শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঐতিহ্য ভুলে গেলে আধুনিকতাও মুখ ফেরাবে

প্রভাষ আমিন

ঐতিহ্য ভুলে গেলে আধুনিকতাও মুখ ফেরাবে

২৭ জুলাই মধ্যরাতে জনপ্রিয় আঞ্চলিক দৈনিক কুমিল্লার কাগজের তরুণ সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয়ের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। স্ট্যাটাসটি ছিল, ‘কুমিল্লার ঐতিহ্যও কি ধ্বংস করে ফেলবেন আপনারা? কুমিল্লাকে নিয়ে গর্ব করার মতো কিছুই রাখবেন না? রাতের আঁধারে এই মুহূর্তে পূবালী চত্বরের পূবালী ব্যাংক ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কী তাজ্জব ব্যাপার একবারও কেউ ভাবছেন না এটি একটি ঐতিহ্য। এটি ভবন নয়। যে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভেঙে ফেলা যায়। ... কুমিল্লার মানুষ আসলেই দুর্ভাগা।’ মধ্যরাতে পূবালী ব্যাংক ভবনে নয়, হাতুড়ি পড়ছিল যেন আমার বুকে। এক লাফে পিছিয়ে গেলাম ৩০ বছর।

৮৬, ৮৭, ৮৮—স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমাদের প্রাণকেন্দ্র ছিল পূবালী চত্বর। দিনভর শাসনগাছা থেকে চকবাজার পর্যন্ত মিছিল করে সমাবেশ হতো পূবালী চত্বরে। অবশ্য হরতাল বা কোনো কর্মসূচির দিনে পূবালী চত্বর থাকত পুলিশের দখলে। আমরা নজরুল এভিনিউ, বোর্ড অফিসের দিকে বা কলেজ রোড থেকে পুলিশের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলতাম। ৯০-এর নভেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের শেষ সময়টায় আমি ঢাকায়ই ছিলাম, আন্দোলনের মাঠে ছিলাম। আম্মা ঢাকা এসে জোর করে আমাকে কুমিল্লা নিয়ে যান। আমার জীবনের একটা বড় আফসোস এরশাদের পতনের ক্ষণটায় আমি ঢাকায় থাকতে পারিনি। ৬ ডিসেম্বর রাতে ছিলাম কুমিল্লায়। এরশাদ পতনের খবর শুনে লুঙ্গি পরেই তাত্ক্ষণিক রাস্তায় নেমেছিলাম। ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম পূবালী চত্বরে। ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে থাকতে না পারার আক্ষেপ মিটিয়েছিলাম পূবালী চত্বরে পাগলের মতো উল্লাস করে। মনে আছে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা পূবালী চত্বর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার নজরুল এভিনিউর মুখে ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছিলেন। উত্তেজিত জনতা আফজাল খানের বাসায় হামলা করতে যেতে চেয়েছিল। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগ করে আসা আফজাল খান এখনো আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গেই আছেন। তবে কোন ভূতে পেয়েছিল কে জানে, এরশাদের শেষ সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাই উত্তেজিত জনতার মূল ক্ষোভটা ছিল তার ওপর। তবে সিনিয়র নেতাদের কঠোর নজরদারিতে সেদিন কিছু ঘটেনি।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগে কাদের মোল্লার লঘুদণ্ডে ফুঁসে উঠেছিল সর্বস্তরের মানুষ। ঘটেছিল অভূতপূর্ব গণজাগরণ। ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় হৃদয়ের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়। হৃদয় জানান, কুমিল্লার মানুষও নেমে এসেছে রাজপথে, সেখানে গড়ে উঠেছে গণজাগরণ। হৃদয়ের টেলিফোনে কুমিল্লার গণজাগরণের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিলাম ঢাকার গণজাগরণের। কুমিল্লার গণজাগরণের শুরুটা হয়েছিল টাউন হলের শহীদ মিনারে। তবে সেটা থিতু হয়েছিল সেই পূবালী চত্বরেই। এখনো কুমিল্লার গণজাগরণ মঞ্চ মানে পূবালী চত্বরই।

পূবালী চত্বর নিছক একটি চত্বর নয়, পূবালী ভবন নিছক একটি ভবন নয়। পূবালী চত্বর কুমিল্লার মানুষের মুক্তাঙ্গন। আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী। পূবালী ভবন ইতিহাসের আকর। হৃদয়ের স্ট্যাটাসের আগে অবশ্য দিনে প্রথম আলোয় ‘কুমিল্লায় পূবালী ব্যাংক ভবন এক সপ্তাহের মধ্যে ভাঙার নির্দেশ’ শিরোনামের সংবাদ পড়েও শঙ্কা জেগেছিল মনে। তবে সেটা যে সেই রাতেই ভাঙা শুরু হবে বুঝতে পারিনি।

কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী শহর। একসময় অবিভক্ত ভারতের, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল কুমিল্লা। ২২ জুলাই ঢাকার তোপখানায় কুমিল্লা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব ঢাকার দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম যখন কুমিল্লার ইতিহাস, ঐতিহ্য তুলে ধরছিলেন; বার বার শিহরিত হচ্ছিলাম। এই কুমিল্লা আমার প্রাণের শহর, আমার ভালোবাসার শহর। আমার যৌবনের উত্তাল সময় কেটেছে এই কুমিল্লায়। কুমিল্লার রাস্তায় হাঁটতে গেলেই আমি শিহরিত হই। এখানে নজরুল হাঁটতেন। এখানে বসে নজরুল কবিতা লিখতেন। এখানে আড্ডা মারতেন। এই বুঝি বাতাসে ভেসে এলো শচীন কর্তার নাকি কণ্ঠ ‘তোরা কে যাসরে...’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে কুমিল্লা। বুদ্ধদেব বসুর জন্ম কুমিল্লায়। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁদের সেতার ঝঙ্কার তুলেছে কুমিল্লার বাতাসে। পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লার সন্তান। গর্বে আমার বুক ফুলে যায়। কিন্তু হায়, আমরা কি সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারছি। শিল্প-সংস্কৃতির শহর কুমিল্লায় এখন বাণিজ্যের উৎকট প্রকাশ, লোভের অশ্লীল থাবার বিস্তার চারদিকে। এ এক অদ্ভুত আত্মহনন প্রবণতা। ঐতিহ্যকে যারা রক্ষা করতে পারে না, তারা বড় দুর্ভাগা।

পূবালী ব্যাংক ভবনটি ১০২ বছরের পুরনো। এটা বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, মানলাম। ২৫ জুলাই ভবনটির একটি অংশ ভেঙে একজন পথচারী আহত হয়েছেন, তাও মিথ্যা নয়। তাই বলে ৭ দিনের মধ্যে পূবালী ভবন ভেঙে ফেলতে হবে? ঝুঁকিটাই কি একমাত্র বিবেচনা? ঝুঁকি বিবেচনায় নিলে তো কুমিল্লা কেন, বিশ্বের অনেক শহর ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। পূবালী ভবন কুমিল্লার কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড়ে। কুমিল্লার নগরপিতা নিশ্চয়ই কল্পনায় এখানে ২৫ তলা টাওয়ার দেখতে পাচ্ছেন। যা তার নগরের চেহারাই পাল্টে দিতে পারে। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা ঐতিহ্যকে দুমড়ে-মুচড়ে তার ওপর আকাশছোঁয়া ভবন বানাব, নাকি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে, তার পাশে নতুন ভবন বানাব? কে জানে, দুদিন পর কে আবার রানীর কুটিরকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে বুলডোজার চালিয়ে দেয়। ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে রানীর কুটিরের জায়গায় একটি ২০ তলা লেকভিউ অ্যাপার্টমেন্ট তুললে কেমন হয়? আহা, লোভে কতজনের চোখ যে চকচক করছে, কে জানে। কল্পনা নয় মোটেই। কুমিল্লার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল নজরুলের অনেক স্মৃতি। আজ তার কিছুই নেই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, অস্তিত্ব নেই নজরুলের শ্বশুরবাড়িরও। শচীন  দেব বর্মণের যে বাড়িতে নজরুল আর শচীন গানের আসর বসাতেন, দীর্ঘদিন সেটি মুরগির খামার হয়েছিল। নজরুল-শচীনের স্মৃতিধন্য বাড়িতে মুরগির খামার, এ যে কত বড় পাপ, তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমাদের। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচির পর, শচীন কর্তার বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। কাউকে কিচ্ছু করতে হবে না, কয়েক বছর পর এমনিতেই, যে বাড়ি থেকে একাত্তরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই বাড়িটি মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। হায়, আমরা কতই না অকৃতজ্ঞ। ভাষা সংগ্রামের অগ্রসেনানী, একাত্তরে যিনি জীবন দিয়েছেন; সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আমরা কুমিল্লার সাইনবোর্ড বানাতে পারতাম; তাকেই কিনা আমরা ভুলে বসে আছি অবলীলায়। তার স্মৃতিকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছি। আসলে তো ধুলায় মেশাচ্ছি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার।

কুমিল্লাকে বলা হতো ব্যাংক আর ট্যাংকের শহর। নিশ্চয়ই নগরপিতাদের এ উপাধি পছন্দ নয়। তাই তো কখনো রাতের আঁধারে, কখনো দিনেদুপুরে ভূমিদস্যুরা ভরাট করছে দীঘি-পুকুর। নগরীকে ট্যাংক মানে জলাধারমুক্ত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তাদের। এবার নজর গেছে ব্যাংকে। আমাদের চাই ব্যাংক ও ট্যাংকমুক্ত উঁচু উঁচু আকাশছোঁয়া ভবনের কুমিল্লা। নইলে কারও মাথায় পূবালী ভবন ভাঙার চিন্তা আসতে পারে? পূবালী ভবন মানেই এ অঞ্চলের ব্যাংকের ইতিহাস। ১৯১৪ সালে নির্মিত নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এই দোতলা ভবনেই শুরু হয়েছিল দ্য কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেডের যাত্রা। এই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছিল এটি। আর শাখা ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, দিল্লি, লক্ষেৗ, কানপুর, কটক, বোম্বেতে। এই অঞ্চলের অন্যতম পুরনো এই ব্যাংক ভবনটি ১৯৬৩ সাল থেকে পূবালী ব্যাংক ব্যবহার করছে। যে ভবনটি হতে পারে এ অঞ্চলের ব্যাংকিং খাতের জাদুঘর, সেটিকে আমরা ৭ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে চাচ্ছি! এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের বুক একটুও কাঁপলো না? আমরা কি মানুষ না অমানুষ, আমরা কি বোকা নাকি অতি চালাক।

কেউ ভাববেন না, আমি প্রগতি, উন্নতি, আধুনিকতা, সমৃদ্ধিকে দূরে ঠেলে; ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে চাই। ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করেই তার পাশে আধুনিক শহর গড়ে তোলা সম্ভব। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেল দিতে পারাটাই মুনশিয়ানা। ঐতিহ্যকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। অতীত ভুলে, ঐতিহ্য ভুলে কোনো দেশ, কোনো জাতি, কোনো শহর এগোতে পারে না।

এখন কুমিল্লায় গেলে চোখ জুড়িয়ে যায়। শহরজুড়ে ব্যস্ততা, যানজট, বড় বড় মার্কেট, উঁচু উঁচু ভবন। উন্নতি দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু এসবের সঙ্গে আমি ফিরে পেতে চাই শান্ত, স্নিগ্ধ প্রাণের শহর, গানের শহর, শিল্পের শহর, ব্যাংকের শহর, ট্যাংকের শহর কুমিল্লাকে।

লেখক : সাংবাদিক

probhash2000gmail.com

সর্বশেষ খবর