বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

আদি পাপের ফয়সালা হোক আগে

মোশাররফ হোসেন মুসা

আদি পাপের ফয়সালা হোক আগে

আব্রাহামিক ধর্মসমূহে বিশ্বাস করা হয় আদম-হাওয়ার আদি পাপের কারণে মনুষ্য জাতির জন্ম ঘটেছে। ফলে মানুষ জন্মগতভাবেই পাপী। সেজন্য তাদের সর্বক্ষণ সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে শুদ্ধ থাকার নিয়ম রয়েছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেও কিছু আদি পাপ রয়েছে, যার ফয়সালা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন কিংবা কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র কোনোটাই পাওয়া যাবে না। আগামী জুনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ছয় ধাপে চার হাজার ২৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপের ৭১৭টি এবং গত ৩১ মার্চ দ্বিতীয় ধাপের ৬৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এ দুই ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীসহ ৪০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

তাছাড়া বেশ কিছু মানুষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনগুলোতে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটবে এবং বহু নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দলীয় ক্যাডাররা প্রতিপক্ষের প্রার্থী ও তাদের সমর্থক ভোটারদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন শুরু করে। পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে হানাহানি, জালভোট প্রদান ও জবরদস্তিমূলক ঘটনা ঘটেছে। প্রথম আলোর জনৈক প্রতিবেদক দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে একটি রিপোর্টে বলেছেন—সেখানকার দলীয় ক্যাডাররা দুই লাইনের একটি ছড়া ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রতিষ্ঠা করে। ছড়াটি হলো—‘চেয়ারম্যানের ভোট ওপেনে, অন্যদের ভোট গোপনে’ (প্র.আলো ২৩ মার্চ, ১৬)। এর আগে দলীয় ভিত্তিতে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও বহু জায়গায় প্রকাশ্যে মেয়র প্রার্থীকে ভোট প্রদান করতে দেখা গেছে। এরকম অনিয়ম দেখে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন— ‘সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ফেরাতে দুই যুগ সময় লাগবে’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ মার্চ, ১৬)। এনজিও ‘সুজন’-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ‘প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন : দৃশ্যপট ও শিক্ষণীয়’ শীর্ষক এক কলামে বলেছেন-‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ ও ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস্-এর মানদণ্ড অনুযায়ী এ নির্বাচন কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নয়।’ মানদণ্ডের বিষয়গুলো হচ্ছে— ১. ভোটার তালিকা প্রস্তুতের প্রক্রিয়ায় যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য ছিলেন তারা প্রার্থী হতে পেরেছেন; ২. যারা প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তারা প্রার্থী হতে পেরেছেন; ৩. ভোটারদের সামনে বিকল্প প্রার্থী ছিল; ৪. যারা ভোট দিতে চেয়েছেন, তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন এবং ৫. ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য (ইত্তেফাক, ৩০ মার্চ ১৬)। উল্লেখ্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া নির্বাচনে উপরিউক্ত মানদণ্ড রক্ষা হয় কীভাবে! অথচ তারা কেউই বলেননি এটি আমাদের আদি পাপের ফসল। আবার সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই যে একটি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে সে বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। বর্তমান পাকিস্তান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেহেতু গণতন্ত্র শুধু আকাঙ্ক্ষার বিষয় নয়, এটি প্রত্যহ লালনের বিষয় এবং সর্বস্তরে বাস্তবায়নের বিষয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকরা সমাজতন্ত্রে কিংবা গণতন্ত্রে মুক্তি খুঁজলেও আমাদের পূর্বসূরিরা দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি করেন। নাম দেওয়া হয় ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’। অর্থাৎ শুরুতেই গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তখন তারা প্রকাশ্যেই বলতেন- গণতন্ত্র হলো ‘কুফির’ আর সমাজতন্ত্র হলো নাস্তিকদের মতবাদ। কিন্তু কয়েক বছর পরই এদেশের নেতারা বুঝতে পারেন পাকিস্তান সৃষ্টির তত্ত্ব ‘ফাঁকাতন্ত্র’ ছাড়া কিছুই নয়। শুরু হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসনের দাবি চরমে ওঠে। ৭০ সালে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়। সেজন্য কেউ কেউ ইয়াহিয়া সরকারের প্রশংসা করেন। কিন্তু তারা ভেবে দেখেন না, বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তিনি নিজেই নিজের অর্জনকে পদদলিত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা না পেয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; শুরু হয় রক্তক্ষয়ী এক অসম যুদ্ধ। সে কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের কারণে রাজনীতিকরা স্বাধীনতার পর শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তাদের চাওয়ার মধ্যে গণতন্ত্র ছিল কিনা, প্রশ্ন করার সময় এসেছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন হলো একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়।

জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। আর সেই প্রতিনিধিরা বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সরকার পরিচালনা করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরেই ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচনটি সুষ্ঠু করতে ব্যর্থ হন বাংলাদেশের স্থপতিরা। একই কারণে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দলের জন্মও ঘটেনি। তারা গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্টকেন্দ্রিক) করা হয়। আমাদের বিজ্ঞ (!) সংবিধান রচয়িতারা মাত্র সিকি পাতায় স্থানীয় সরকারের প্রসঙ্গ শেষ করেন। তারপরেও এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি আশা ত্যাগ করেননি। কিন্তু ৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সে স্বপ্নকে কবর দেওয়া হয়। পরবর্তী ইতিহাস সবার কম-বেশি জানা রয়েছে। সেজন্য বলা উচিত আমরা যদি একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই, তাহলে সবাইকে ভুল স্বীকারোক্তি দিতে হবে এবং আদি পাপগুলো চিহ্নিত করে তা মোচনের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে একবিংশ শতাব্দী উপযোগী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ডিজাইন।

     লেখক : গবেষক।

     ই-মেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর