শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

আপন মরণ-বাণে হয়ে যায় খান খান

যতীন সরকার

আপন মরণ-বাণে হয়ে যায় খান খান

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সেই ফ্যাসিবাদই যে আজ নতুন রূপ ধরে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এমন কথা অনেকেই বলছেন। এই ফ্যাসিবাদের স্বরূপ প্রকৃতি নিয়েও অনেক কথা বলা হচ্ছে। সে সব কথায় আমাদের কান দিতেই হবে। শুধু কান দেওয়া নয়, প্রাণের গভীরে বিষয়টির উপলব্ধি করে এর প্রতিরোধেও সক্রিয় হতে হবে।

আমরা জানি : ইতালির একনায়ক বেনিটো মুসোলিনি ১৯১৯ সালে যে উগ্র জাতীয়তাবাদী তত্পরতার সৃষ্টি করেছিলেন, তারই নাম ফ্যাসিবাদ। ইতালীয় ভাষায় ‘ফ্যাসিও’ শব্দটির অর্থ আঁটি বা গুচ্ছ। এক আঁটি ডাণ্ডা বা শলাকার সঙ্গে একটি কুড়াল— এই ছিল মুসোলিনি প্রতিষ্ঠিত উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের প্রতীক। এই প্রতীক থেকেই দলটির নাম হয়েছিল ‘ফ্যাসিস্ট’। ১৯২১ সালে একটি প্রচণ্ড শ্রমিক অভ্যুত্থানকে দমন করেই মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট দলটি ইতালির রাষ্ট্র ক্ষমতা  দখল করে নেয়। অন্য দেশেও— যেমন জার্মানি ও জাপানে এরকম রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীদেরও অভিন্ন পরিচয় হয়ে যায় ফ্যাসিস্ট নামে।

প্রত্যেক দেশেই ফ্যাসিস্টরা ছিল অন্য দেশ, জাতি ও বর্ণের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-বিদ্বেষ তথা উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রচারক। ইতালিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী ফ্যাসিস্ট দলের কর্মপন্থায় উগ্রজাতীয়তার অনুষঙ্গেই যুক্ত হয়েছিল স্বেচ্ছাচারিতা, কম্যুনিজম বিরোধিতা এবং পার্লামেন্ট ও গণতন্ত্র বিরোধিতা। ইতালির মতো জার্মানি ও জাপানের ফ্যাসিস্টরাও নানা রকম অপযুক্তির আশ্রয় নিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার করত। ইতালির ফ্যাসিবাদীরা বলত যে কৃষ্ণকায় মানুষেরা জন্মগতভাবেই শ্বেতকায়দের চেয়ে গুণেমানে নিকৃষ্ট। হিটলার শাসিত জার্মানির তীব্র ইহুদি-বিদ্বেষের মূলমর্ম নিহিত ছিল তথাকথিত ‘আর্য জাতি’ ও ‘নর্ডিক জাতি’র শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কীয় নািস মতবাদের মধ্যে। ‘জাপানিরা দৈবশক্তিসম্পন্ন জাতি’— এমন মতেরই ধারক ছিল জাপানি ফ্যাসিস্টরা।

সব দেশের ফ্যাসিবাদীদেরই ছিল দুটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। (১) স্বদেশে তাদের নীতি— ব্যাপকভাবে শ্রমজীবী জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে তাদের ক্রীতদাসের পর্যায়ে অবনমিত করা; এবং (২) তাদের বৈদেশিক নীতি-পরদেশ লুণ্ঠন ও পরদেশ দখলের জন্য যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া, আর এই উদ্দেশ্যে দেশের জনসাধারণের মধ্যে তীব্র জাতি বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা, সব ধরনের নীতি-আদর্শ বর্জন করে পরদেশের স্বাধীনতা হরণ করা, সামগ্রিক ধ্বংস ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া।

ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ও বিস্তারের কার্য-কারণ সম্পর্কটি উদঘাটনের অনেক প্রয়াস অনেক মহল থেকেই হয়েছে, কিন্তু সে-সব প্রয়াস খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি— বরং বিভ্রান্তির ধূম্রজালই ছড়িয়েছে। সেই ধূম্রজাল অপসারণের জন্য যারা মার্কসীয় দর্শনের আলোর প্রক্ষেপণ ঘটিয়েছেন, তারা দেখতে পেয়েছেন যে, ধনতন্ত্রের উচ্চতম পর্যায় সাম্রাজ্যবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য থেকেই উদ্ভব ঘটেছে ফ্যাসিবাদের। অন্য কথায় বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদই ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা।  সাম্রাজ্যবাদই ফ্যাসিবাদকে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতাপান্বিত হয়ে উঠতে থাকা সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতলব এঁটেছিল।

ফ্যাসিবাদ যে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক সামরিক একনায়কত্ব মার্কসবাদীরাই এই সত্যের উদঘাটক। তারাই দেখিয়েছেন, বুর্জোয়া শ্রেণি আসলে গণতন্ত্রের  মুখোশ পরে থেকেই প্রতিনিয়ত গণপ্রতারণা করে চলে, কখনো কোথাও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেয় না, দিতে পারে না।

সংকটেরকালে এই শ্রেণি গণতন্ত্রের মুখোশটিও খুলে ফেলে প্রকাশ্যেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন চালাতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এ রকম সংকটগ্রস্ত হয়েই কয়েকটি দেশের বুর্জোয়ারা তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সংকটের সব বোঝা শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সংকটের কবল থেকে মুক্ত হতে চায় এবং সেই উদ্দেশ্যেই ফ্যাসিবাদের আশ্রয়ে (অথবা অন্য কোনো নামে) প্রতিষ্ঠা ঘটায় প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক সামরিক একনায়কত্বের।

যেসব সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসকগোষ্ঠী এরকম সোজাসুজি একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি— অর্থাৎ  মুখোশের আড়ালে মুখের আসল চেহারাটা লুকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল যারা— তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাতেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্যাসিবাদ ক্রমান্বয়ে পুষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ইতালি, জার্মানি ও জাপানের মতো স্পেনেও এভাবেই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে।

১৯৩৫ সালে স্পেনের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল পপুলার ফ্রন্ট। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ফ্রন্ট গড়ে তুলেছিল।  কিন্তু স্পেনে এই ফ্রন্টের  অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দলের আভ্যন্তরিক বিরোধের সুযোগ গ্রহণ করে সাম্রাজ্যবাদীরা। তাদের সহযোগিতায় এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোর  চাপ ও ষড়যন্ত্রের ফলে পপুলার ফ্রন্ট ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। হিটলার মুসোলিনির সামরিক  সাহায্যে সেনাপতি ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্টরা গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং স্পেনে ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। স্পেনের ফ্যাসিবাদী দলটির নাম ছিল ফালাঙ্গস পার্টি, আর এর প্রতিষ্ঠাতার নাম— এন্টোনিও প্রাইমো দি রিভেরা।

ইতালি, জার্মানি, জাপান, স্পেন— এসব দেশেই ফ্যাসিবাদের উত্থানে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় সহযোগী সাম্রাজ্যবাদীরা  অনেক দিন ধরেই ফ্যাসিস্ট শাসকদের তোষণ করে চলছিল।  দ্বিতীয়  মহাযুদ্ধের আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন এবং ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ব্লুঁ ও দালাদিয়ের ছিলেন এই তোষণ নীতির প্রধান অনুসারী। হিটলার ও মুসোলিনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সম্মত হবে— এই আশায় গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স ১৯৩৭ সাল থেকেই এই দুই ফ্যাসিস্ট  ডিক্টেটরের অন্যায় দাবি পূরণ করে চলতে থাকে। এভাবেই ইতালির আবিসিনিয়া  জয়, জার্মানির অস্ট্রিয়া দখল, হিটলার-মুসোলিনির সাহায্যপুষ্ট  ফ্রাঙ্কোর স্পেনের শাসন কর্তৃত্ব দখল এবং জার্মানির চেকোস্লোভাকিয়া দখলের মতো সব ফ্যাসিস্ট অপকর্মকে সমর্থন দিয়ে যায় গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স।

