নবী (সা.) ৪০ বছর ধরে মানুষ হওয়ার সবক শিখিয়েছেন জনগণকে। তারপর তিনি আস্তে আস্তে ধর্মের বাক্য শিখিয়েছেন। মানুষ হলেই কেবল কেউ ধারণ করতে পারবে ধর্ম। আর যদি মানুষ না হয় কেউ, তবে তার ধর্মটা হয়ে যাবে মুখোশ পরা ধর্ম। হায় কবে আমরা মানুষ হব। যেদিন আমরা মানুষ হয়ে ধার্মিক হব, সেদিন থেকেই আমাদের ধর্ম সর্ব ধর্মাবলম্বীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ধর্ম ও ধার্মিকরা পাবেন সম্মান।
দুনিয়াজুড়ে মুখোশ পরা মানুষের ভিড়ে সহজ-সরল সত্য মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। ভালো মানুষের মুখোশ পরে খারাপ মানুষগুলো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ কারণেই কবি বলেছেন, ‘মুখ দেখে কি মানুষ চেনা যায়?’ মুখ ও মুখোশের আড়ালে মানব চরিত্রে লুকিয়ে থাকা পশুত্ব হেসে কুটি কুটি খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষ বেশে মানুষ ঠকিয়ে মুখোশ পরা দুপেয়ে জয়োল্লাস দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রশ্ন হলো মানুষ কীসের মুখোশে নিজের পশুত্ব ঢাকে? তা তো অবশ্যই কোনো পশুর মুখোশ নয়। যেমনটা ছোটবেলায় আমরা বাঘের মুখোশ পরে নিজের চেহারা লুকাতাম। শুধু বন্ধুদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু আজ আমরা মুখোশ পরছি ভাইকে ঠকানোর জন্য। যে মুখোশ পরে মানব পরিচয় কলঙ্কিত করছি সে মুখোশের নাম কী? ধর্ম। ধর্মের মুখোশ পরেই আমরা মানুষ ঠকাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এমনকি কেউ বলতে পারে আমরা ধর্মের অপব্যবহার করছি না? ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ ঠকানো ধার্মিকও অনেক সময় বুঝতে পারে না তার হাতেই ধর্মের কত বড় অপমান হচ্ছে।
মাদ্রাসা-মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, চার্চ যেখানেই যাই ধর্মের মুখোশ পরা একদল অমানুষের দেখা পাই। তারা নিজেদের জন্য ধর্ম ব্যবহার করছে। নিজেদের ধার্মিক আর স্রষ্টার কাছের লোক মনে করে মানুষকে তাড়িয়ে দিচ্ছে পাপী বলে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘মানুষ’ কবিতায় বিষয়টি খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কবিতাটির সহজ মর্ম তুলে ধরছি।‘গতকাল মসজিদে তাবারক হিসেবে গোস্ত-রুটি এসেছিল। সবাইকে খাওয়ানোর পরও অনেক খাবার রয়ে যায়। এই দেখে ইমাম সাহেব বেজায় খুশি। তিনি ভাবছেন, বাসায় গিয়ে পরিবারসহ মজা করে খাওয়া যাবে। বাজারের টাকাও বাঁচবে। এমন সময় একজন অভুক্ত পথিক ইমাম সাহেবকে বলল, হুজুর! আমি সাত দিনের অভুক্ত। আমাকে কিছু খাবার দিন।’ এর পরের অংশ নজরুলের মুখেই শুনি—
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা— ‘ভ্যালা হ’ল লেঠা
ভুখা আছ মর গো-ভাগারে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
ভুখারি কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল, —‘তা’ হলে শালা
সোজা পথ দেখ’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা।
অভুক্ত পথিক হাঁটছে আর ভাবছে। ভাবছে আর হাঁটছে। ‘আশি বছর পার করে দিলাম। কখনো খোদাকে ডাকিনি। খোদা তো একবেলার জন্যও আমার খাবার বন্ধ করে দেননি। তাহলে কি মসজিদ-মন্দিরে খোদা নেই? যদি মন্দির-মসজিদ খোদার ঘরই হয় তবে মোল্লা-পুরোহিত খোদার বান্দাকে দেখে কীভাবে তালা দেয়?
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুরি-শাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চরিয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতার মাঝের অংশ ছিল এটি। কবিতাটি আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। ছোটবেলায় যখন মাদ্রাসায় পড়তাম, তখন প্রায় দিনই মসজিদে তাবারক আসত। আর অভুক্ত মুসাফিরদের সঙ্গে হুজুররা এমন আচরণই করতেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এখনো মসজিদ-মন্দিরগুলোয় তাবারক নিয়ে এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। শুরুতেই আমি বলেছি, আমরা ধর্মের মুখোশ পরে অধর্মের কাজ করে যাচ্ছি ধর্মের লাইসেন্সে। আমরা মনে করি, আমার জামা, পাগড়ি, টুপি, মেসওয়াক আর ঢিলার আকার-আকৃতি, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ রসুলের মতো হচ্ছে। সুতরাং আমার ধর্ম ঠিক আছে। আমি বলি না। ধর্মের কিছুই ঠিক নেই আপনার। আপনি ধর্মের মুখোশ পরেছেন মাত্র। আর মুখোশ পরে মানুষ ঠকানো থেকে শুরু করে সুদ-ঘুষ পর্যন্ত দিব্যি হজম করতেও দ্বিধা করেন না আপনি। তারপরও মানুষ আপনাকে ‘বড় মানুষ’ বলেই জানে। কারণ আপনি মুখোশ পরা ধার্মিক। এই মুখোশ পরে দুনিয়ার মানুষকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব হলেও অন্তর্যামী খোদাকে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়। আর আপনাকে একটি সুসংবাদ (!) শোনাচ্ছি মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১০২ ও ১৩১৫।) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম : ১০১, মুসনাদে আহমাদ : ২৭৪৫০।)
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও গবেষণা আর হাদিস চর্চার কি মূল্য যদি না কোরআনের আয়নায় মানুষ হতে না পারি? যদি না রসুলের সুন্নত মানব ধর্ম চর্চা করতে না পারি? কোরআন-বেদ চুমু খেয়ে কী সওয়াব যদি না মানুষকে ভালোবেসে বুকে টানতে না পারি? ‘মানুষ’ কবিতার পরের অংশ দিয়েই লেখাটি শেষ করিছ।
ও’ কারা কোরান-বেদ, চুম্বিছে মরি মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ জোর ক’রে নাও কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!- মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; —গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
www.selimazadi.com