শনিবার, ৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাননীয় মন্ত্রী! ফোন দুটো নিয়ে নিন!

গোলাম মাওলা রনি

মাননীয় মন্ত্রী! ফোন দুটো নিয়ে নিন!

আমার এক সময়ের সহকর্মী এবং সতীর্থ অ্যাডভোকেট তারানা হালিম যখন মন্ত্রিত্ব পেলেন তখন তার অন্যান্য শুভার্থীর মতো আমিও বেজায় খুশি হয়েছিলাম। তিনি যখন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন তখন তাকে উদ্দেশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি কলাম লিখেছিলাম। একটি জরাজীর্ণ মন্ত্রণালয়ের অপকর্মের খতিয়ান শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই।  সেখানে আমি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নানা অনিয়ম, অপকর্ম, দুর্নীতি এবং গ্রাহক হয়রানির ফিরিস্তি বর্ণনা করতে গিয়ে আমার বাসার দুটো ল্যান্ডফোনের করুণ কাহিনীর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলাম। আশা ছিল, নতুন মন্ত্রী তার সহজাত প্রখর বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতা দ্বারা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে গতিশীলতা সৃষ্টি করবেন এবং বোনাস হিসেবে আমার ফোন দুটোও ব্যবহার উপযোগী করে দেবেন। নিবন্ধটির বরাতে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে কতটুকু কাজ হয়েছিল তা বলতে পারব না কিন্তু আমার ৯৬৬৫১০৮ এবং ৫৮৬১০১২৯ নম্বর দুটোর কপালে এবং আমাদের পারিবারিক-সাংসারিক জীবনে যে কতটা দুর্ভোগ নেমে এসেছে তা মন্ত্রী মহোদয়কে না বললেই নয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে মন্ত্রী তারানা হালিম এবং তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।

তারানা যে মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব লাভ করেছেন সেটির বহুমুখী তাত্পর্য এবং নানামুখী স্পর্শকাতরতা রয়েছে। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। পদ-পদবিতে যদিও তিনি প্রতিমন্ত্রী কিন্তু কার্যত তিনিই সব কিছুর সর্বেসর্বা। কারণ তার উপরে কোনো পূর্ণমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে নেই। এটি বাংলাদেশে একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মন্ত্রণালয়ে যদি কোনো পূর্ণ মন্ত্রী না থাকেন এবং প্রতিমন্ত্রী এককভাবে দায়িত্ব পালন করেন তবে ধরে নেওয়া হয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত।

আমার মতে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজাত এবং বনেদি মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের বিশ্বাস, ভালোবাসা, গোপনীয়তা এবং পারস্পরিক যোগাযোগের একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো এই মন্ত্রণালয়। সেই হাজার বছর আগে শুরু হওয়া ঘোড়ার দৌড়ের ডাক ব্যবস্থা, কিংবা আব্রাহাম গ্রাহাম টেলিফোন আবিষ্কারের পর মানুষের গোপন আকুতি, প্রেম, ভালোবাসা, প্রণতি, জীবন-মরণ এবং বেঁচে থাকার কথামালা এই দুটি মাধ্যম দিয়েই পৃথিবীবাসী একজন অন্যজনকে জানিয়েছেন। একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা চাতক পাখির মতো কীভাবে ডাক পিয়নের জন্য বসে থাকত অথবা টেলিফোনে প্রিয়তমা, প্রিয়জন, মমতাময়ী মা, তার সন্তানের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অপেক্ষা করেন তা কেবল মনুষ্য আত্মাই হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। আধুনিককালের মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের সুবিধাভোগী এবং সেবাগ্রহণকারীরা সব সময়ই অভিজাত, সচ্ছল, শিক্ষিত এবং চিন্তাশীল জনগোষ্ঠী বলে বিবেচিত হয়। ৭০, ৮০ কিংবা ৯০-এর দশকে কারও বাসায় একটি ল্যান্ডফোন থাকলে সমাজ তাকে অভিজাত, ধনাঢ্য এবং রুচিশীল বলেই ভাবত। অন্যদিকে সেই আদিকাল থেকেই সংবেদনশীল শিক্ষিতজনরা তাদের আপনজনের কাছে চিঠিপত্র লিখত। চিঠি লেখা কিংবা চিঠি পাওয়া উভয়ই ছিল সম্মানের ব্যাপার। চোর, চোট্টা, গুণ্ডা বদমাশরা ওসব করত না। পরবর্তীতে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট চালু হলে সমাজের সচ্ছল, শিক্ষিত এবং ভদ্র লোকেরাই সর্বপ্রথম এগুলো ব্যবহার আরম্ভ করে। একটি মাত্র ফোন অথবা একটি মাত্র পত্র সঠিক সময়ে সঠিক লোকের কাছে পৌঁছানোর ফলে মানুষের যে কতটা উপকার হতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে মাত্র একটি ফোনকল সময়মতো না করতে পারার কারণে কত যে জীবন ঝরে পড়েছে, কত ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে কিংবা কত পরিবার ভেঙে গেছে তা কোনো পাশবিক হৃদয় কল্পনাও করতে পারবে না। আমি আশা করেছিলাম, তারানা প্রথমেই ডাকবিভাগকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করবেন। ডিএইচএল, ইউপিএস, ফেডেক্স অথবা এয়ার ব্রন এক্সপ্রেসের সফলতা, অবকাঠামো, বাণিজ্যিক কর্মপরিকল্পনার আদলে ডাক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করবেন। তিনি ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকটিকে দেশের এক নম্বর সঞ্চয়ী ব্যাংকে পরিণত করবেন। তিনি ভিওআইপি বন্ধ করবেন, তার দলের প্রভাবশালী যেসব নেতা এবং নেতানেত্রীর পুত্রকন্যা বিটিআরসির হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে সেগুলো উদ্ধার করবেন এবং দেশের একমাত্র সাবমেরিন কেবলটির সংযোগস্থলে ভিম্যাট স্থাপনের মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, যাতে কেবল কাটা পড়লেও যেন ইন্টারনেট ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়। তিনি টিঅ্যান্ডটি বা হাল আমলের বিটিসিএলকে আধুনিকায়ন করবেন, জনপ্রিয় করবেন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মোবাইল ফোনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ল্যান্ডফোনের বিজয় ধরে রাখবেন। তিনি তার কাজের জন্য উত্তম সাহায্যকারী এবং শিক্ষা পরামর্শকদের খুঁজে নেবেন। তিনি অনাহূত কথা, কাজ এবং অবাস্তব পরিকল্পনা থেকে দূরে থাকবেন এবং যেসব বিষয় তিনি বোঝেন না সেসব বিষয়ের ধারেকাছেও যাবেন না।

 

 

আমি তারানার কাছে ভালো কিছু আশা করেছিলাম, তার ভালো মানুষী চরিত্র এবং মেধাদীপ্ত মন-মানসিকতার জন্য। আমি তার সফলতা কামনা করেছিলাম এ কারণে যে, তিনি তার প্রতিটি কর্মে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীতনয়ের সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সম্ভাবনার দিকে না গিয়ে এমন সব বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন যা তার আদৌ দরকার ছিল না। তিনি এমন সব বিষয় করতে চাইলেন যা তার করণীয় ছিল না এবং তার পক্ষে করাও সম্ভব ছিল না। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুক বন্ধ করা, ফেসবুক নিয়ে নানা কথা, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার এবং আবার তা চালু করার মধ্যে তিনি কোনো সফলতা তো পাননি উল্টো ইমেজ হারিয়েছেন। তাকে নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখতেন সেই শুভার্থীরা মনে মনে আহত হয়েছেন। এরপর তিনি অবৈধ সিম বিক্রি বন্ধ করার জন্য মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মতো রাস্তায় নেমে পড়লেন। ফলাফল হলো উল্টো। তিনি অবৈধ সিম বিক্রি বন্ধ করতে পারলেন না। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি যেমন বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। সমালোচনার পাত্রীতে পরিণত হলেন।

তারানার তৃতীয় এবং সর্বশেষ আলোচিত এবং সমালোচিত কর্মটি হলো বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক নিয়ম চালু। এ ব্যাপারে তিনি কতটা চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অথবা কি কারণে তিনি এসব করছেন তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের একজন পথিক হিসেবে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না যে, মাননীয় মন্ত্রীর সাম্প্রতিক মহাযজ্ঞটি দ্বারা দেশ-জাতি কিংবা জনগণের আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা? কিন্তু আমি এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এদেশে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশনের ফলে এমন সব ফ্যাতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি হবে যা সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। মোবাইল সিম ব্যবহার করে অপরাধকারীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যারা আঙ্গুলের ছাপ সংরক্ষণের চিন্তাটি মন্ত্রীর মাথায় ঢুকিয়েছেন তারা যদি একবারের জন্যও নিম্নের বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন তবে অবশ্যই ও পথে পা মাড়াতেন না।

১. সাধারণত ছোটখাটো চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি অথবা অন্যান্য অপরাধে জড়িত বোকাসোকা প্রকৃতির ছিঁচকে অপরাধীরা মোবাইলের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করত। পুলিশ অভিযোগ পাওয়া মাত্র তাদের ধরে ফেলত। ফলে এসব অপরাধ এবং অপরাধী উভয়ই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বড় মাপের অপরাধীরা সিম ক্লোন করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা শনাক্ত করার শক্তি সামর্থ্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই। অন্যদিকে কিছু অপরাধী বিদেশি সিম রিম ব্যবহার করে। কেউ কেউ আবার স্যাটেলাইট ফোন পর্যন্ত ব্যবহার করে যা শনাক্ত করার প্রযুক্তি বাংলাদেশ তো দূরের কথা— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও নেই।

২. বায়োমেট্রিক পদ্ধতি সম্পন্ন হওয়ার পর নতুন নতুন অপরাধ, প্রতারণা এবং জাল-জালিয়াতির বিরাট এক দিগন্ত সৃষ্টি হয়ে যাবে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন রাজনীতিবিদ, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং নিরীহ মধ্যবিত্ত ভদ্র সমাজ। সুন্দরী মেয়ে, গৃহবধূ কিংবা সুদর্শন যুবকরাও অপরাধীদের জালের মধ্যে আটকা পড়ে যাবেন। একজন রাজনৈতিক নেতার প্রতিপক্ষ কোনো কোম্পানির কোনো কর্মচারীকে ম্যানেজ করে একাধিক সিম উঠিয়ে নিল। তারপর যা যা করার তা করে মনের সুখে বগল বাজাতে থাকল। পুলিশ তদন্তে নেমে দেখল ওমুক লোকের সিম থেকে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অথচ তিনি তার কিছুই জানতেন না।

৩. বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলো এদেশে বিনিয়োগ করেছে সুরক্ষিত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে। তারা কোনো মন্ত্রী তো দূরের কথা— বাংলাদেশকেও পাত্তা দেয় না। তারা তাদের ব্যবসায়িক প্রতিযোগীকে টেক্কা দেওয়ার জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই সরকারি লোকজনকে ম্যানেজ করে চলে। তাদের সিস্টেম সার্ভার পৃথিবীব্যাপী একই বারকোডে সমভাবে চলে। যেমন গ্রামীণফোনের মালিক নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি। পৃথিবীর যেসব দেশে টেলিনরের ব্যবসা রয়েছে সেসব দেশের সব সার্ভার ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন মতো একে অপরের সার্ভারে ঢুকে যেতে পারে। ফলে বাংলাদেশি মোবাইল গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ এখন দুনিয়ার সর্বত্র পাওয়া যাবে।

৪. মোবাইল কোম্পানিগুলোও মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে। তাদের রিটেইন শপে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রবল মাত্রায় দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়বে এবং অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নেবে এবং টার্গেটেড লোকের নামে সিম উঠিয়ে ওইসব লোকের প্রতিপক্ষের কাছে তা চড়া দামে বিক্রি করে উধাও হয়ে যাবে। সিম সংক্রান্ত সাইবার অপরাধের পাশাপাশি আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে মিথ্যা দলিল দস্তাবেজ তৈরি, একজনের কৃত ফৌজদারি অপরাধে অন্যের আঙ্গুলের ছাপ বসিয়ে দিয়ে নিরীহ লোককে ফাঁসানো, প্রতারণা, লোক ঠকানো, ভয়ভীতি প্রদর্শনের নয়া বাণিজ্য চালু হয়ে যাবে।

৫. জাতীয় সংসদের কোনো সুনির্দিষ্ট আইনের দ্বারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে যে আইনই চালু থাকুক না কেন বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হবে জাতিসংঘের ডব্লিউটিও অনুযায়ী। সরকার বাড়াবাড়ি করলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে চলে যাবে। ফলে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হলে মন্ত্রী যে ৩০০ কোটি টাকা জরিমানার কথা বলছেন তা আদায় করা অসম্ভব। এর বাইরে অন্য ঝুঁকিও রয়েছে। যে কোনো কোম্পানি যে কোনো সময় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারে অথবা অন্য কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থে একীভূত হতে পারে। এক্ষেত্রে কোটি কোটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপের কী হবে?

৬. এখন থেকে মোবাইল সন্ত্রাসীদের স্বর্ণ সময় শুরু হয়ে যাবে। অপরাধ করবে একজন এবং দায় পড়বে অন্যের ঘাড়ে। পুরো দেশের আর্থিক ব্যবস্থা, ব্যক্তির গোপনীয়তা মান-সম্মান, জায়গা সম্পত্তি এখন প্রতারকদের খপ্পরের মধ্যে পড়ে গেল। কেউ যদি জানে ওমুক ওমুক হাতের আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ লুট করা যাবে— অথবা ওমুক ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেলে তার বিষয় সম্পত্তি দখল করা যাবে তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে। মৃত ধনবান ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ জোগাড় করে কোনো মহিলা এসে বলতে পারে আমি তার বৈধ বিবাহিত স্ত্রী— আমাকে গোপনে বিয়ে করা হয়েছিল! অথবা কোনো ভুঁইফোড় সংগঠন বলতে পারে যে, মৃত ব্যক্তি তার যাবতীয় সম্পত্তি তাদের উইল করে দিয়ে গেছে।

৭. বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, সুশীল সমাজের লোকজন কেউই তাদের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করাবেন না— তাদের সেটা লাগবেও না। কোনো অপরাধী, দাগী আসামিও সিম রেজিস্ট্রেশন করবে না। ইতিমধ্যে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় এক কোটি সিম রেজিস্ট্রেশন হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন বাবদ ৫০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। যদি যাতায়াত ভাড়া এবং শ্রম ঘণ্টার মূল্য ধরা হয় তবে এ কাজে খরচ হয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের সাধারণ মানুষ যারা সব সময় আইন মান্য করে, রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকে এবং রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে তারাই মন্ত্রী তারানা হালিমকে সম্মান করে নির্দ্বিধায় লাইনে দাঁড়িয়ে বহু কষ্ট করে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। অথচ এ লোকগুলো যখন বিপদে পড়বেন তখন মন্ত্রী তাদের জন্য কিছুই করতে পারবেন না কেবল নিজের সংবেদনশীল চোখের অশ্রুবর্ষণ ছাড়া...

মন্ত্রী তার আপন আলয়ে বলতে গেলে কর্মহীন একজন মানুষ। তিনি বিটিআরসি, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি, বিটিসিএল, ডাক বিভাগ, টেলিটক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত লক্ষ কোটি সমস্যার দিকে নজর দিয়েছেন এমন খবর পত্র- পত্রিকায় আসেনি। তার কথায় তার অধীনস্থ কোনো বিভাগ অনুবিভাগ কীভাবে কাজকর্ম করে তা আমার টেলিফোন দুটোর হালনাগাদ অবস্থা বর্ণনা করলেই জানা যাবে। নিজের অধীনস্থ লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ, শাস্তি প্রদান অথবা সেবা প্রদানে বাধ্য করার দক্ষতা অর্জনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ যদি অন্যের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনতে যান তবে তার পরিণতি কীরূপ হবে তা অনুধাবন করার ভার পাঠকদের দিয়ে আমি এবার আমার ফোন দুটির কাহিনী বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানছি!

আমার বাসার ফোন দুটির ১৫ বছরের অচলাবস্থা, দুর্ভোগ এবং হয়রানির খবর প্রকাশের তিন/চার দিন পর কয়েকজন বিটিসিএল কর্মকর্তা-কর্মচারী আমার বাসায় এলেন। সারাদিন গবেষণা করে বললেন— কিছু তার লাগবে এবং একটি নতুন সেট লাগবে। আমি ব্যবস্থা করলাম। এভাবে পাঁচ/ছয় দিন চলে গেল— ফোন দুটির একটিও সচল হলো না। আমার ব্যক্তিগত সচিব একজন জিএমের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি জানালেন— কিছু সমস্যা আছে। আমি স্যারের অফিসে এসে সাক্ষাতে সব বলব। এক সপ্তাহ চলে গেল তিনি আর এলেন না— ফোনও ঠিক হলো না। এ ঘটনার কয়েক দিন পর দুই/তিনজন কর্মকর্তা হঠাৎ বাসায় গেলেন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে অনেক কথা বললেন এবং তারা বসে থেকেই ফোন দুটি সচল করে দিলেন। আমি রাতে গিয়ে এই সুসংবাদ শুনলাম এবং মন্ত্রীর জন্য প্রাণভরে দোয়া করতে শুরু করলাম।

টেলিফোন নিয়ে আমার সুখানুভূতি স্থায়ী হলো না। সাত/আট দিন পর আবার অচল হলো, অভিযোগ করলাম। আবার এসে ঠিক করে দিল। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে পালা করে নষ্ট হয় আর আমি পালা করে অভিযোগ দাখিল করি। আমার অফিস থেকে অভিযোগ করলে বলা হয়— ও রনি স্যারের নম্বর! আচ্ছা দেখছি! উনি তো আবার মন্ত্রীর লোক!  এভাবে গত ১০ মাসে কমপক্ষে একশবার ফোন বন্ধ করা হয়েছে এবং আমি একশবার অভিযোগ দাখিল করেছি। মন্ত্রী মহোদয়ের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি— ফোন দুটি গত তিন সপ্তাহ ধরে অচল ছিল— তিন/চারবার অভিযোগ করেও সচল করা যায়নি। নিবন্ধটি লিখে বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় ফিরে দেখি ফোন দুটি আকস্মিকভাবে সচল হয়ে গেছে।  ভাবছি— মন্ত্রী মহোদয় বরাবরে দরখাস্ত লিখে নিবেদন জানাব ফোন দুটি নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং আমার বাসার পরিবর্তে তার অফিসে সংযোগ প্রদান করার জন্য, যাতে করে ওই দুটি নম্বরের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন সরাসরি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর