বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাকিস্তান সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিক

হায়দার আকবর খান রনো

পাকিস্তান সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিক

একদা ঘাতক আলবদর বাহিনী প্রধান ও পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হয়ে গেল। মানবাধিকারবিরোধী অপরাধের জন্য তিনি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে জামায়াত ও তাদের দ্বারা গঠিত আলবদর, আলশামস ইত্যাদি ঘাতক বাহিনী গঠন ও পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ইত্যাদির কথা কে না জানে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের দেশে যে নৃশংস-বর্বর গণহত্যা ও গণধর্ষণ করেছিল, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি হিটলার মুসোলিনীর বর্বরতা, নৃশংসতাও এর তুলনায় সামান্য বলে মনে হবে। আমার বয়েসী যারা তারা স্বচক্ষেই এসব দেখেছেন।

এটা খুবই দুঃখজনক যে, সেই নরঘাতকরা এতকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এমনকি মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো ক্রিমিনালরা মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন বিএনপি দলনেত্রী খালেদা জিয়া। এবারও মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হলে খালেদা জিয়া ও বিএনপির নীরবতাও এক ধরনের অর্থ বহন করে। মনে হয় যেন পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা তাদের ওপর ভর করে আছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান তো ক্ষেপে আগুন। তারা যেন দ্বিতীয়বারের মতো পরাজিত হলো। তাই শুনতে পাচ্ছি, অক্ষমের আস্ফাালন। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নিজামীর প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রস্তাব নিয়েছে। সঙ্গে কিছু আবোল তাবোলও বকতে শুরু করেছে। তাদের কোনো কোনো সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ নিজামীর ফাঁসির বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করার মতো মূর্খতা ও ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপেছে তুরস্কের ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল সরকার, যারা মতাদর্শগতভাবে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ। তুরস্ক তাদের ঢাকার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপরও, কেন তারা নিজামীর ফাঁসির প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। তুরস্ক ও পাকিস্তান সরকারের এই বোধোদয় হয়নি যে, তাদের মতো সারা বিশ্ব পাগল হয়ে যায়নি।

তুরস্ক যে নিজেই তার দেশে কুর্দি জনগোষ্ঠীর ওপর যে ধরনের বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে, তা নিয়ে বরং পৃথিবীতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। আইএসকে যে তুরস্ক সাহায্য করে আসছে, এটাও অজানা নয়। সেই তুরস্ক এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলিয়ে একজন ঘৃণ্য ঘাতকের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

পাকিস্তানের ভূমিকা দেখেও আমি অবাক হয়নি। তবে দুঃখ হয় যে, চার দশকের বেশি অতিক্রান্ত হলেও দেশটির কোনো পরিবর্তন হলো না। ১৯৭১ সালে তাদের পূর্বসূরি যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছিল, সে জন্য কোনো অনুশোচনা ও লজ্জাবোধ তো নেই-ই বরং ’৭১-এর ঘাতকদের প্রতি এখনো সহানুভূতিশীল। ভাবছি, কবে যে তারা মানুষ হবে। কবে যে পাকিস্তান সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। যে প্রতিক্রিয়াশীল সেনা চক্র দেশটিকে কার্যত শাসন করছে, তারা পাকিস্তানকে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। কিন্তু তারপরও সেই দেশের শাসকদের কোনো উপলব্ধি হলো না। সেই দেশের জনগণের জন্য সত্যিই দুঃখ হয়।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নিজামীর একমাত্র অপরাধ ছিল, তিনি পাকিস্তানের সংবিধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, আসলেই সেটা বড় ধরনের অপরাধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া আমাদের দৃষ্টিতে অপরাধ। রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু এখন যে বিচার হচ্ছে তা সেই রাজনৈতিক অপরাধের জন্য নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার মতো অপরাধ, অথবা অন্য ভাষায় দালালি করার যে অপরাধ, তা ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বিপ্লবে বিজয় লাভের পর ভিয়েতনামও মার্কিনি দালালদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দিয়ে মুক্ত করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অপরাধ ছাড়াও হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি যে জঘন্য ক্রিমিনাল অপরাধ তা দালাল আইনের বহির্ভূত বিষয়। সেই অপরাধের জন্য কখনই ক্ষমা করা হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এত বছরেও তার বিচার হয়নি। এবার বিচার শুরু হয়েছে এবং প্রায় সম্পন্ন হতে চলেছে। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ আমার ধারণা অন্য কেউ ক্ষমতায় থাকলে হয়তো এই বিচারকার্য শুরুই হতো না। বিচারকে ভণ্ডুল করার জন্য দেশি-বিদেশি চাপও ছিল। কালের কণ্ঠে এক প্রতিবেদনে মেহেদী হাসান (কালের কণ্ঠ ১৫ মে ২০১৬), জনৈক বিদেশি মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করেছেন এইভাবে— ‘এ বিচার ঠেকাতে কত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিদেশিদের কাছে তদবির করা হচ্ছে সে বিষয়ে হয়তো বাংলাদেশিদের ধারণাই নেই।’ আমরা জানি মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রগুলোর চাপ ছিল। জামায়াত বহু টাকা খরচ করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। মিথ্যা প্রচার ছিল— এই বিচার যথেষ্ট মানসম্মত নয়, যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়, ইত্যাদি। সেই চাপ ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা যে শেষ পর্যন্ত দৃঢ় থাকতে পেরেছেন, এ জন্য নিশ্চয়ই তিনি প্রশংসার দাবিদার।

পাকিস্তান বা পাকিস্তানের মতোই কোনো কোনো মহল বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে অভিযোগ তুলেছে, তা হলো বিচারটি  যথেষ্ট মানসম্মত নয়, যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। আমি বরং বলব, এই যে বিচার চলছে দীর্ঘ সময় ধরে তার চেয়ে স্বচ্ছ, মানসম্মত পৃথিবীর আর কোনো আন্তর্জাতিক বিচার কখনো হয়নি। ঐতিহাসিক টোকিও ট্রায়ালে জাপানের প্রধানমন্ত্রীসহ নয়শত মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল স্বল্প সময়ের বিচারে। টোকিও বা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের চেয়ে বা পরবর্তীতে হেগে অনুষ্ঠিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের তুলনায় বাংলাদেশের এই বিচার প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বচ্ছ ও আসামিদের প্রতি উদার। টোকিও ট্রায়ালের অন্যতম জুরি রাধা বিনোদ পাল নিজেই বিচারের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। করপোরেট পুঁজির অর্থে লালিত পাশ্চাত্যের কোনো কোনো তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা যারা সাদ্দামের প্রহসনমূলক বিচারের সময় নীরব ছিল, তারা হঠাৎ করে বাংলাদেশের এই মানবাধিকারবিরোধী অপরাধের বিচারে হৈচৈ শুরু করছেন। কারণটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।

পাকিস্তান দিল্লি সম্মেলনের কথাটা উত্থাপন করেছে। কী হয়েছিল দিল্লি সম্মেলনে। ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠক হয় দিল্লিতে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাক্রমে ড. কামাল হোসেন, শরণ সিং ও আজিজ আহমদ নিজ নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন। ৯ এপ্রিল তিন মন্ত্রীর স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাও প্রকাশিত হয়। সেই ঘোষণায় অবশ্য ‘ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ’ কথাটি উল্লিখিত ছিল। আরও বলা ছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বরাত দিয়ে (কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত) এই একটি কথা ‘বাঙালি জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয়।’ নতুনভাবে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের একটা সম্ভাবনাময় কথা ভাবা হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন পাক সেনাকে মুক্তি দিয়েছিল। পাকিস্তান কথা দিয়েছিল তারা পাকিস্তানেই তাদের বিচার করবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা সে বিচার করেনি। কিন্তু কখনই রাজাকার, আলবদর, যারা বাংলাদেশি নাগরিক হয়েও হত্যা, ধর্ষণের কাজ করেছিল তাদের ক্ষমা করার কথা হয়নি। এখন আমরা সেই প্রতীক্ষিত, অতি কাঙ্ক্ষিত বিচারটাই করছি। এতে পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনো যুক্তি নেই।

কালের কণ্ঠের পাতায় সাংবাদিক মেহেদী হাসান যথার্থই বলেছেন, এই বিষয় নিয়ে জাতিসংঘে তুললে পাকিস্তান নিজেই বিপদে পড়বে। নতুন করে প্রকাশ হয়ে পড়বে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নৃশংস গণহত্যা, গণধর্ষণের ইতিহাস। তাছাড়া এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো দেশের সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর কোনো অধিকারই নেই। পাকিস্তান জাতিসংঘে উত্থাপনের চেষ্টা করলে নিজেই খেলো হবে, মূর্খতার পরিচয় দেবে।

সবশেষে আমি আশা করব, পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম অতীতের গ্লানি মুছে ফেলে পূর্বপুরুষের বর্বরতার জন্য কম করে হলেও লজ্জাবোধ করবে এবং এভাবে সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দেবে এবং তখনই নতুন প্রেক্ষাপটে আমাদের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হবে।

     লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর