বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

মতান্ধ ধর্মান্ধ ও মুক্তচিন্তা

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

মতান্ধ ধর্মান্ধ ও মুক্তচিন্তা

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য চিরায়ত বাংলার মীমাংসিত বিষয়কে দৃঢ় করেছে। বলা যায় প্রান্তিক দুই জনগোষ্ঠীকে সংঘাত থেকে বিরত থাকার সুপরামর্শ দিয়েছেন। বক্তব্যের প্রথম পরামর্শটি যারা অন্ধ মতে বিশ্বাসী বা মতান্ধ তাদের জন্য। দ্বিতীয়টি ধর্মান্ধদের জন্য। মতান্ধদের সুপরামর্শে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুক্তচিন্তার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়, একটা ফ্যাশন দাঁড়িয়ে গেছে, ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেই তারা হয়ে গেল মুক্তচিন্তার মানুষ। তারা বনে গেল প্রগতিশীল।

আমি তো এখানে মুক্তচিন্তা দেখি না। বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষ খুন করার মধ্যে কোনো সমাধান নেই। একজন লিখল, আরেকজন খুন করে সেটার প্রতিশোধ নেবে, এটাও ইসলাম ধর্ম বলেনি। প্রধানমন্ত্রী  আরও বলেন, ‘আমি একজন মুসলমান হিসেবে প্রতিনিয়ত আমার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। সেখানে কেউ যদি এর বিরুদ্ধে লেখে, কটূক্তিমূলক কথা বলে, এতে আমার নিজেরও কষ্ট হয়। আর এই লেখার জন্য কোনো অঘটন ঘটলে দোষ সরকারের ওপর আসবে কেন? সবাইকে সংযমতা নিয়ে চলতে হবে।

জননেত্রী লাখো হৃদয়ে চেপে থাকা ব্যথা-বেদনার কথাটিই বলেছেন। তার জ্ঞান-প্রজ্ঞার ও যুক্তির প্রশংসা করছি না, একজন রাষ্ট্রনায়কের হৃদয়জুড়ে যে সব নাগরিকের মর্যাদা আছে তা স্পষ্ট করছি। এ দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি যেমন জরুরি তেমনি ধর্মকর্ম যারা পালন করবে তাদের সুযোগ দেওয়াও তেমনি জরুরি। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া মুক্তবুদ্ধির চর্চা নয়; আবার ভিন্নমতের কাউকে হত্যা করাও চরম অন্যায়। ইসলাম বরাবরই মতপ্রকাশের পক্ষে, উগ্রতার বিপক্ষে। ধর্মপ্রাণ মানুষকে যেমন আঘাত দেওয়া যাবে না। ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে রক্তের নেশায় নির্বিচারে কাউকে হত্যাও করা যাবে না। ধর্ম-দর্শন চিন্তার মেরুকরণ থাকবেই, তাই বলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করা যাবে না। মতান্ধরা মুক্তবুদ্ধির দোহাই তুলে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সমাজের শান্তি নষ্ট করছে, ধর্মান্ধরা ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে মানুষ হত্যা করে সমাজের শান্তি নষ্ট করছে। এই দুই গোষ্ঠীর লোকেরাই সমানভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

যারা ধর্মীয় অনুশাসন মানেন তাদের বুঝতে হবে মানুষ জন্মগতভাবে মুক্তচিন্তার অধিকারী। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানব সন্তান নিজস্ব স্বভাবের ওপর জন্মগ্রহণ করে।’ (মিশকাত শরিফ) ইসলাম মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও ভিন্নমতের সুযোগ রেখেছে। কোরআন বলছে, ‘যার ইচ্ছা সে ইমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কাফের থাকুক, আমি জালেমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি জাহান্নামের আগুন।’ সূরা কাহাফ : ২৯

কোরআনে আরও বলা হয়েছে— ‘দীন সম্পর্কে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, সত্য ভ্রান্তি থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। সূরা বাকারা : ২৫৬ 

কোরআন আরও বলছে, ‘তোমার প্রভু-প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে, তারা সবাই অবশ্যই একসঙ্গে ইমান নিয়ে আসত। তবে কি তুমি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ করবে?’ সূরা ইউনুস : ৯৯

যেখানে মহানবী (সা.)-কে আল্লাহ তায়ালা বলপ্রয়োগ করার অনুমতি দেননি; সেখানে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীরা কীভাবে মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ করবে ধর্মের বিষয়ে? বলপ্রয়োগ করলে কি সে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারী থাকবে?

কোরআনের ভাষ্যমতে এ কথা স্পষ্ট, ইমান গ্রহণ-বর্জনের সুযোগ আছে। সুযোগ নেই কাউকে আঘাত করার। হত্যা করার। মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে মানুষের জন্য, মানুষ কিন্তু ধর্মের জন্য নয়।

সম্প্রতি সহঅবস্থানের দিক থেকে পৃথিবীতে স্বাধীন বাংলাদেশ উজ্জ্বল মানচিত্র। একই সময়ে মসজিদে আজান হলে মন্দিরে উলু ধ্বনি হয়। এই দেশে কোনো ধর্মীয় দাঙ্গা নেই। আছে অভূতপূর্ব ধর্মীয় সম্প্রীতি। মসজিদ-মন্দির পাশাপাশি অবস্থান করলেও কোনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটে না। যা ঘটে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সম্প্রীতিবিনাশী ধর্মান্ধ ও মতান্ধদের থেকে দেশ ও সমাজ কবে মুক্তি পাবে? কবে পূর্ণতা পাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ! আমরা সেই স্বর্ণালি দিনের অপেক্ষায়।

এই দেশে জাত-বর্ণ নির্বিশেষে একসঙ্গে বসবাস করবে মানুষ। কোনো বিভেদ-বিরোধে প্রাণ হারাবে না মানুষ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্তিতে সবাই হাতে হাত রেখে কাজ করবে। আপ্রাণ চেষ্টা করে এগিয়ে নেবে বাংলাদেশকে। এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চলছে বর্তমান সরকার এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সুপরিকল্পিত এ চিন্তা ও কাজের বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে আরও উজ্জ্বল। আরও সম্ভাবনাময়ী।

  লেখক : সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

সর্বশেষ খবর