সাম্রাজ্যবাদীদের এই তোষণ নীতির সুযোগ নিয়েই ফ্যাসিবাদ  নিজের শক্তি সংহত করে তোলে এবং একপর্যায়ে হিটলার পোলান্ডের ডানজিগ নামক একটি স্থানকে নিজের বলে দাবি করে পোলান্ড আক্রমণ করে বসে। আর তখনই ব্রিটেন ও ফ্রান্স তোষণ নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ  ঘোষণা করে এবং ১৯৩৯ সালেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত  ঘটে। যে সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিস্টদের দিয়ে সোভিয়েতকে ধ্বংস করার দিবাস্বপ্ন দেখছিল, সেই সাম্রাজ্যবাদকেই সোভিয়েতের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে নামতে হয়। ১৯৪২ সালের ২২ জুন হিটলারের নািস বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক সোভিয়েত জনগণের আত্মত্যাগই, প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে বিশ্বসভ্যতাকে রক্ষা করে। কিন্তু একান্ত বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পৃথিবীর অনেক দেশেরই অনেক বোদ্ধাজনও ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেননি। সাম্রাজ্যবাদীদের শাসন শোষণে জর্জারিত ছিল যে সব দেশ, সে-সব দেশেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সুবাদেই, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে মোহের সঞ্চার ঘটে গিয়েছিল। যেমন-পরাধীন ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তিলাভ প্রয়াসী জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের অনেককেও ফ্যাসিবাদী হিটলারের গুণমুগ্ধ হতে দেখেছি। এমনকি জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলন মঞ্চ থেকেই ‘মহাত্মাজী কি জয়, হিন্দুস্তান কী হিটলার কী জয়’— এমন স্লোগানও উচ্চারিত হতে শুনেছি। ফ্যাসিবাদীদের  হাতে ব্রিটিশের পরাজয় ঘটলেই ভারত স্বাধীন হয়ে যাবে— এরকম সর্বনেশে ভাবনায়  অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীও আত্মপ্রসন্ন হয়ে থেকেছেন।

এ সময়েই কলকাতা থেকে কম্যুনিস্ট বুদ্ধিজীবী বঙ্কিম মুখার্জি সম্পাদিত ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটি অসাধারণ প্রবন্ধ ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে’। রুশ বিপ্লবের পর দুনিয়াজোড়া ‘আসন্ন বিপ্লবের আশঙ্কায়’ সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে ‘ফ্যাসিজমের শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করে এসেছে’ সে-বিষয়টি  বিবৃত করেই তিনি লিখলেন— ‘সাম্রাজ্যবাদের ভরসা ছিল ফ্যাসিস্টরা প্রথমে আক্রমণ করবে দুনিয়ার মালিকদের চক্ষুশূল সোভিয়েত ভূমিকে।... আর সোভিয়েত ভূমিকে বিধ্বস্ত করতে পারলে, একবার পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশে অধিকার বিস্তার করতে পারলে, সোভিয়েত দেশের বিপুল ঐশ্বর্য করায়ত্ত করতে পারলে তাদের শক্তি লালসা চরিতার্থ হবে।  প্রাচীন, সুপ্রতিষ্ঠ সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে ফ্যাসিজম আর লড়তে চাইবে না।...

সাম্রাজ্যবাদের এই আশা ছলনামাত্র বলে প্রমাণ হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তকে ইতিহাস ব্যর্থ করে দিয়েছে। ... ফ্যাসিজমের প্রবল প্রতাপের সামনে ফ্রান্স মাথা নিচু করেছে, সারা ইউরোপ একটা গোলামখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।... যখন হিটলার তার পঙ্গপালকে সোভিয়েত আক্রমণ করার হুকুম দিল, তখন ইংরেজ-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ আর পরিত্রাণের আশা করতে পারল না...।  ইতিহাসের চাকা এমনভাবে ঘুরে গেছিল, সোভিয়েত মৈত্রী দেশে দেশে এমনভাবে ছড়িয়ে গেছিল যে, ফ্যাসিজমবিরোধী গণশক্তিকে আর উপেক্ষা করা চলল না। যা মাত্র কিছুকাল আগে ছিল একেবারে অভাবনীয়, সেই ঘটল। ইংরেজ আর আমেরিকান সরকার সোভিয়েতের সঙ্গে চুক্তি করল, নামজাদা সোভিয়েত বিরোধীরা সোভিয়েত প্রীতি প্রচার করতে বাধ্য হলো। গণশক্তির একটা সুযোগ এলো—  যুদ্ধ চালিয়ে ফ্যাসিজমকে ধ্বংস করে নতুন দুনিয়া গড়ার সুযোগ এলো।’

কিন্তু পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামীদের ভিতরকার একটি বিরাট অংশই বিষয়টি ধরতে পারল না, তারা বরং উল্টো বুঝে বসল।  তাদেরই কেউ কেউ বলল যে, ‘ফ্যাসিজম আর সাম্রাজ্যবাদের লড়াই আমাদের তাতে কী? আমাদের কাছে দুই-ই সমান।’ তাদেরই কারও কারও মুখে শোনা গেল যে, ‘ফ্যাসিস্টরা বলছেন যে আমাদের সঙ্গে তাদের  কারও ঝগড়া নেই, আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা তারা চায়, সুতরাং ইংরেজের বিরুদ্ধে তাদেরই বরং আমাদের সাহায্য করা উচিত।’

এরকম মোহগ্রস্তদের সতর্ক করে দিয়েই হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য— ‘এই অলীক মোহ যদি আমাদের আচ্ছন্ন করে থাকে তো সমূহ বিপদ উপস্থিত হবে।... দেশের উপকার করছি ভেবে ফ্যাসিস্ট কুমিরকে লোভ দেখিয়ে আনা হচ্ছে আত্মহত্যারই নামান্তর।...

ফ্যাসিস্টরা শ্রমিক আন্দোলন ধ্বংস করেছে, সাম্যবাদের তারা চিরশত্রু, স্বাধীন চিন্তা তারা উৎপাটিত করেছে, সভ্যতার বিরুদ্ধে বর্বর অভিযান তারা সর্বত্র চালিয়েছে... ফ্যাসিস্টরা আমাদের স্বাধীন করে দেবে ভাবার মতো বাতুলতা আর নেই।’

না, বাতুলতার পাকে আটকা পড়ে থাকেনি দেশের মানুষ। শুধু এদেশের নয়, সারা পৃথিবীরই জাগ্রতচৈতন্য মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে, আমাদের দেশেও দলমত-নির্বিশেষে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীসহ সব সচেতন মানুষ ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছেন, গড়ে উঠেছে ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘ’-এর মতো অনেক অনেক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন।

অবশেষে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল, মানবসভ্যতা সংকটমুক্ত হয়ে নবতর দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কিন্তু সংকট তো সত্যি সত্যিই পিছু হটে যায় না, নতুন নতুন রূপ ধরে সভ্যতাকে আক্রমণ করেই যেতে থাকে। সাম্প্রতিককালেও তেমনটি ঘটছে, নবকলেবরে উদ্ভূত ফ্যাসিবাদ সারা পৃথিবীকেই তীব্র সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক এই  ফ্যাসিবাদের স্বরূপ প্রকৃতির কথা দিয়েই লেখাটি শুরু করেছিলাম। কিন্তু চলে গেলাম অতীতের ইতিহাস পরিক্রমায়। এমনটি না করে উপায় ছিল না। কারণ অতীতের পটভূমিকে আশ্রয় করেই তো গড়ে ওঠে বর্তমান। কাজেই বর্তমানের সংকটকে বুঝতে ও তার মোকাবিলা করতেও অতীতের দিকে চোখ ফেরাতে হয়, এবং সেই অতীতের  সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যকে চিহ্নিত করে নিতে হয়।

বিগতকালের ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা ও লালনকর্তা ছিল সাম্রাজ্যবাদ, বর্তমানকালের সাম্রাজ্যবাদেরও সেই একই ভূমিকা। ফ্যাসিবাদের প্রসঙ্গ সূত্রে এটিই সেকালের সঙ্গে একালের প্রধান সাদৃশ্য। আর যে বৈসাদৃশটি অতি সহজেই চোখে পড়ে সেটি হলো : তখন বিশ্বের গণমানুষের জন্য আশার আলোকস্বরূপ ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, মূলত সোভিয়েতের হাতেই ঘটে ফ্যাসিবাদের পরাজয়, সাম্রাজ্যবাদও সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শক্তির  উপস্থিতিতে সংযত থাকতে বাধ্য হয়। আর এখন সোভিয়েত  ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শক্তির বিপর্যয়ের ফলস্বরূপ এককেন্দ্রিক বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই একান্ত বলদর্পী অবস্থান। সেই অবস্থান থেকেই এখনকার সাম্রাজ্যবাদীরা নতুনভাবে যে ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে, সেটির অবলম্বনরূপে তারা উগ্র জাতীয়তার বদলে উগ্র ধর্মতন্ত্রী সাম্প্রদায়িকতাকে বেছে নিয়েছে। কেন, কীভাবে এমনটি করেছে এবং তাদের সৃষ্ট নয়া-ফ্যাসিবাদই কেমন করে তাদের জন্যও সমূহ বিপদ ডেকে এনেছে, এসব বিষয়ের বিস্তৃত বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা প্রয়োজন। পরবর্তী কোনো লেখায় আমার সীমিত সাধ্যানুযায়ী সেই প্রয়োজন সাধনের চেষ্টাই করব। তবে আজকে শুধু বলে রাখি যে, পুরনো বা নয়া ফ্যাসিবাদকে আপাতদৃষ্টিতে যত শক্তিমানই মনে হোক, তার পতন না ঘটেই পারে না। কবি বিষ্ণুদের ভাষায়— ‘ফ্যাসিস্ট বর্বর, অতিষ্ঠ জর্জর, আপন মরণ-বাণে হয়ে যায় খান খান।’

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর