রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অতীতের ঘোর কাটিয়ে বর্তমান দেখুন

তুষার কণা খোন্দকার

অতীতের ঘোর কাটিয়ে বর্তমান দেখুন

ডেইলি স্টার পত্রিকার পেছনের পৃষ্ঠায় একটা খবর ছাপা হয়েছে ক’দিন আগে। ঢাকায় বনানীর যুবলীগ নেতা ইউসুফ সরদার সোহেল তার এক বন্ধুকে নিয়ে গুলশান থেকে রিকশায় রাত ২টায় বনানী গেছে। সোহেল সরদার বনানী পৌঁছানোর পরে রিকশা থেকে নেমে সোজা গন্তব্যের দিকে হাঁটা দিলে রিকশাওয়ালা পেছন থেকে তাদের ডেকে তার পাওনা ভাড়া ৪০ টাকা পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করেছে। রিকশাওয়ালার ভাড়া চাওয়ার ঔদ্ধত্য দেখে সোহেল সরদার মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। সরকারি দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের নেতা সোহেল সরদার। রিকশাওয়ালার উচিত ছিল তার যাত্রীর পদ-পদবি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে ভাড়া চাওয়া না চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া। রিকশাওয়ালা কবির তার যথা কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই রিকশাওয়ালার পাওনা ভাড়া দাবি করাকে যুবলীগ নেতা সক্ষত বেয়াদপি বলে গণ্য করেছেন। একজন বেয়াদপ রিকশাওয়ালাকে শায়েস্তা করার জন্য যুবলীগ নেতা সোহেল সরদার পকেট থেকে ভাড়ার টাকা বের না করে সোজা একখানা লোডেড পিস্তল বের করে রিকশাওয়ালার ঊরুতে গুলি করে দিয়েছে।

চড়-চাপ্পড় কিংবা কোপাকুপির মধ্যে বিষয়টা শেষ হলে পুলিশও চড়-চাপ্পড় মেরে মামলা শেষ করতে পারত। কিন্তু বিষয়টা গোলাগুলির পর্যায়ে চলে যাওয়ায় পুলিশ চক্ষুলজ্জার খাতিরে মামলা নিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। ঘটনাটি বনানী থানায় ঘটেছে। কাজেই এ বিষয়ে দায়-দায়িত্ব বনানী থানার ওপর বর্তায়। বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, ‘সোহেল যখন রিকশাওয়ালার ঊরুতে গুলি করেছে তখন সে মাতাল ছিল।’ একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা তদন্ত করার আগেই যুবলীগ নেতার বাঁচার পথ কি সুন্দর উন্মুক্ত করে দিলেন! যুবলীগ নেতা সোহেল মাতাল ছিল একথা প্রমাণ হওয়ার পরে সোহেল ‘মাতাল অবস্থায় জননিরাপত্তা বিঘ্নিত’ করার দায়ে দোষী হবে যার শাস্তি মোটের উপর দুই-এক মাসের জেল কিংবা সামান্য জরিমানা। সোহেল অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে একজন রিকশাওয়ালাকে গুলি করেছে তেমন জটিলতায় না গিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা তার ঢাকা শহরের লাভজনক পোস্টিংকে সরকারি দলের জন্যও বেশ লাভজনক করে রাখলেন বলেই বোধ হচ্ছে।

সরকারি দলের লোকের ক্ষমতার সদ্ব্যবহারের নমুনা দেখে পাঠকের কি ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়া বাঘ ও বকের গল্প মনে পড়ছে? সেই যে একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল। তারপর বক বাঘের গলাকে হাড়মুক্ত করে তার পাওনা পুরস্কার দাবি করলে বাঘ বলেছিল, বাঘের গলায় মাথা ঢুকিয়ে তুমি হাড় বের করে এনেছ। বাঘ তোমাকে কচমচ করে চিবিয়ে খায়নি। বকের জন্য বাঘের কাছ থেকে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে! জনাব সোহেল সরকারি দলের নেতা হয়েও ভাড়া চাওয়ার অপরাধে রিকশাওয়ালার বুকে গুলি না করে তার ঊরুতে গুলি করেছে এটিই কি বড় মহত্ত্বের পরিচয় নয়! পুলিশের ভাষ্যমতে, মাতাল সোহেল কী করতে কী করেছে এ নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে কাজ কী। আমরাও এটি নিয়ে অধিক মাথা ঘামাতাম না যদি এটি একটি মাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতো। কিন্তু এমন ঘটনা হামেশা ঘটতে থাকায় ঘটনাগুলোকে লোকে অশনি সংকেত হিসেবে নিচ্ছে। খোদ ঢাকা শহরের বনানীতে এমন ঘটনা ঘটতে দেখে সাধারণ মানুষের বুকে কাঁপুনি উঠলে সেটা ফেরানোর আশ্বাস কে দেবে! চারদিকে অশনি সংকেতের ঝিলিকে আমাদের চোখ নষ্ট হওয়ার আর বাকি আছে কি। নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত টাঙ্গাইলের একজন আইন প্রণেতা যখন পুলিশের প্রতিবেদনে পলাতক তখন তিনি সশরীরে ‘মহান সংসদে’ হাজির হয়ে হাজিরা খাতায় সই করে তার বেতন ভাতা তুলে নেওয়ার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেললেন। গত বছর আরেক সংসদ সদস্য এক কিশোরের দুই পায়ে গুলি করে গোলাগুলিতে তার হাতের টিপ পরীক্ষা করেছেন। সেই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা শুরু হলে মাননীয় সংসদ সদস্যের উকিল বললেন, রাত না পোহাতে অত সকালে এই ত্যাদর ছেলেটি তার বাড়ি থেকে এত দূরে গেল কেন সেটি একটি জটিল প্রশ্ন। অভিযুক্ত সংসদ সদস্যের বিজ্ঞ উকিলের শৈশব কেমন ছিল আমি জানি না, তবে সুস্থ স্বাভাবিক দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি যাদের আছে তারা জানেন, একজন বালক একটি প্রজাপতির ডানায় রঙের বাহার দেখে মুগ্ধ হয়ে তার পেছনে ছুটে মাঠ পার হয়ে বাড়ি থেকে বেশ দূরে যেতে পারে। স্রেফ শিউলি কিংবা বকুল কুড়ানোর জন্য অনেক পথ পাড়ি দেওয়া একটি শিশুর জন্য বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু সংসদ সদস্য কেন তার প্রায় মুফতে পাওয়া ট্যাক্স ফ্রি গাড়িখানি চড়ে অমন ভোরে মানুষ শিকার করতে পথে বের হলেন? এসব প্রশ্নের জবাব এখনই পাওয়া যাবে না। বিরোধী দল বিএনপি আত্মহত্যা করার পরে দেশে গলা তুলে কথা বলার মতো কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। ফলে জবাবদিহিতা শব্দের অস্তিত্ব দেশ থেকে ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে গেছে। দেশে একদলীয় শাসনের কুলক্ষণ বিশেষ মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে হয় না। রোজ সকালে যে কোনো পত্রিকার প্রথম পাতায় চোখ বুলালে দেখা যায় দেশে এমন শাসন ভালোমতোই ডালপালা মেলেছে। একদলীয় শাসনের বিষবৃক্ষে ফল ইতিমধ্যে যথেষ্ট পেকে উঠেছে তার প্রমাণ ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে অভিযুক্ত সংসদ সদস্য বদি দুই আঙ্গুলে বিজয়চিহ্ন ভি দেখিয়ে আদালতপাড়া থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। পত্রিকার পাতায় আমরা খবর পড়ি, দেশের কোন কোন অঞ্চলে কোন কোন লীগ নেতার একক আধিপত্যে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে। আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো আমরা নির্বাক চোখে চেয়ে দেখছি অথবা মাথা নিচু করে না দেখার ভান করছি।

কেন চুপ করে থাকতে হচ্ছে সেটি বুঝতে হলে থাইল্যান্ডে প্রচলিত একটি গল্পের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনারা জানেন, থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের হাল অবস্থা চিরকালই টালমাটাল। ওদেশে ১৯৭৩ সালে একবার যাওবা নড়বড়ে গণতন্ত্র কায়েম হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মিলিটারি শাসন এসে সেটি ধুম করে ফুরিয়ে গেল। সে সময় এক থাই ভদ্রলোক কোথাও যাওয়ার নিয়তে বাসে উঠেছে। বাসের ভিতর ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যে সেই লোকের এক সহযাত্রী তার পা মাড়িয়ে দিয়েছে। তখন লোকটি তার সহযাত্রীর মুখের দিকে করুণ চোখে চেয়ে বলল, ভাই আপনার কোনো আত্মীয় কি সেনাবাহিনীর জেনারেল? সহযাত্রী বলল, না ভাই। আমার কোনো আত্মীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল পদে নেই। লোকটি আবার তার সহযাত্রীকে প্রশ্ন করল, আপনার কোনো আত্মীয় ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল কিংবা নিদেনপক্ষে সার্জেন্ট পদে কি চাকরি করেন? সহযাত্রী মনে মনে ত্যক্ত হয়ে বলল, নারে ভাই, সার্জেন্ট তো দূরের কথা আমার কোনো আত্মীয় মিলিটারির সেপাই পদেও চাকরি করে না। তখন বাসযাত্রী বীরের বেশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সহযাত্রীর কলার চেপে ধরে বলল, তবেরে হারামজাদা, তুই আমার পা মাড়িয়ে দিলি কোন সাহসে?

আমাদের এখন কারও পায়ে জুতার ডগা দিয়ে টোকা দেওয়ার আগে জেনে নিতে হবে লোকটি সরকারদলীয় সংসদ সদস্য কিংবা কোনো অঙ্গ লীগের সদস্য কি না। বদ মতলবে কেউ সজোরে পা মাড়িয়ে দিলে তার প্রতিবাদ করার আগে বিনয়ের সঙ্গে লোকটির রাজনৈতিক পরিচয় জেনে নিতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয় না জেনে প্রতিবাদ করলে আপনার দিকে ছুটে আসা গুলি ঊরুতে না লেগে বুকেও লাগতে পারে। ঢাকা শহর শুধু নয়, দেশজুড়ে লীগ পরিচয় পুঁজি করে যে তাণ্ডব চলছে সে খবর পত্রিকার পাতা খুললে সবাই দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। পত্রিকার পাতায় নিত্যদিনে এসব খবর পড়ার পরে সমসাময়িক সময়ে একটি রাজনৈতিক বিতর্কের প্রসঙ্গ না টেনে পারছি না। কয়েক মাস আগে ‘আদি আওয়ামী লীগাররা’ রাজনীতির আঙিনায় জাসদকে বেশ চেপে ধরেছিল। তারা একাট্টা হয়ে বলছিল, জাসদ এখন বঙ্গবন্ধু ভক্ত সেজে ক্ষমতার মধু খাচ্ছে অথচ জাসদ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। সে সময় জাসদের মারমুখী হঠকারী রাজনীতির কারণে দেশে অরাজকতা পয়দা হওয়ায় দুর্বৃত্তরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার অনুকূল পরিবেশ পেয়ে গিয়েছিল। বর্তমানের ঘটনাগুলো দেখার পরে আদি আওয়ামী লীগারদের জাসদ তত্ত্ব কি মেনে নেওয়া সম্ভব? বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী খোঁজার জন্য আওয়ামী লীগ যেমন হুঙ্কার দিয়ে ঘর ছেড়ে আঙিনায় লাফিয়ে পড়ছে তাতে তাদের নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি গল্প না শুনিয়ে পারছি না।

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা এক দিন তার বাড়ির আঙিনায় আতিপাতি করে কিছু একটা খুঁজছিল। হোজ্জাকে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে একজন বলল, ভাই তুমি কি খুঁজছ? জবাবে হোজ্জা বলল আমি আমার হারিয়ে যাওয়া আংটি খুঁজছি। হোজ্জাকে সাহায্য করার ইচ্ছা নিয়ে লোকটি বলল, আচ্ছা বলতো, তোমার আংটি ঠিক কোথায় হারিয়েছে? জবাবে হোজ্জা তার ঘরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, আংটি হারিয়েছে ঘরের ভিতর। লোকটি অবাক বিস্ময়ে বলল, তাহলে সে আংটি তুমি উঠানে খুঁজছ কেন? হোজ্জা বলল, ঘরের ভিতর তো অন্ধকার। সেখানে আংটি খুঁজে পাব কীভাবে। উঠানে আলো আছে তাই এখানেই আংটি খুঁজছি। আদি আওয়ামী লীগাররা ১৫ আগস্ট নৃশংসতার পটভূমি তৈরি করার দায়ে ঘর থেকে দূরে মশাল জ্বালিয়ে জাসদ খুঁজে মরছে। আমি বলি কি, কষ্ট করে মশাল জ্বালিয়ে ঘর থেকে দূরে পটভূমি তৈরিকারীদের খোঁজাখুঁজি না করে আওয়ামী লীগ নিজেদের ঘরে একটা কুপি বাতি জ্বালিয়ে নিলেই ১৫ আগস্টের পট-প্রস্তুতকারীদের দেখা পেয়ে যেত। কাজটি সঠিকভাবে করতে পারলে আওয়ামী লীগ একই ভুলের পুনরাবৃত্তি থেকে বেঁচে যেত। দেশের ভিতর লীগ পরিচয়ে যেমন ভয়ানক উচ্ছৃঙ্খলতা শুরু হয়েছে সেটি বাহিনী নামিয়ে দিয়ে সামলানো যাবে না। আমাদের দেশে সরকারি পুলিশ র‌্যাব ইত্যাদি বাহিনী দিয়ে সরকারি দলের অপকর্ম সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। কেউ যদি পোপের চেয়ে বেশি ক্যাথলিক হয় তখন সে আর খ্রিস্টান থাকে না। আমাদের বাহিনীগুলো এখন সরকারের চেয়ে বেশি আওয়ামী। অপরাধীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার কাজে সরকারের আগে সরকারি বাহিনীকে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। অথচ পরিস্থিতি বদলে গেলে এরা সবার আগে ভোল পাল্টে কঠিন আওয়ামীবিরোধী হতে সময় নেবে না। এমন কথা আমি মনগড়া বানিয়ে বলছি না।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বিকালের কথা স্মরণ করে দেখুন তাহলে অনেক পুরনো মুখ আপনাদের মনের আয়নায় ভেসে উঠবে। কাজেই কোনো সরকারি বাহিনীর ওপর নির্ভর না করে দল আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হলে আওয়ামী লীগের নেতাদেরই কঠোর হতে হবে। কাজটি কঠিন তবে অসম্ভব নয়। 

     লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর