রবিবার, ১৫ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন কী বার্তা দিয়ে গেল!

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন কী বার্তা দিয়ে গেল!

সম্প্রতি পুলিশ আয়োজিত ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। দেশের সব ধর্মের ধর্মীয় নেতারা রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সভাপতি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রধান অতিথি ছিলেন। সমাজ বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, ধর্মের অজুহাতে খুন ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এই সম্মেলন বিশেষ ভূমিকা রাখবে। সম্মেলনেও অনেকে এই অভিমত দিয়েছেন।

বাস্তবেই যদি সব ধর্মের মেলবন্ধন শক্ত হয়, সহাবস্থান শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় হয় তাহলে ধর্মীয় সংঘাত কমে যাবে।  বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ বরাবরই শান্তিপ্রিয় ছবি। ধর্মীয় সম্প্রীতির উপমাও বটে। সব ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনে পুরোপুরি স্বাধীন। বরং পরস্পর সহযোগিতা ও উৎসবমুখর পরিবেশে আপন হয়ে ওঠার উদাহরণ আছে অনেক।

আমাদের ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতিই রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি। পরস্পরের আন্তরিকতা, সামাজিক বন্ধন, ধর্মীয় সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, আস্থা-বিশ্বাস দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষা করতে সহায়ক। দেশের অভ্যন্তরে সম্প্রীতি নষ্ট হলে মীর জাফর এবং মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ বিন উবাই’রা চেপে বসবে।

বাঙালির চিরায়ত ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐতিহ্যকে মজবুত করতেই এই সম্মেলন।  তবে রাজনৈতিক সম্প্রীতি ছাড়া ধর্মীয় সম্প্রীতি মোটেও সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা যতটা কম হবে সমাজে শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় পরিবেশ ততটাই ফিরে আসবে। রাজনৈতিক স্থিতি বা অস্থিরতা যাই হোক ধর্মের নামে সংঘাত, হত্যা, খুন, আঘাত, ত্রাসের কোনো সুযোগ কোনো ধর্মেই নেই। কোনো ধর্ম যেমন কারও মত প্রকাশে বাধা দেয় না, আবার মত প্রকাশের নামে পরের মতে বা ধর্মে আঘাত দেওয়াও অনুমোদন করে না। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক খুন, হত্যা ধর্মের নামে হচ্ছে বললে অনেকাংশে ভুল হবে! যুৎসই হলো, ধর্মকে আঘাত করে একদল পুলকিত হচ্ছে; বিপরীতে অন্যায়ভাবে হত্যা করে আরেক দল বেহেশতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এদেরই সহোদর হিন্দু উগ্রবাদীরা ভারতে হিন্দুধর্মের দুশমন চিহ্নিত করে উদারপন্থি লেখকদের হত্যা করে স্বর্গলাভের আশা করছে। পথ দুটিই ভুলের। পথ দুটিই অন্যায়ের। ধর্মের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে গালমন্দ করাও অপরাধ, নির্বিচারে কাউকে আঘাত করাও মহাপাপ। প্রথম পক্ষের উসকানিমূলক পথ পরিহার করতে হবে, খুনিদের ছাড়তে হবে বিপথগামিতার পথ।

পুলিশ আয়োজিত এ জাতীয় সম্মেলনে ধর্মীয় নেতাদের পাশাপাশি সমাজের সুশীলদেরও আমন্ত্রণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় সমকণ্ঠে উচ্চারণ হতে পারে ধর্মের নামে হত্যার বিরুদ্ধে শক্তিশালী স্লোগান। শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলায়ও ছড়িয়ে যেতে পারে মুষ্টিবদ্ধ এই সম্প্রীতির শক্তি। তবেই সম্প্রীতির এ চেতনা ঘিরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে সারা দেশে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিষয়ে সব ধর্মের নেতাদের অভিমত ও ধর্মীয় গ্রন্থের উদ্ধৃতি সংবলিত পুস্তিকাও প্রকাশ করা যেতে পারে। ধর্মীয় আলেম ও পণ্ডিতদের সমন্বয়ে রচিত হতে পারে মহামূল্যবান গ্রন্থ। সর্বোপরি সমাজের প্রতিটি মানুষ যেন সম্প্রীতির আলোয় আলোকিত হয়। মুষ্টিবদ্ধ অঙ্গীকার করে সোনার বাংলা গড়ার।

ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলনে ধর্মমত নির্বিশেষে মানুষ অংশ নিয়েছেন। নেতৃস্থানীয়রা এক টেবিলে পাশাপাশি বসেছেন। গল্প করেছেন। নিজেদের মত ও পথকে তুলে ধরেছেন একে অপরের কাছে। এতে করে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বৈষম্যের যে অদৃশ্য চিত্র ভাসমান ছিল মানুষের ভিতর তা দূর হয়েছে। দূর থেকে মানুষ দেখেছে সম্প্রীতির ভিতর সুখ আছে। সম্মিলিত কাজের মধ্যে আছে মহাশক্তি। যা অশুভ বস্তুকে এক নিমিষে উড়িয়ে নিতে সক্ষম।

বাস্তবিক পক্ষে এ নীতি বা আদর্শই মহানুভবতার শিক্ষা দেয়। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) একজন ইহুদির লাশ যাচ্ছে দেখেও দাঁড়িয়ে গেছেন সসম্মানে। সাহাবারা যখন জিজ্ঞেস করেছেন, এ তো ইহুদির লাশ— তিনি সরলভাবে জবাব দিয়েছেন ও ইহুদি আমি জানি। কিন্তু সে তো একটা মানুষ। আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব। তার ভিতর একটি সত্তা রয়েছে। ওই ভিতরের মানুষটাকে আমি সম্মান করেছি। মানুষে মানুষে এ সম্মান। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি উদার চিন্তাই তো সম্প্রীতির শিক্ষা। সব নবী ও ধর্মের শিক্ষা। তাহলে আমরা কেন পথ উল্টে উগ্রতার দিকে হাঁটব। যে পথ কাঁটাযুক্ত তা জেনেও কেন সতর্ক হব না। মানুষ চিন্তাশীল জাতি। তাকে সৃষ্টিকর্তা মেধা ও মন দিয়েছেন যাতে সে চিন্তা করতে পারে। ভালো-মন্দের হাজারটা দ্বন্দ্বের ভিতর থেকে উত্তমটা বের করতে পারে এবং সেই পথ ধরে হাঁটতে পারে। এটাই তো সম্প্রীতির বৃহত্তর আহ্বান। এ আহ্বানকে শ্রদ্ধা ও মর্যাদাশীল অবস্থানে এনে একে মূল্যায়ন করতে হবে।  তবেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যাবে সম্প্রীতির আবহ।

লেখক : সংসদ সদস্য ও সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

সর্বশেষ খবর