বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মান্নার মুক্তিতে বাধা কোথায়?

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

মান্নার মুক্তিতে বাধা কোথায়?

বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান মান্না। স্বাধীনতার গত সাড়ে চার দশকে যেসব রাজনীতিবিদ তাদের পরিশীলিত-পরিচ্ছন্ন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে রাজনীতিতে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন তাদের মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাম উল্লেখযোগ্য। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে তার রাজনীতিতে আগমন ঘটেছিল। ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিতে পরিশুদ্ধ একজন রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন সমাজ পরিবর্তনের, সমাজ বিপ্লবের। সত্তর দশকের শেষ দিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুখোড় ও জাঁদরেল ছাত্রনেতা হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হতো মান্না তাদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) দুবারের নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবনে জাসদ ও বাসদের সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে অভিসিক্ত হন আওয়ামী লীগে যোগদানের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক পরিপক্বতা, দক্ষতা ও যোগ্যতার গুণেই এমন একটি বড় দলের বড় পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি।

বলা হয়, ছাত্রজীবনে মাহমুদুর রহমান মান্না যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণের বটতলায় বক্তৃতা দিতেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুধু নয়, শিক্ষকরা পর্যন্ত তার বক্তব্য কলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে শুনতেন। বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্র-জনতা সবাইকে মোহবিষ্ট করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। অর্থবিত্ত পদ-পদবির মোহ তাকে কখনো আকৃষ্ট করেনি। নির্মোহচিত্তে সৎ রাজনীতি করাই ছিল তার ব্রত। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, জনগণের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন অবিচল। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হলে তিনি নিজ দলের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করতেও কখনো দ্বিধান্বিত হননি। এ কারণেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে সুশীল সমাজের বিবেকবান ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন নাগরিক ঐক্য। আর এই নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক হিসেবে ক্ষমতাসীনদের অন্যায়, অপকর্মের তীব্র সমালোচনা করে আসছিলেন তিনি। সরকারের সমালোচনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান তাকে রাজনৈতিক বোদ্ধা ও বিশ্লেষক হিসেবে মিডিয়ার বদৌলতে আরও বেশি পরিচিত করে তুলে। তার অনুসারীরা মনে করেন গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা, সরকারের সমালোচনায় স্পষ্টবাদিতা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালে গত ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে দেশের এ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর থেকেই তিনি কারান্তরালে রয়েছেন এবং তা প্রায় বছর পার হয়ে গেল। শোনা যায় কারাভ্যন্তরে তাকে সাধারণ কয়েদির সঙ্গে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার ফলে নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মানুষটি অসহায় অবস্থায় করুণভাবে দিন যাপন করছেন।  বস্তুত এক টেলিফোনে কথোপকথনের অজুহাতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মান্নাকে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর গত ২১ মার্চ মহামান্য হাইকোর্ট মাহমুদুর রহমান মান্নাকে কেন জামিন দেওয়া হবে না মর্মে এক রুল জারি করে তিন সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে কারণ দর্শাতে বলেছেন। এ কারণ দর্শানোর জবাব সরকার কবে দেবে এবং আদালত থেকে তিনি কবে জামিনে মুক্তি পাবেন তা এখনো অজানা। তবে ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে বলতে চাই, যদি মান্নার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তার বিচার হোক। বিচারে যদি তার শাস্তি হয় তাহলে শাস্তি ভোগ করবেন, আর যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন— এটাই হয়তো ন্যায় বিচারের নিয়ম। কিন্তু এভাবে মাসের পর মাস বিনা বিচারে কারাগারে আটকে থাকা কতটা সমীচীন তা বোধকরি সবাইকে কিছুটা হলেও বিচলিত করে, ভাবিয়ে তুলে। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে মান্নার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তবে এ বিষয়ে প্রচলিত আইনে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট করে বলা আছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলতে কী বুঝায়। যদি সে ধরনের অপরাধ তিনি করে থাকেন তবে অবশ্যই বিচার হবে। পক্ষান্তরে আমাদের সংবিধানে বাকস্বাধীনতার কথাও বলা হয়েছে। সেই বাকস্বাধীনতাটা কোন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ সেটাও বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। এ বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়, শুধু মাহমুদুর রহমান মান্না নয় দেশের প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক ও অসংখ্য নেতা-কর্মী আজ মাসের পর মাস জেলে রয়েছেন। জেলে রয়েছেন দুজন সিনিয়র সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও শওকত মাহমুদ। তাই দেশটি যেন আজ কারাগারে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করছে সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা। তারা মনে করছেন এটাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা। বিরোধীপক্ষ বা সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে গ্রেফতার কর এবং কারাগারে বন্দী রাখ রাজনীতির এই ভয়াল চিত্র আগে কখনো দেখা যায়নি বলেও তাদের অভিযোগ। বিরোধী দল ও মতের প্রতি এ ধরনের দমন-পীড়নের কালচার দেশবাসী মনে হয় এই প্রথম প্রত্যক্ষ করছে। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা না থাকলে সেখানে উগ্রবাদ জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। এটা শুধু আমার কথা নয়, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা পর্যন্ত বলছে। তারপরও সরকার এ নিয়ে ভাবছে না। সরকার কারোর কথায় কর্ণপাত করছে না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে বেপরোয়া আচরণ করে যাচ্ছে তারা। ফলত বাংলাদেশ এখন এক কর্তৃত্ববাদী শাসনের জাঁতাকলে পড়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে। তাই বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগে কোন অন্ধ গহ্বরে যাচ্ছে আমাদের রাজনীতি। ক্ষমতাসীনদের একক কর্তৃত্ব, বেপরোয়া, অমানবিক এবং অপ্রত্যাশিত আচরণের কারণে রাজনীতির আর স্বাভাবিক পরিবেশ থাকছে না। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করার অধিকার শুধু সরকারি দলের, বিরোধী দলের ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তি ও নানারকম হয়রানি। আর সরকারের সমালোচনা করলেই তো কথা নেই মামলা-হামলা-গ্রেফতার যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দলের সভানেত্রী ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনীতি চর্চার সুযোগ  থেকে বঞ্চিত করছে। এ ধরনের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড জনগণকে উগ্রপন্থা এবং সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কেননা মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে উগ্রপন্থা-জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা, গুম, জেল-জুলুম, হুলিয়া যেভাবে নেমে এসেছে তাতে করে এ জনপদে শান্তি রক্ষা করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যনতুন আইন করে আলোচনা-সমালোচনার পথ রুদ্ধ করা কতটা যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক সে বিষয়গুলোও আজ গভীরভাবে ভাবার বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাই তো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়— ‘দ্বাররুদ্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি কোথা দিয়ে ঢুকি’। বাংলাদেশের অবস্থাও আজ এ জায়গায় উপনীত হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, সরকার হামলা-মামলা গ্রেফতার দিয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যেমন বদ্ধপরিকর তেমনিভাবে গত সাত বছরের শেয়ারবাজার, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ, ডেসটিনির আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রাজকোষ বা রিজার্ভের হাজার হাজার কোটি টাকার চুরির কোনো হদিস করতে পারছে না। আর্থিক কেলেঙ্কারির একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি, কেউ শাস্তি পায়নি। অথচ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার এমন কৌশল ও অভিনব পদ্ধতি আগে কখনো দেখা যায়নি। এ ধরনের রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা ভেবে দেখার বিষয়। বিরোধী মতকে দমনের রাজনীতির প্রতিফল ক্ষণিক ভালো হলেও সার্বিক অর্থে সুখকর নয়। এর ফলাফলও কখনো ভালো হয় না। তাই দমন-পীড়নের এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। উদারনৈতিক গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে সব ধরনের বিরোধী মতের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। আলাপ-আলোচনা-সংলাপের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। কেননা রাজনৈতিক অস্থিরতা কখনো একটা দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে না। ১৬ কোটি অধ্যুষিত এ জনপদের ৯ কোটি ভোটারের অর্ধেক যদি বর্তমান সরকারের পক্ষে হয় আর অর্ধেক অবশ্যই ভিন্নমতের অনুসারী। এ বিশ্বাস সবার থাকতে হবে। তাই ভিন্নমতকে গ্রেফতার ও ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে কিছুদিন হয়তো আটকে রাখা যাবে কিন্তু অনন্তকাল নয়। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে বটে কিন্তু তাদের আদর্শকে হত্যা করা যায়নি।

পরিশেষে বলা যায়, বিরোধী মত ও পক্ষকে টার্গেট করে গ্রেফতার, মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের দ্বারা নিপীড়ন-নির্যাতন, রাজনৈতিক স্পেস সংকুচিত করে বিরোধী মতকে বিপর্যস্ত-পর্যুদস্তকরণ কোনোটাই আজকের যুগে মানানসই নয়। বরং এতে করে হীতে বিপরীত হতে পারে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বন্দী করে জনগণকে উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তা জনমনে স্বস্তি আনতে পারছে না। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়। বিরোধী পক্ষ ও মতকে দমনের ফলে সরকারি দলের অভ্যন্তরে যে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর জন্ম নিচ্ছে তা জাতিকে এক ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সে বিপদ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। তাই উদারচিত্তে বলতে চাই, শুধু মাহমুদুর রহমান মান্না নয় এভাবে কাউকে আটক রেখে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যাবে না। জনপ্রিয়তা তৈরি হয় গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীলতার কারণে। এদেশের মানুষ সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতেই অভ্যস্ত। কোনো অগণতান্ত্রিক কৌশল এদেশের মানুষের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। অগণতান্ত্রিক আচরণই এদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা। ইতিহাস তা বার বার প্রমাণ করেছে। তাই আসুন সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন অব্যাহত রাখার কার্যক্রমে শামিল হই। কোটি কণ্ঠে বলি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।

ই-মেইল: [email protected]

সর্বশেষ খবর