বুধবার, ১৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

শেখ হাসিনা আপনিই তো বাংলাদেশ

বাহালুল মজনুন চুন্নু

সেই এক দিন এসেছিল এ বাংলায়। আর সব দিনের চেয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম। জাতির পিতার মৃত্যুর পর থেকে দিশাহারা দিগ্ভ্রান্ত হয়ে যে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা, সেই নির্লিপ্ত আশাহীন জীবনে ছেদ পড়েছিল সেদিন। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর পর ওইদিন বুঝেছিলাম, সময় আসছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে যারা ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করছিল, দেশকে যারা পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল কূটকৌশলের মাধ্যমে, সেসব পরাজিত শক্তিকে এ বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ করার। যার হাত ধরে একটি জাতির জন্ম, তারই উত্তরসূরি যে জাতির ক্রান্তিলগ্নে জীবন বাজি রেখে এগিয়ে যাবেন সম্মুখপানে, জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হবেন, তা সেদিনই বুুঝেছিলাম। লক্ষ কোটি জনতা সেদিন তা বুঝেছিল, উপলব্ধি করেছিল হৃদয় দিয়ে। সেই দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৯৮১। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে। এদেশের ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের কালো মেঘের ঘনঘটা, ক্যু-হত্যা যখন নিত্যনৈমিত্তিক, জাতি যখন নেতৃত্বশূন্য ও লক্ষ্যভ্রষ্ট; তখনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। ওবায়দুল কাদের তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আর আমি সাধারণ সম্পাদক। নেতা আসবেন, তাই তাকে স্বাগত জানানোর জন্য এক মাস আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। আমরা সংগঠিত করেছিলাম ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। ১৫ আগস্টের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলাম— এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব সৃষ্টি হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেব, ছাত্রলীগকে সংগঠিত করব। আমরা সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছিলাম। ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জড়ো হয়েছিল সেদিন। তারপর সেখান থেকে আমরা গিয়েছিলাম বিমানবন্দরে, নেতাকে স্বাগত জানাতে। পুরো বিমানবন্দর এলাকা লোকে লোকারণ্য, যেন জনসমুদ্র। গণতন্ত্রের মুখোশধারী স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু আর অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে সেদিন জনসমুদ্র ছুটে এসেছিল প্রাণের নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে। সবার মুখে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান। হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি, রঙিন পোস্টার, ব্যানার, নৌকার প্রতিকৃতি। সেই জনসমুদ্র দেখে আবেগে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। পিতা এবং তার কন্যার প্রতি মানুষের এত গভীর ভালোবাসা দেখে আবেগের অশ্রুকে রুদ্ধ করতে পারিনি সেদিন।

আকাশ ছিল মেঘলা। নেত্রীকে এক নজর দেখার জন্য সবাই রানওয়ের ভিতর ঢোকার চেষ্টা করছিল। নিরাপত্তা বাহিনীকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। আমরা রানওয়ের ভিতরে ছিলাম। নেতাকে বয়ে আনা বিমান যে অবতরণ করবে সে জায়গাও ছিল না। সেদিন আমরা জনতাকে বহু কষ্টে সরিয়ে বিমান অবতরণের জায়গা করে দিয়েছিলাম। জাতির পিতার রক্তে ভেজা মাটিতে বিমান স্পর্শ করার খানিক পরেই আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। বাংলার আকাশ বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় তনয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খুশিতে আবেগে অঝরে কেঁদেছিল সেদিন। নেতাকে বহনকারী বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জনতার মিছিল যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে বহনকারী বিমান ছুঁয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন অনেকেই।

এর কিছুক্ষণ পর বিমানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পুষ্পার্ঘে শোভিত বঙ্গবন্ধুর কন্যা জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দ-বেদনায় কান্নার রোল ওঠে সমগ্র বিমানবন্দর এলাকাজুড়ে। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, স্লোগানের মাধ্যমে নেত্রীকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জনতার কণ্ঠে বজ্র নিনাদে ঘোষিত হচ্ছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম-পিতৃ হত্যার বদলা নেব’ স্লোগানটি। এই স্লোগানটির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি, শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা। মানুষের সেই তীব্র ভালোবাসা দেখে শেখ হাসিনা নিজেও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। এতদিন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ জমাট বেঁধে ছিল বুকের ভিতরে, তা অশ্রুবিন্দু হয়ে দু’চোখ বেয়ে নেমেছিল তার। সেদিন তিনি পিতা-মাতা, ভাই-বোনসহ স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে শেরেবাংলানগরের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘বাংলার জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি এসেছি, মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমি এসেছি— আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আমি ঘরসংসার করছিলাম। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। আমার আর হারানোর কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ছোট ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ সেদিন তার সেই বক্তৃতা দিশাহারা আমাদের দিয়েছিল নতুন আলোর দিশা, নতুন জীবনের দিশা। তারই হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে দেশ দায়মুক্ত, কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। তারই বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বত্রই আজ উন্নয়নের জোয়ার। আজকের বাংলাদেশের এ উন্নয়নের ভিত্তিমূল শেখ হাসিনার সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই রয়েছে। তিনি যদি দেশে ফিরে না আসতেন, না হাল ধরতেন, তবে বাংলাদেশ আবারও ফিরে যেত পাকিস্তানের করতলে। আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দ্বারপ্রান্তে তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর পরই ক্যারিশমেটিক নেতা হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হচ্ছে। কর্ম ও গুণের স্বীকৃতিস্বরূপ সাউথ সাউথ, চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থসহ বিভিন্ন পুরস্কারে তাকে ভূষিত করছে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। ধৈর্য ও সাহসের প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা বহুমাত্রিক এক জ্যোতিষ্ক।  তাকে কেন্দ্র করে, তার নেতৃত্বেই আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। সেজন্যই প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই বলতে হয়, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।  আপনি দীর্ঘজীবী হোন।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ খবর