সোমবার, ৯ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
পাঠক কলাম

একজন স্থপতির মৃত্যুটি অবহেলিত থাকল কেন!

তাসনুভা তাবাসসুম লাবণ্য

একজন স্থপতির মৃত্যুটি অবহেলিত থাকল কেন!

যে কারোর অকাল মৃত্যু দুঃখজনক। আর তিনি যদি সম্ভাবনাময় ব্যক্তি হোন তাহলে সে মৃত্যুটি তার পরিবার ও দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়। চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র সিয়াম ভাইয়ার মৃত্যুটি তেমনি একটি ঘটনা। তার মৃত্যুটি স্থানীয় প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও মিডিয়ার লোকজনের কাছে গুরুত্বহীন থাকায় আমাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগটি একটি ছোট পরিবারের ন্যায়। সেই ছোট পরিবারের শেষ বর্ষের ছাত্র মো. মোহাইমিনুল ইসলাম সিয়াম গত ২৯ মার্চ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মো. খায়রুল বাশার ও রওশন আক্তারের একমাত্র পুত্র সন্তান ছিলেন। বড় হয়েছিলেন জামালপুর জেলায় এক মফস্বল শহরে। একমাত্র ছোট বোন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা-মা ও নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ নিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন স্থাপত্য বিভাগে। আর মাত্র ছয় মাস পর স্থপতির ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে যেতেন আমাদের সিয়াম ভাই। তখন হয়তো তার থিসিসের প্রজেক্টটি হতে পারত কোনো পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থা, যানজট ও সড়ক দুঘর্টনা নিয়ে। কিন্তু সেই সড়কেই এক অনিয়ন্ত্রিত যান আর এক অদক্ষ চালকের হাতে তার প্রাণ যাবে তিনি কি ভেবেছিলেন? গত ২৯ মার্চ আড়াইটার সময় একটি লেগুনায় (স্থানীয়ভাবে নির্মিত ভটভটির ন্যায় যন্ত্রযান) যাত্রী ছিলেন তিনি। একটি লেগুনা তার লেগুনাকে ওভারটেক করতে গিয়ে তার লেগুনার ওপর উল্টে পড়ে। ফলে সিয়াম ভাইয়ের শরীর চাপা পড়ে লেগুনার নিচে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, লেগুনার নিচ থেকে উদ্ধারের জন্য তত্ক্ষণাত কেউ এগিয়ে আসেনি। সিয়াম ভাইয়ের ফোনকলের মাধ্যমে সহপাঠীরা জানতে পারেন তার দুর্ঘটনার কথা। সহপাঠীরা দ্রুত চুয়েটের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন এবং তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। তখন প্রায় বিকাল সাড়ে ৪টা। কিছুক্ষণ পর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসকের বক্তব্য তিনি কোমরের নিম্নাংশে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো।

একজন অদক্ষ অশিক্ষিত লাইসেন্সবিহীন চালকের যেমন দায়ভার নেই, সেদিন দেখা গেল পথচারী, স্থানীয় দোকানদার ও ট্রাফিক পুলিশের তেমনি দায়ভার নেই। একইভাবে তার মৃত্যু সংবাদটি জাতীয় পত্রিকায় স্থান না পাওয়ায় সাংবাদিকদের দায়ভার নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। অথচ ঢাকা ও জেলা শহরের বহু সড়ক দুর্ঘটনার খবর গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতে দেখা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এ জাতীয় মৃত্যু সংবাদ ‘এইমাত্র পাওয়া’ খবরে দেখানো হয়। কিন্তু সিয়াম ভাইয়ের বেলায় এটির ব্যতিক্রম দেখলাম। তবে চট্টগ্রাম স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ও বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় মৃত্যু সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শোনা গেছে, চট্টগ্রামের খবর চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি নাকি দীর্ঘদিনের প্রথা। এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ? সিয়াম ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটি যেমন মিডিয়ার কাছে অবহেলিত থেকেছে, তেমনি স্থানীয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অবহেলিত থাকায় প্রশাসন আজ পর্যন্ত লেগুনার চালককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি। প্রশাসন আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়সারা ভাব দেখে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা ভিসির কাছে ৯ দফা দাবি পেশ করে।

দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে দায়ী চালককে গ্রেফতার, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই রোডে লেগুনা চলাচল বন্ধ, চুয়েট গেট পর্যন্ত বিআরটিসির নয় নম্বর বাস সার্ভিস চালু ইত্যাদি। স্থানীয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর মিডিয়ার কাছে সিয়াম ভাইয়ের মৃত্যুটি অবহেলিত থাকলেও শিক্ষার্থীরা ঠিকই মূল্যায়ন করেছেন। তার মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষিত হয়। বড়দের কাছে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সর্বপ্রথমে ডিজাইন করতেন সিয়াম ভাই। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী ও সাহসী। তিনি দিনরাত মেধা খাটিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবতেন। তখন কি ভেবেছিলেন, তিনি এভাবে অবমূল্যায়িত হবেন! সবাইকে ভেবে দেখা উচিত, আমরা বহু কষ্ট করে ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখানে বেতন ও হোস্টেল খরচ সবার নাগালের মধ্যে। কিন্তু অনেকে হয়তো জানেন না, সেখানে আরেকটি যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের টিকে থাকতে হয়। সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আমাদের সুকীর্তিগুলো যদি গুরুত্ব দিয়ে ছাপাতে পারেন তাহলে এ মৃত্যুটি কেন অবহেলিত থাকল? প্রশাসনকে বলছি, যদি আমরা এতই গুরুত্বহীন আর চক্ষুশূল হয়ে থাকি তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দিচ্ছেন না কেন? সচেতন ব্যক্তিরা বলা শুরু করেছেন, বর্তমানের মতো অপরিকল্পিত পথে নগরায়ণ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ দেশের পরিবেশ, কৃষি, নদী-খাল-বিল কিছুই থাকবে না। এর সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্থপতিরা। যেহেতু Planned আগে, Settlement পরে। সিয়াম ভাইয়ের বাবা-মা অপেক্ষা করছিলেন একদিন তাদের সন্তান গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ উড়িয়ে উল্লাস করবে, এভাবে কাফনের কাপড় পরিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নার জন্য নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, স্থাপত্য বিভাগ, চুয়েট।

সর্বশেষ খবর