী থেকে জাটকা ইলিশ না ধরলে তা বড় হওয়ার সুযোগ পায়। এ মাসটি পার হলেই নদীতে আর জাটকা আকারের ইলিশ থাকে না। সবই মোটামুটি ৯ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটার আকার ছাড়িয়ে যায়। তখন ইলিশের স্বাদও বাড়তে থাকে। আমরা যে দিনের পর দিন স্বাদহীন অপরিপক্ব ইলিশেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, এগুলো নিয়েই লোক দেখানো সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্ভাসিত হচ্ছি, এগুলো কোনো ভালো লক্ষণ নয়।

ভালো লাগছে, দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশিষ্টজনেরা এবার ইলিশবিহীন বৈশাখ উদ্যাপনের ব্যাপারে বেশ জনসচেতনতামূলক কথাবার্তা বলছেন। তাদের এ সচেতন অবস্থান প্রথমবারের মতো দেশের ইলিশসম্পদ রক্ষার পক্ষে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবার তো সময় শেষ। নববর্ষও এসে গেছে দোরগোড়ায়। কালকের সূর্য ডুবলেই পরশু বাংলা নতুন বছর। ইলিশ নিয়ে বাজার চাউর করে কেনাকাটা, কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য আর একশ্রেণির লোকের প্রতিযোগিতাও সম্পন্ন হয়ে গেছে। তবে সবার মধ্যে বিষয়টি মজ্জাগত হয়ে যাওয়া খুব দরকার, বর্ষবরণ মানে শুধু ইলিশ নয়, বর্ষবরণের আরও অনেক উপাদান আছে। অপরিণত ইলিশ নিয়ে বর্ষবরণ করতে গিয়ে বাঙালির ইলিশের ঐতিহ্য চিরতরে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা-চেতনা থেকে আমাদের ফিরে আসতেই হবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর