সোমবার, ৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ নিরূপণ করা প্রয়োজন

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ নিরূপণ করা প্রয়োজন

বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরির ইতিহাসও একই রকম গৌরবোজ্জ্বল। প্রেক্ষাপট ও ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ার কারণেই মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জনে সক্ষম হই। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল দিকের ঘটনাবলি ইতিহাসে সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্মারক তৈরির বহুমুখী উদ্যোগ ও কাজ দেশে-বিদেশে বহু জায়গা থেকে অব্যাহতভাবে চলছে। যদিও এখনো যেতে হবে বহুদূর। বিকৃতি, বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচারের কবল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এখনো পরিপূর্ণভাবে মুক্ত করা যায়নি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের এদেশীয় নব্য দোসর রাজনৈতিক পক্ষ এখনো গলা ফাটিয়ে মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি চালিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো এদের কবলে রাষ্ট্র আবার পড়বে কিনা সেই আশঙ্কা থেকে এখনো মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। তাই মুদ্রার অপর পিঠ, অর্থাৎ এতবড় বিজয় অর্জনের পেছনে আমাদের ত্যাগ এবং আগ্রাসী পক্ষের হিমালয়সম ধ্বংসযজ্ঞের যে কাহিনী রয়েছে তার পরিমাণ নির্ণয় করে যথার্থভাবে ইতিহাস সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এত স্বল্প সময় ও ছোট আয়তনবিশিষ্ট (৫৬ হাজার বর্গমাইল) জায়গার মধ্যে এতবড় ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বের আর কোনো যুদ্ধে কখনো ঘটেনি। বিজয়ের গৌরবকে যেমন চিরসবুজ, জীবন্ত ও বহমান রাখা জরুরি, তেমনি ধ্বংসযজ্ঞকে ভুলে গেলে বাংলাদেশের মাটি থেকেই আবার দানবের উত্থান ঘটবে, যার আলামত রাজাকার, আলবদর, জামায়াত ও তাদের মিত্রদের ঔদ্ধত্য আচরণ এবং উত্থান দেখেই বোঝা যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ও ঠাণ্ডা মাথায় দেশব্যাপী ৯ মাস হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম ধাপে এটা চলে ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলোর ওপর। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্যান্য জেলা শহরে যাওয়ার পথে এবং জেলা থেকে মহকুমা ও মহকুমা থেকে থানা শহরগুলো দখল করার প্রক্রিয়ায় পথিমধ্যে নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণ, গ্রামের পর গ্রামকে জ্বালিয়ে দেওয়াসহ নির্বিচারে হত্যা ও লুটপাট চালায়। এই কাজে তাদের সহযোগিতা করে জামায়াত, মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। গাছপালা, বনজঙ্গল, গবাদিপশু পর্যন্ত তাদের ধ্বংসযজ্ঞের কবল থেকে রক্ষা পায়নি। পুরো ৯ মাস ৬৫ হাজার গ্রামেই এহেন বর্বরতা চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সুতরাং এতবড় ধ্বংসযজ্ঞ আনঅ্যাকাউন্টেড ফর, অর্থাৎ হিসাবের বাইরে রাখা মহাভুল কাজ হবে। দুটি প্রধান কারণে ধ্বংসযজ্ঞের সম্পূর্ণ দায় পাকিস্তানকে বহন করতে হবে। এই যুদ্ধে স্পষ্টতই পাকিস্তান আগ্রাসী রাষ্ট্র। কারণ সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে তারাই প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা এবং শুরু করে। আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ যুদ্ধ, আর আক্রমণকারী হয়ে অস্ত্রের জোরে দখলদারি বজায় রাখার জন্য যুদ্ধের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। আমরা বাধ্য হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলি এবং আগ্রাসী বাহিনীকে পরাস্ত করে নিজের দেশ স্বাধীন করি। দ্বিতীয়ত. বিনা উসকানিতে হাজার হাজার গ্রামগঞ্জে নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে হত্যা এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়। সুতরাং এটাকে কোলেটার্যল ড্যামেজ অথবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ক্ষতি বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা স্পষ্টত যুদ্ধাপরাধ এবং একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাই আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী আক্রমণকারীকেই যুদ্ধের দায় বহন করতে হবে। ইতিহাসের উদাহরণও তাই বলে। আগ্রাসী রাষ্ট্র হওয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার জার্মানিকে বহন করতে হয়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যকে ভেঙে দেওয়া হয় এবং জার্মানিকে অবমাননাকর ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে বার্লিনের নিকটস্থ পোটসডাম শহরে অনুষ্ঠিত বিজয়ী শক্তির শীর্ষ সম্মেলনে চার্চিল, স্ট্যালিন ও হ্যারি ট্রুম্যান একত্রে সিদ্ধান্ত নেন আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ জার্মানির কাজ থেকে আদায় করা হবে। পাকিস্তান আজ গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। ধ্বংসযজ্ঞের দায়ও পাকিস্তান অস্বীকার করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে যদি ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় ও মূল্যায়ন করা হয় তাহলে পাকিস্তানের অস্বীকারে কিছু যায় আসে না। পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ইতিহাসের অমূল্য ঘটনাবলি ও সম্পদ রক্ষা এবং তার যথার্থ সংরক্ষণের জন্য এ কাজ জরুরি। কয়েক বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো, সহায়-সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে এই দেশের জামায়াত, মুসলিম লীগ, শান্তি কামিটি ও রাজাকারদের ভূমিকার সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। জাতীয় ঐক্য, নিরাপত্তা ও অগ্রগতির স্বার্থেই তা দরকার। কারণ ৪৫ বছর পরেও এই একই গোষ্ঠী এখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তারা এখনো পাকিস্তানিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলে।

এই ষড়যন্ত্রকারীরা যে বাংলাদেশের শত্রু, তা প্রমাণ করার জন্যই এদের ঐতিহাসিক পাপ ও ঘৃণ্য কাজের রেকর্ড তথ্য-উপাত্ত সহকারে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। তাছাড়া সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা পরিপূর্ণ এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করার জন্যও এ কাজটি একান্ত জরুরি। ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই ধ্বংসযজ্ঞের জীবন্ত সাক্ষী এখনো শহর-গ্রামগঞ্জ সর্বত্রই পাওয়া যাবে। ১৫-২০ বছর পর এই সুযোগ আর থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু আমাদের পবিত্র আমানত। এর যথার্থ মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সবারই জাতীয় দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে আমরা ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয়েছি। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশ বলে রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সব চিহ্ন মুছে ফেলেন। তারপর থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার অভিযান। সীমাহীনভাবে চলে ইতিহাস বিকৃতি। জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, মুসলিম লীগ ও চাইনিজপন্থি অতি বামরা, যারা মুক্তিযুদ্ধকে বলেছে দুই কুকুরের লড়াই, এরা তো সবাই আছেই, তার সঙ্গে নব্য পাকিস্তানপন্থি বড় রাজনৈতিক পক্ষের নেতা, বুদ্ধিজীবীরাও প্রকাশ্যে এবং লেখালেখির মাধ্যমে বলা শুরু করেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, ওটা ছিল ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ। এদের কেউ কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ ও গণ্ডগোলের বছর হিসেবেও বলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এর থেকে চরম অপমান এবং অবমাননা আর কিছু হতে পারে না। এরকম চরম ধৃষ্টতা যারা দেখান, তাদের বাংলাদেশে কোনো অধিকার থাকার কথা নয়। অথচ এরা রাজনৈতিক অঙ্গনসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গলাবাজি করছে। বিশ্বের কোনো দেশে এমন উদাহরণ নেই। এই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে এবং আবার ক্ষমতায় যাওয়ার উন্মাদনায় লম্ফজম্ফ করছেন। পাকিস্তানিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এরা ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। পাকিস্তান দায় এড়ানোর জন্য গণহত্যা ও ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের একজন নাগরিক একই কাজ করবে তা কি ভাবা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে। এটা জাতির জন্য ভয়ানক দুঃখজনক। গণহত্যা যখন অস্বীকার করছে তখন দেশব্যাপী ঘরবাড়ি, গাছপালা, গবাদিপশুসহ অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস, যার মূল্যমান কয়েক বিলিয়ন ডলার হতে পারে সেটিও পাকিস্তান অস্বীকার করবে তা আমরা জানি। পাকিস্তানের অস্বীকার করাটা এখন আর আমাদের জন্য বড় ফ্যাক্টর নয়। আমাদের জন্য বড় ফ্যাক্টর হলো, আমাদের নিজেদের দেশের বড় বড় রাজনৈতিক গোষ্ঠী সেটাকে যখন অস্বীকার করে তখন সেটা বিপজ্জনক হয়। ১৯৭৫ সালের পর প্রথমে জিয়াউর রহমান, তারপর জেনারেল এরশাদ এবং সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত মিলে মুক্তিযুদ্ধের সব কিছুকে ওলট-পালট করার যে অপচেষ্টা করেছে, তা এতদিন অব্যাহত থাকলে আজ আর কেউ মুক্তিযুদ্ধ কথাটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারতেন না। কিন্তু ৩০ লাখ মানুষের রক্ত বৃথা যেতে পারে না, এর একটা প্রবল সহজাত শক্তি আছে। এই শক্তিকে অবলম্বন করে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শন ফিরিয়ে আনার পথে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার জন্য এবং অর্জনগুলোকে টেকসই করার জন্য অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করতে হবে। তারই অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা যে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তার সঠিক পরিমাপ করতে হবে। তা না হলে প্রত্যক্ষদর্শীরা যখন থাকবে না তখন জামায়াত ও তাদের জোট সঙ্গীরা আগামীতে এগুলোকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করবে। কাজটি সুষ্ঠু, আন্তরিক ও যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সংসদীয় কমিশন গঠন করা হলে ভালো হবে। তাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং একাত্তরে যেসব বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশে কাজ করেছে তাদের কমিশনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে কাজের মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কম প্রশ্ন উঠবে। নিঃসন্দেহে বিশাল কর্মযজ্ঞ। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে তা আমাদের করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা আজ সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে। সঠিকভাবে কাজটি শেষ করতে পারলে সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর