শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিচার বিভাগকে শত্রু ভাবা উচিত নয়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বিচার বিভাগকে শত্রু ভাবা উচিত নয়

ধীরে ধীরে আমরা কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের ব-দ্বীপ বাংলার কোমল মাটিতে জন্ম নেওয়া আমরা একসময় ছিলাম কায়ায়-মায়ায়, সভ্যতা-ভব্যতায় বিশ্বের গর্ব। কিন্তু শুধু নেতৃত্বের দুর্বলতায় আমরা কেন যেন সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছি। ভারত বিভক্তির জাঁতাকল থেকে আমরা এখনো বেরোতে পারছি না। পাকিস্তানের চরম বঞ্চনা, অপমান, নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে আমরা রক্ত ঢেলেছি। পৃথিবীতে এমন জাতি খুব কমই আছে যারা মায়ের ভাষা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে। সেই আমরা আজ আমাদের চিনতে পারছি না, আমাদের সভ্যতা-ভব্যতা, আমাদের ঐতিহ্য, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারছি না।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজ ও দেশ পরিচালনার আশায় স্বাধীন হয়েছিলাম। কিন্তু কেন যেন আজ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র নেই, আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নেই। এক মারাত্মক অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছি। গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও প্রশাসন স্বাধীন সত্তা নিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধায় গলাগলি ধরে একতালে এগোবে— এটাই নিয়ম, এটাই রীতি। কিন্তু আমাদের দেশে কেমন যেন অনেক দিন থেকেই তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এখন শাসন আর বিচার বিভাগ যেমন মুখোমুখি, তেমন আইন প্রণয়নকারী সংসদও প্রায় মুখোমুখি। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর রায়কে কেন্দ্র করে। নিজামীর হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে আপিল নিয়ে বাইরে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়। সেখানে আমাদের মন্ত্রীরাও অংশ নেন। এখন খুব বেশি ছোট কাজে বড়রা মাথা ঘামান। হাততালি পেলে কারও মাথা ঠিক থাকে না। রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে সরকারি কর্মচারীরা বড় নেতা হয়ে যান। পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তা মাঠের বক্তৃতার মতো যা বলেন, তাতে আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায়। এ ক’মাসের অতিকথনে মারাত্মক ভয়াবহ এক অবস্থার সৃষ্ট করেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারে ফাঁসি দিতে হবে এমন একটা চাপ সৃষ্টির সভায় মাননীয় মন্ত্রীরা বেশ জোরেশোরে কিছু কথা বললেন। তার মধ্যে একজন প্রবীণ রাজনীতিক, যিনি সব সময় ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। তার বিনয় ছিল অঙ্গের ভূষণ, তিনিও মনে হয় জোরেশোরে উগ্রদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট ব্যাপারটি সহজভাবে নেয়নি। তাদের তলব করা হয়েছিল। ক্ষমা চাইলেও কোর্ট ক্ষমা না করে জরিমানা করেছেন।

মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ আইনমন্ত্রী বলেছেন, মাননীয় মন্ত্রীদের কথায় শপথ ভঙ্গ হয়নি। কার কথায় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব— মাননীয় মন্ত্রীর, না প্রধান বিচারপতির? মাননীয় মন্ত্রী সংবিধান রক্ষণের শপথ নিয়েছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের হেফাজতকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রধান বিচারপতি যদি কোনো সভা-সমাবেশে অমন মন্তব্য করতেন তা ছিল এক কথা। কিন্তু তিনি এজলাসে যে মন্তব্য করেছেন তা রায় হিসেবে বিবেচনা না করলেও একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। এর আগে আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে মন্ত্রী হিসেবে কেউ দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন কিনা জানি না। হয়ে থাকলে তার পরও মন্ত্রী থেকেছেন অমনটা জানি না। আমাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জজকোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে দোষী সাব্যস্ত হয়েও মন্ত্রী— এ কেমন এক অবস্থা? এখন এসব থেকে কী করে নিষ্কৃতি পাব তাও জানি না।

এমনিতেই সরকার ও বিচার বিভাগে উত্তেজনা চলছিল। নানা কারণে বিচার বিভাগ তার মহিমা কিছু হারিয়েছে। কোর্ট-কাচারিতে যেসব কথা হয় শুনতেও কষ্ট লাগে। তারপর সেদিন সংসদে বিচারকদের অপসারণ আইন হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করায় সে যে কী তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে বলার মতো নয়। ব্যাপারগুলো যুক্তিতর্কের মধ্যে নেই, অনেকটা সীমা অতিক্রমের পর্যায়ে চলে গেছে। সংসদের ভিতরে যে যাই বলুন সংবিধানের নির্দেশমতো কাউকে ধরার সুযোগ নেই, কিছু বলার সুযোগ নেই। কিন্তু সংসদের বাইরে যে কোনো শব্দ আইনের বিচারের মধ্যে পড়ে। তাই যে কেউ যা খুশি বলতে পারেন না। সংসদ বিচারকদের অপসারণ করতে পারবে এ বিল বাতিল করায় সংসদ সদস্যরা যেভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, বিচারকদের সেভাবে ক্ষুব্ধ হওয়া মানাবে না। বলা হয়েছে, সংসদ যদি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে, প্রধানমন্ত্রীকে পারে তাহলে বিচারপতিদের কেন পারবে না? কথাটা শুনতে সুন্দর শোনালেও ব্যাপারটা এক রকম নয়। সংসদ নিশ্চয়ই সার্বভৌম, তার পরও তাকে কিছু বিধিবিধান মেনে চলতে হয়। সংসদ ইচ্ছা করলে দেশটা বিক্রি করে দিতে পারে না, সংসদ ইচ্ছা করলেই তার খোলনলচে বদলে ফেলতে পারে না। কেউ ইচ্ছা করলে যেমন নারীকে পুরুষ, পুরুষকে নারী বানাতে পারে না, বলতে গেলে সে রকমই একটা বাধ্যবাধ্যকতা। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও তেমন। কোর্ট ইচ্ছা করলেই যা খুশি করতে পারে না, তাকে আইনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। ইদানীং যদিও শুনি, কোনো বিচার-আচার নেই, মুখ দেখে বিচার করা হয়। তার পরও আমার মনে হয় আইন আছে, ন্যায় ও সত্য আছে। তার একটা শুভ প্রভাব আছে। বিচারপতিদের অপসারণের বিল বাতিল করায় সংসদ যতটা ক্ষুব্ধ হয়েছে সংসদের আরও অনেক আইন অনেক বিল এর আগেও হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ বা বাতিল করেছেন। কই তখন তো এত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি? বিচারকদের জন্য আরও ভালো করে একটি জুডিশিয়াল কাউন্সিল করলেই হয়। তাদের বিচার-আচার, সুযোগ-সুবিধা তারাই দেখতে পারতেন। সংসদের এভাবে বলতে হতো না, তারা আমাদের সিদ্ধান্ত অবৈধ বলেছেন। আমরা যদি এখন তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করি তখন তারা কী করবেন? নিজেরটা পাস করে বিচারপতিদেরটা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রেখেছেন ব্যাপারটা ভালো হয়নি। এতেই বোঝা যায় কারও প্রতি কারও অত নির্ভরশীল থাকা ভালো নয়। একটা ভারসাম্য রক্ষার জন্য সুন্দর সমন্বয় থাকা উচিত। কারও মাথার ওপর কারও ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। তেমন ঘুরলে অঘটন ঘটবে।

বহুদিন বাবার ইচ্ছা ছিল পরিবারের কেউ ব্যারিস্টারি পড়ুক। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর ১৬ বছর পর ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার মেয়ে কুঁড়ি ব্যারিস্টারি পড়তে দুই দিন পর লন্ডনে যাচ্ছে। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, আত্মীয়স্বজনের কাছেও চাই। মানুষের জীবন কত বিচিত্র। কুঁড়ির যখন জন্ম আমি তখন নির্বাসনে। তখন কতজন কত ফুর্তি করে দেশে ঘুরে বেড়াত, আমার দেশে আমি ফিরতে পারতাম না। অপরাধ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার প্রতিবাদ করেছি, প্রতিরোধ করেছি। কাপুরুষের মতো নেতার হত্যা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিইনি। দীপ-কুঁড়ি-কুশি কাউকেই জন্মের সময় দেখিনি। দীপের জন্ম ঢাকায়, কুঁড়ির টাঙ্গাইলে। আমি তখন ভারতে। আর কুশিমণি, আল্লাহর দান। জন্মের পর দীপ খুব কান্নাকাটি করত। কত ওষুধপত্র, কত ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ কোনো কাজ হয়নি। আমার ছেলে তো, তাই মনে হয় বড় বেশি কাঁদত। পাড়া-প্রতিবেশীরা রাতে ঘুমাতে পারত না। ১০৩ শরৎ গুপ্ত লেনে আমার খালার বাড়ি। খালা ছিলেন আমাদের পরিবারের প্রধান ভরসা। ধনী-গরিব সবাই গিয়ে তার আশ্রয় নিত। তিনিও আশ্রয় দিতেন। একদিন তাদেরই কে যেন জোর করে নারিন্দা পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সব বুজুর্গকেই সম্মান করি। কিন্তু কারও মুরিদ বা ভক্ত নই। আমার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজনরা দীপকে নিয়ে নারিন্দা পীর সাহেবের কাছে গেলে তিনি কোলে নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘এ কার ছেলে?’ আমার কথা শুনে বলেছিলেন, ‘সে বাবার অভাব বোধ করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চাকে বাবার কাছে নিয়ে যান। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’ সত্যিই দমদমে দীপ যখন আমার কোলে আসে, সেই থেকে কান্না বন্ধ। মনে হয় সে ছেলেবেলায় কাঁদতেও জানত না। যদিও দু-এক বার রাগটাক করেছে, কিন্তু কাঁদেনি। ছোটবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে অনেকবার গোসল-আসল করিয়ে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন। ফুফির সঙ্গেও মাঝেমধ্যে রাগ দেখিয়েছে।

নারিন্দার পীর সাহেবের আরেকটি বাস্তব জ্ঞানের কথা বলি। সে ছিল স্বাধীনতার পরের কথা। তখন দালাল ধরতে সবাই ব্যস্ত। পল্লীগীতি সম্রাট আবদুল আলীম মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেননি। ঢাকা রেডিওতেই গান গাইতেন। পল্লীগীতি ছাড়া আর কোনো গান তিনি গাননি। যে গানে প্রেমই থাকে বেশি। স্বাধীনতার পর তাকে দালাল হিসেবে চিহ্নিত করে রেডিওতে গান গাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। গান গাওয়া ছাড়া তার কোনো উপার্জন ছিল না। একে তো তুন্দুল নাস্তি, অন্যদিকে দালাল হিসেবে জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা। আবদুল আলীম ছিলেন নারিন্দা পীরের মুরিদ। তাই উপায় খুঁজতে ছুটে গেছেন পীরের কাছে। তখন পীরদেরও মহাবিপদ। কখন কী হয় তারা জানেন না। আবদুল আলীমকে পীর সাহেব বলেছিলেন, ‘এখন পীর আমি না। পারলে কাদের সিদ্দিকীর কাছে যা। তার এখন নামকাম। এখন পীর কাদের সিদ্দিকী।’ হঠাৎই একদিন তিনি ছুটে এসেছিলেন। তাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু তার সব ব্যথা দূর করেছিলেন। জন্মের পর কুঁড়ি অমনটা করেনি, তেমন কান্নাকাটি বা অন্য কিছু। শিশু কুঁড়িকে দেখিনি, জন্মের দুই-আড়াই মাস পর দেখেছি। ’৯০-এ সর্বশেষ লন্ডন থেকে যখন ফিরি তখন কুঁড়ি ১০ মাসের বাচ্চা। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে রাত ২টায় টাঙ্গাইলে গিয়ে ওর পা ধুয়ে পানি খেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি জন্ম নিয়ে ও-ই আমায় দেশে এনেছে। ওর আগে মার পা ধোয়া পানি খেয়েছিলাম। জানি না ভালো করেছি, না মন্দ করেছি। মন বলেছে তাই মায়ের পর মেয়ের পা ধোয়া পানি খেয়েছি। জীবনে মদ-গাঁজা-ভাং খাইনি।

ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে আজ মা-বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতিহা পাঠ করতে গিয়ে কত কথা মনে পড়ছে। দেশবাসী হিতৈষী সবার কাছে প্রার্থনা— পরম করুণাময় প্রভু যেন কুঁড়িকে তার ছায়াতলে রাখেন এবং ভালোভাবে লেখাপড়া করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ দেন। অবশ্যই এটা বুঝি, যে সময় কুঁড়ি আইন পড়তে লন্ডনে যাচ্ছে সে সময় দেশে আইনের অবস্থা ভালো নয়। বিচার বিভাগ আর শাসন বিভাগ অথবা বিচার এবং আইন বিভাগ মুখোমুখি। মা-বাবার কবরের পাশে কামনা করছি দয়াময় আল্লাহ যেন ওকে একজন ভালো মানুষ এবং অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর শক্তি দেন। আমিন।   

লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর