সোমবার, ৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
অতিথি কলাম

বিমান ও বাগদাদের চোরেরা

এ কে এম মাঈদুল ইসলাম, এমপি

বিমান ও বাগদাদের চোরেরা

বাংলাদেশ বিমান আর দুর্নীতি যেন সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। বলা হয় আরব্য উপন্যাসের বাগদাদের চোরদের আছর পড়েছে এ রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থায়। বিমানে এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। বিমানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন ভাতা পেলেও দেশের মানুষের প্রতি কিংবা বিমানের প্রতি তাদের অনেকেরই কোনো দায়বোধ আছে বলে মনে হয় না। বলা হয়, বিমানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কেউ কেউ অন্য বিমান সংস্থার স্বার্থ রক্ষায় বেশি পরাঙ্গম। বিদেশি এয়ারলাইনস যেমন, কাতার, এমিরেটস ও অন্যান্য এয়ারলাইনস থেকে নাকি তারা নিয়মিত উেকাচ গ্রহণ করেন। ফলে ওইসব এয়ারলাইন্সের লাগেজ তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। আমাদের বিমানকে সুযোগ না দিয়ে বিদেশিদের মালের বেল্ট ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। আমাদের বাংলাদেশ বিমানের লাগেজ আস্তে আস্তে আসতে থাকে। যাত্রীরা বিরক্ত হয়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যে লোকাল প্লেনগুলো আছে সেগুলো নাকি ইন্দোনেশিয়ার। ইন্দোনেশিয়া তাদের পুরনো প্লেনগুলো কোনোরকম মেরামত আর ঘষামাজা করে আমাদের কাছে বিক্রি করে। ফলে এগুলোর শিডিউল ঠিক থাকে না। অদক্ষ বিদেশি পাইলট দ্বারা সেগুলো চালানো হচ্ছে। এসব বিমানে চড়তে যাত্রীরা ভয় পান। যার ফলে যাত্রীরা অন্যান্য এয়ারলাইনসে যাতায়াত করে। আমাদের অভ্যন্তরীণ প্লেনগুলো পরিবর্তন করে যদি নতুন প্লেন কেনা যায় তাহলে খুবই ভালো হয়। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, চলাফেরার জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এদিকে দৃষ্টি দেওয়া একান্ত দরকার।

আবহাওয়াজনিত কারণে বা যান্ত্রিক ত্রুটি ছাড়া কোনোক্রমেই প্লেনের শিডিউল বিঘ্ন ঘটানো ঠিক না। এতে করে যাত্রীদের কষ্ট হয়, তাদের আস্থা নষ্ট হয়, তারা অন্য প্লেনে চলাচল করে। তাই দেখা যায় অন্যান্য প্লেনগুলোতে যাত্রী ভর্তি থাকে কিন্তু আমাদের প্লেনের সিট খালি পড়ে থাকে। সিট খালি থাকার আরও একটি কারণ আছে। আমাদের বিমান কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, সিট খালি নেই। কিন্তু প্লেনে উঠে দেখা যায় পুরো সিট খালি। এর একটি বাস্তব উদাহরণ দিতে চাই। আমি দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা আসব। আমার ‘কনফার্মড’ টিকিট। কলকাতা এয়ারপোর্টে আসার পর তারা বলল যে, সিট নেই। আমি বললাম, আমার তো ‘কনফার্মড’ টিকিট আছে। ডেপুটি হাইকমিশনার সাহেবের স্ত্রীও সেখানে ছিলেন। এরপর বিমানে উঠে দেখলাম, আমরা মাত্র তিন-চারজন যাত্রী আর পুরো বিমানের সিটগুলো খালি পড়ে আছে। ঢাকায় এসে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, ওই সময় বিশেষ করে ঈদ উৎসবের সময় তারা প্রচুর লাগেজ নিয়ে আসে। যাত্রীদের সোজাসুজি বলে দেয় যে, টিকিট নেই। এ ধরনের দুর্নীতি চললে বিমান কখনো লাভের মুখ দেখবে না। 

প্রসঙ্গক্রমে কলকাতা এয়ারপোর্টের কথাই ধরা যাক। ১০ বছর আগে কলকাতা এয়ারপোর্টে নামলে প্রথমেই ইমিগ্রেশন অফিসারকে ঘুষ দিতে হতো। না দিলে পাসপোর্ট শুধু নাড়াচাড়া করত, সিল ছাপ্পর মারত না। অবশ্য তাদের ঘুষের পরিমাণ কম ছিল। ১০ টাকা দিলেই খুশি। আমরা নিয়মিতভাবেই সেখানে টাকা দিতাম। এরপর কাস্টমসের লোককে ৫০, ১০০ টাকা দিতে হতো। কিছুই যদি না পেত তখন তারা বলত, ‘স্যার, আপনার বলপেনটা দেবেন? আমার মেয়ের পরীক্ষা আছে’। কিন্তু এখন কলকাতা এয়ারপোর্টে গেলে আর আগের মতো মনে হয় না। দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, পুনে ও অন্যান্য এয়ারপোর্টের কথা বাদই দিলাম। কলকাতা তো আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। তারা যদি বদলে গিয়ে এত সুন্দর এয়ারপোর্ট ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারে তাহলে আমাদের এখানে অসুবিধা কোথায়?

বিমানের ক্যাটারিং সার্ভিস খুবই ভালো ছিল। কয়েক বছর আগ পর্যন্তও লোকে বলত বিমানের ক্যাটারিং সার্ভিস খুবই চমৎকার। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। বিমানের একটি পোলট্রি ফার্ম ছিল। সেটাও চলে না।  আমি একবার ক্যাটারিংয়ের ভিতরে গিয়ে দেখি আস্ত খাসির মাংস পড়ে আছে। তারা সবটুকু না নিয়ে অর্ধেকটা নেয় আর অর্ধেকটা ফেলে রেখে দেয় যা পরে বাইরে বিক্রি করে দেয়। বিমানের জন্য অনেক জিনিস কিনতে হয়। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জিনিস কেনা হয় এবং পরে সেগুলো এভাবে পরিত্যক্ত হিসেবে বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এভাবে বিমানের টাকা লুটপাটের মহোৎসব চলে।

আর একটি অপ্রিয় কথা বলতে হয়, সেটা হলো, অনেক সময় আমাদের বিমানকে ভিআইপি ফ্লাইটে রূপান্তরিত করা হয়। ফলে পুরো শিডিউল নষ্ট হয়ে যায়। যাত্রীদের হয়রানি বাড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরে এতগুলো বিমান থাকা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তিনি ব্রুনাই থেকে একটি বিমান ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের ভিআইপি ফ্লাইটের দরকার হলে আমরা সেভাবে ভাড়া নিতে পারি। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বললেই নয়, প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাহেবের সময় শাহ আজিজ সাহেব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বিচারপতি সাত্তার সাহেবের কমনওয়েলথ কনফারেন্সে কানকুনে যাওয়ার কথা ছিল। তার স্বাস্থ্য ভালো না থাকায় শাহ আজিজ সাহেবকে পাঠানো হয়। শাহ আজিজ সাহেব ভিআইপি ফ্লাইট নিয়ে কানকুনে গেলেন। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাধারণ বিমানে করে গেলেন লন্ডনে। লন্ডন থেকে তিনি শিডিউল প্লেনে কানকুনে গেলেন। তখন যারা শাহ আজিজ সাহেবের সফর সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন তারা এসে বলেছিলেন, তাদেরকে নাকি সেখানে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিল যে, বাংলাদেশ কি ভারতের চেয়ে ধনী রাষ্ট্র যে ভিআইপি প্লেনে এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এসেছেন সাধারণ বিমানে। আমার জানামতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও কোনো ভিআইপি ফ্লাইট ব্যবহার করেন না। তার ব্যবহারের জন্য একটা প্লেনের ব্যবস্থার কথা ব্রিটিশ সরকার এখন চিন্তাভাবনা করছে।

টার্মিনালের ভিআইপি রুমে এখন বহু লোক যাতায়াত করে থাকে এবং ভিআইপির নাম করে একেবারে টার্মিনালের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। এতে যাত্রী ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন ঘটে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। লন্ডন এয়ারপোর্টে এখন ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করতে হলে ৬০০ পাউন্ড ভাড়া দিতে হয়। আর আমাদের এখানে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের নামে যে কী হচ্ছে তা কারও জানা নেই। এ ছাড়া এখন ভিআইপি, সিআইপি সব একসঙ্গে মিশে হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়ে গেছে। সিআইপিদের জন্য আলাদা এলাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে যেখানে তারা বসতে পারবেন।

আমাদের বিমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে যথেষ্ট শক্তিশালী ও দক্ষ সে ব্যাপারে বহু নিদর্শন রয়েছে। ১৯৭৭ সালে একটি জাপানি প্লেন হাইজ্যাক হয়ে আমাদের দেশে এসে পড়েছিল। তখন সরকার খুবই দক্ষতার সঙ্গে তা উদ্ধার করেছিল। জাপান সরকার সেজন্য আমাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল। বিমানে স্ক্যানিং করার বিষয়টি রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচামাল ও ফল-ফলাদির জন্য আলাদা স্ক্যানিং মেশিন ব্যবহার করতে হবে। এটা খুবই যুক্তিসংগত। কেননা এখন স্ক্যানিং মেশিনের দাম খুব একটা বেশি নয়। কয়েকটি স্ক্যানিং মেশিন নিয়ে আসলেই হয়। স্ক্যানিং সমস্যার চেয়ে বড় সমস্যা হলো, অতিরিক্ত জনবল, আমাদের আইন কানুন না মানা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক শক্তিশালী হারকিউলাস প্লেনে যাচ্ছিলেন। সেটা তো আর্মিরা স্ক্যান করে দিয়েছিল। তারপরও সে প্লেন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। সুতরাং বাড়তি জনবল কমিয়ে, দক্ষতা বাড়িয়ে বিমান পরিবহন আরও গতিশীল করা সহজেই সম্ভব।

বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই নাজুক। সব দেশের বিমান কর্তৃপক্ষ খুবই উদ্বিগ্ন। ‘দি ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন’— ১৪ নভেম্বর ২০১৫ এর ‘এভিয়েশন সিকিউরিটি’ নিবন্ধে ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারি, ফিলিপ হারমন্ড বলেছেন, ‘What we have got to do its ensure that airport security everywhere is at the level of the best’. ‘That may mean additional costs; it may mean additional delays at airports as people check in.’   এটাও দেখতে হবে যে, যে হারে বিমান পরিবহন, বিমান যাতায়াত বাড়ছে, যে হারে এয়ারপোর্ট বহির্ভূত জায়গায়ও সন্ত্রাস বাড়ছে, সে তুলনায় সন্ত্রাসী দুর্ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত নয়। কিন্তু সন্ত্রাস রোধের নামে মাত্রাতিরিক্ত স্ক্যানিং বিরক্তিকর পর্যায়ে গেছে। তাছাড়া বেশিরভাগ সতর্ক সংবাদ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং এ ধরনের স্ক্যানিং সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয় এবং যাত্রীদের আস্থার অবনতি ঘটায়। এগুলোর চেয়ে কম ব্যয় সাপেক্ষ বিষয় হলো, যাত্রী এবং অভ্যন্তরীণ কর্মীদের এমনকি হোটেল কর্মীদেরও প্রোফাইল তৈরির বিষয়ে নজর দেওয়া। কারণ অনেক তদন্তেই দেখা গেছে যে, বিমানের দুর্ঘটনার সঙ্গে বিমান এবং হোটেলের কেউ না কেউ জড়িত। তাছাড়া মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষকেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমরা যেন আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন নিরাপত্তা মূল্যায়নে ক্যাটাগরি-২ স্টেট থেকে ১নং ক্যাটাগরিতে উন্নত হতে পারি। সব কিছু বিবেচনায় বাংলাদেশের বিমানবন্দর অনেক নিরাপদ। শুধু এ ব্যাপারটি প্রচার, প্রচারণায় তুলে ধরতে হবে।

এখন অল্প কয়েকটি দেশ ছাড়া অন্যান্য দেশ আমাদের বিমান নিতে চায় না। তাই আশা করব নতুন পরিচালনা পরিষদ এমন কিছু কাজ করবেন যাতে করে প্রতিটি দেশে আমাদের বিমান যেতে পারে। আমরা তো এখনো নিউইয়র্কের অনুমতি পাইনি। কী এমন ব্যাপার যে, আমরা নিউইয়র্কের অনুমতি পেতে পারি না! আমাদের দেশের সিকিউরিটি খুব যে খারাপ এমন তো নয়। অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশের সিকিউরিটি অনেক ভালো। এ ছাড়া এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি আমরা কি দিতে পারি না! আমাদের পুলিশ আছে, র‌্যাব আছে, বিজিবি আছে। সরকার শক্ত হলে সব কিছু ঠিক করা যায়। আমাদের কার্গো যাচ্ছে না, রপ্তানি হচ্ছে না। আমরা তো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র না যে আমাদের বিমানকে যেতে দিবে না। আশা করি আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা কাঠামো, ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও তত্পরতা বাড়ালে হয়তো এসব সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারব।

প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, পুরো এয়ারপোর্ট এলাকাতে ফুলের বাগান করা হবে, আবাদ করা হবে। হল্যান্ডের আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে আলু চাষ করা হতো। কেননা আলুতে কোনো পাখি আসে না। পাখি আসতে পারে এমন কোনো গাছ বিমান বন্দরের কাছে, আশপাশে লাগানো যাবে না। এটাও আমাদের নতুন পরিচালনা পরিষদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।

এখন নতুন পরিচালনা পরিষদ হয়েছে। জনমনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। সবাই আগ্রহ ভরে চেয়ে আছে বিমানবন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ সুষ্ঠু হবে, বিমান সেবার মান বাড়বে, বাড়বে নিরাপত্তা, প্রতিষ্ঠিত হবে শৃঙ্খলা। বিমানবন্দরের পরিবেশ উপভোগ্য হবে। যাত্রী সংখ্যা বাড়বে। সর্বোপরি বিমানের আয় বাড়বে। জাতীয় অর্থনীতিতে ভালো অবদান রাখবে। তাই আমরা বিমানের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। সবশেষে দেশের সুনাম বাড়াতে হবে। নতুন পরিচালনা কমিটির নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস দেশ-বিদেশের যাত্রীসাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে বলে আমরা আশা করছি। 

লেখক : বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন মন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর