শনিবার, ৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ঘাম শুকিয়ে যায় মজুরি পান না শ্রমিক

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ঘাম শুকিয়ে যায় মজুরি পান না শ্রমিক

কথা ছিল ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমের মজুরি পাবেন শ্রমজীবী। দৃশ্যত শ্রমের মজুরি পেতেই পৃথিবীজুড়ে ঘাম ঝরছে শ্রমিকের। এ সংবাদ গোটা পৃথিবীর।  তাই তো দেশে দেশে হচ্ছে শ্রম সংগঠন। শ্রম আন্দোলন। এত কিছুর পরেও শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন কী? থেকেই যাচ্ছে এ প্রশ্ন। ঘাম শুকানোর  আগেই শ্রমিক মজুরি পেলে তবেই হবে আধুনিক বিশ্ব গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। না হলে প্রযুক্তি যতই এগোবে এতে আরও পিছিয়ে পড়বে শ্রমজীবী। কেননা আমাদের ওই প্রযুক্তি তো শ্রমিকদের দিয়েই বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। তারা ক্ষুধার্ত থাকা মানে গোটা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কষ্টে থাকে। তাই নবী (সা.) সব শ্রেণির শ্রমের মূল্য শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই পরিশোধ করতে বলেছেন।

শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ধর্ম ইসলাম শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি অধিকার ও সুবিধা দিয়েছে। ইসলামে মালিক-শ্রমিকের কোনো বৈষম্য নেই। শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পূর্ণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ইসলাম। ইসলাম একদিকে শ্রমের প্রতি উৎসাহিত করেছে, অপরদিকে শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘ব্যক্তির জন্য নিজ হাতের উপার্জনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপার্জন আর কিছু নেই।’ (বুখারি)। ওমর (রা.) প্রায়শই বলতেন, ‘আমি শহীদ কিংবা কোনো কাজে শ্রম দিচ্ছি এমন অবস্থায় মরতে চাই।’ আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার খেদমত ও জিহাদের দায়িত্ব না থাকলে আমি শ্রমের ওপরই জীবন অতিবাহিত করতাম।’

 

 

বিশ্বজুড়েই শ্রমজীবীদের বড় অভিযোগ হলো— কাজের তুলনায় তারা কম বেতন পান। যুগ যুগ ধরে শ্রমিক আন্দোলনের এটি একটি বড় ইস্যু। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে মানবতার বন্ধু, মেহনতি মজুর শ্রমিকের বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) এ ইস্যুর সুষ্ঠু সমাধান করে গেছেন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ।)। হাদিসে শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মূল্য দিয়ে দেওয়ার কঠোর নির্দেশ থাকলেও নবীর উম্মত দাবিদার মালিকপক্ষ এ নির্দেশ উপেক্ষা করছে সবসময়। ঘামের মূল্য পাওয়ার জন্য আরও কয়েক দফা ঘাম ঝরাতে হয় শ্রমিকদের। বিশেষ করে ঈদের সময় শ্রমিক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। হতভাগা শ্রমিক সারা বছর কষ্ট করে বিনা বেতন-অর্ধবেতনে কাজ করলেও একটা আশা থাকে, ঈদ উপলক্ষে সব পাওনা পেয়ে যাব।

ঘাম শুকানোর কয়েক মাস পরও যখন ঈদের সময় মালিকপক্ষ বর্তমান মাসেরই বেতন দেন না অথবা অর্ধেক বেতন দিয়ে ছুটি কাটিয়ে আসতে বলেন, তখনই শ্রমিকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। কল-কারখানা ও গার্মেন্ট থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতে এবং দোকান-অফিসে এভাবেই শ্রমিক তাদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন যুগের পর যুগ।

শ্রমজীবী মানুষের আরেকটি অভিযোগ হলো— তারা তাদের যোগ্যতা ও পরিশ্রমের চেয়ে অনেক কম পয়সা পান। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ সমস্যা প্রকট। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এভাবেই ঠকানো হচ্ছে শ্রমিককে। মসজিদ-মাদ্রাসায় যারা কাজ করেন তাদের বেতন এত অল্প হয় যে, ইমাম ও শিক্ষকদের সংসার চালানোই কষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা বিভিন্নভাবে পয়সা উপার্জনের চেষ্টা চালাতে বাধ্য হয়। কেউবা মিলাদ পড়িয়ে আবার কেউবা জানাজা পড়িয়ে টাকা নেওয়ার রেওয়াজ চালু করে দেন। কোচিং বাণিজ্য ও শিক্ষাবাণিজ্যের মূল কারণ হলো দেশজুড়ে শিক্ষকরা নায্যমূল্য পাচ্ছেন না। ফলে তারাও একটা ফন্দি-ফিকির বের করে নেন। এভাবেই বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্মীয় আচার ও শিক্ষাব্যবস্থা। হে মেহনতি মজুর শ্রমিকের বন্ধু, দয়াল নবী! উম্মত আজ আপনার নির্দেশ উপেক্ষা করে শ্রমিক ঠকাচ্ছে। শ্রমিককে তার ঘামের মূল্য পেতেও ঘাম ঝরাতে হয়। মেহনতিরা তাদের মেহনত ও যোগ্যতার পূর্ণ মূল্য পায় না। সহি বুখারির মাধ্যমে রসুল (সা.) ‘কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে আমি বাদী হয়ে আল্লাহর আদালতে মামলা করব। তাদের মধ্যে একশ্রেণি হলো, যারা শ্রমিককে খাটিয়ে তার পূর্ণ মজুরি দেয় না। (বুখারি)।

শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশের বড় একটি সংখ্যা শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত। এসব শিশু নায্য পারিশ্রমিক তো পাচ্ছেই না উপরন্তু মালিকপক্ষ তাদের সঙ্গে খুবই অমানবিক আচরণ করে থাকে। শিশুদের সঙ্গে আচরণ সম্পর্কে একটি হাদিস উল্লেখ করছি। আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর রসুলের (সা.) খাদেম ছিলাম। তিনি কখনো বিরক্ত হয়ে আমাকে ‘উহ’ বলেননি। কোনো করণীয় কাজ না করলে অথবা অপ্রয়োজনীয় কাজ করে ফেললে ধমক তো দূরের কথা ‘এমনটি কেন করলে’— এ কথাও জিজ্ঞাসা করেননি। (মুসলিম)।

নারী শ্রমিকদের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধেও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।  একই কাজ করে নারী-পুরুষের চেয়ে কম মূল্য পাবে— এটি ইসলাম সমর্থন করে না।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

            www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর