মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

তিলাওয়াতকারী যেন আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

তিলাওয়াতকারী যেন আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন

মহান আল্লাহর অপার মহিমায় নূরের কোরআন লাউহে মাহফুজ থেকে শবেকদরে বাইতুল ইজ্জতে অবতরণ করে। এ নূরের কোরআন, নূরের ফেরেস্তা হজরত জিবরাইল আমিনের মাধ্যমে জাবালে নূরে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অবতীর্ণ হয়। ‘এটা এমন এক গ্রন্থ যাতে কোনো ভুল বা সন্দেহ নেই।’ (সূরা বাকারা : ২) এ কিতাবের এমন শক্তি বা আকর্ষণ রয়েছে যা সুহৃদ পাঠকের জীবন বদলে দিতে পারে। যেমন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘এটি মুত্তাকিদের জন্য পথপ্রদর্শক।’ (সূরা বাকারা : ২) অন্যত্র আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘এটি প্রত্যেক মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫) এ দুই আয়াতের তাত্পর্য হলো, কোরআন বিশেষভাবে আল্লাহভীরুদের জন্য আর সাধারণভাবে সব মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক। (তাফসিরে মাফাতিহুল গায়েব) কোরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে কোরআন পড়তে হবে, তিলাওয়াত করতে হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পড়ুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক : ১) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘কোরআন পড়ুন তারতিলের সঙ্গে।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল : ৪) কোরআন পড়তে হবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে বুঝে বুঝে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যখন কোরআন পড়া হয় তখন তোমরা চুপ হয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনো। তাতেই তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ (সূরা আরাফ : ২০৪) বোঝার জন্য আল্লাহতায়ালা কোরআন সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি কোরআনকে বোঝার ও উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছি। অতএব, উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ (সূরা আল-কামার, ৫৪ : ১৭, ২২, ৩২, ৪০)

রমজান কোরআন নাজিলের মাস। মাসজুড়ে রোজা রাখলাম, সেহরি ও ইফতারি খেলাম। কিন্তু কোরআন তিলাওয়াত করলাম না। কোরআনের বিধান বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলাম না। তাহলে এর দৃষ্টান্ত হবে এমন— একজন সম্মানিত মেহমানের জন্য মঞ্চ সাজানো হলো। কিন্তু যখন তিনি এলেন তখন কেউ তাকে অভ্যর্থনা জানাল না। অবশেষে তিনি অসহায়ের মতো ফিরে গেলেন। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাসে বেশি বেশি কোরআন পড়তে হবে। কোরআন তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে আর আল্লাহর দেওয়া জীবিকা থেকে গোপনে এবং প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যাতে ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহ তাদের কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে আরও বেশি দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী। (সূরা ফাতির : ২৯-৩০।) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহর আয়াত শোনানো হলে তাদের ইমান বেড়ে যায়।’ (সূরা আনফাল : ২)

কোরআন তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য সহি হাদিস রয়েছে। হজরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।’ (বুখারি) হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের জ্ঞানী হবে, কিয়ামতের দিন সে সম্মানিত ফেরেস্তাদের সঙ্গে থাকবে। আর যে কোরআন শেখার চেষ্টা করবে, শিখতে শিখতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে অর্থাৎ শেখার জন্য সে চেষ্টা করে, তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে। (বুখারি) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পড়বে বিনিময়ে তাকে একটি সওয়াব দেওয়া হবে। আর প্রতিটি সওয়াব ১০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।’ (তিরমিজি)

কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে যখন আপনজন এবং ধনসম্পদ কোনো কাজে আসবে না তখন কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। হজরত আবু উমামা আল বাহিলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কোরআন তিলাওয়াত কর। কারণ কিয়ামতের দিন কোরআন তার তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।’ (মুসলিম) বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন কোরআন তার তিলাওয়াতকারী ও আদেশ-নিষেধ মান্যকারীকে বলবে, আমাকে চিনতে পারছ? আমি সেই কোরআন যে তোমাকে রোজার আদেশ দিয়ে দিনে পিপাসার্ত আর রাতে নামাজে রত রেখেছি। প্রত্যেক ব্যবসায়ীই তার ব্যবসার মাধ্যমে লাভবান হতে চায়। আজ তুমি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছ। তারপর ওই বান্দার ডান হাতে বাদশাহি, বাম হাতে জান্নাতে বসবাসের পরোয়ানা দেওয়া হবে। মাথায় নূরের তাজ পরানো হবে এবং বলা হবে, কোরআন পড়তে থাকো আর উচ্চ মাকামে উঠতে থাকো। (মুসনাদে আহমাদ)

কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন। খেয়াল রাখতে হবে আমাদের তিলাওয়াত যেন সহি হয়। অশুদ্ধ তিলাওয়াতে সওয়াবের পরিবর্তে গুনার সম্ভাবনা রয়েছে বেশি। তা ছাড়া অশুদ্ধ তিলাওয়াতে নামাজ হয় না। নামাজ ভঙ্গের ১৯টি কারণের মধ্যে অশুদ্ধ তিলাওয়াত একটি। আমরা যারা এখনো সহিভাবে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারি না খুব দ্রুতই সহি তিলাওয়াত শেখার চেষ্টা করব। রমজানকে সহি তিলাওয়াতের মাস হিসেবে কাজে লাগাব। ইমাম ও খতিবদের উচিত মুসল্লিদের রমজানে তারাবির আগে অন্তত সূরা ফিল থেকে নাস পর্যন্ত কোরআন সহিভাবে তিলাওয়াত, মশক করানো এবং তরজমা শেখানো। আল্লাহ আমাদের কোরআন তিলাওয়াত ও বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

            www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর