শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপান

মুফতি আমজাদ হোসাইন

ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপান

সব প্রশংসা আল্লাহর, তিনিই আমাদের সবাইকে নবী-রসুলদের মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। দীন-ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত সরল পথ। এই দীন-ইসলাম পবিত্র একটি সনদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই পবিত্র সনদটি হলো কোরআন-হাদিস। এই কোরআন-হাদিসকে সূক্ষ্মভাবে গবেষণা করে যারা আমাদের সামনে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুবাহ, হালাল-হারাম ও মকরুহ ইত্যাদি শরিয়তের বিষয়াবলিকে বিস্তারিত দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন তারাই হলেন দীনের ফকিহ, ইমাম, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির। এই বিচক্ষণ ইমাম, মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ মানব জাতির জন্য কোনটা কল্যাণকর কোনটা অকল্যাণকর কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে বিস্তারিত আলোকপাত করে গেছেন। শরিয়তের কোনো দিক তারা বর্ণনা করা থেকে বাদ দেননি। তাই তো বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন শরিয়তের এমন দিক নেই যার সমাধান আল কোরআনে নেই। অর্থাৎ সব কিছুর সমাধান পবিত্র কোরআনে পাওয়া যায়। তবে শর্ত হলো পবিত্র কোরআনকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর কাছে কোরআন বোঝার জন্য সাহায্য চাইতে হবে। আর কোরআনের ব্যাখ্যা হলো অসংখ্য-অগণিত হাদিসের ভাণ্ডার। যেমন ধূমপান সর্বনাশা এক নেশা। যা মানুষের শারীরিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক দিকসহ বিভিন্ন বিষয়ের অবর্ণনীয় ক্ষতিসাধন করে। মানুষের জন্য ক্ষতিকর সর্বপ্রকারের নেশাদার বস্তু পানাহার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে হারাম। এই প্রসঙ্গে বর্তমান যুগের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা শায়েখ ইবনে বাজ (র.) ফতোয়া দিয়েছেন, ধূমপান তো অপবিত্র, নিকৃষ্ট এবং অসংখ্য ক্ষতির কারণ। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর বান্দাদের ওপর পবিত্র জিনিস হালাল করেছেন আর অপবিত্র জিনিস হারাম করেছেন। পবিত্র কোরআনে সূরাতুল মায়েদার ৪নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে যে, কি বস্তু তাদের জন্য হালাল? বলে দিন, তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে।’ আল্লাহতায়ালা সূরা আল-আরাফের ১৫৭নং আয়াতে রসুল (সা.)-এর গুণাগুণ বয়ান করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি তাদের নির্দেশ দেন সৎকর্মের, বারণ করেন অসৎকর্ম থেকে, তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল ঘোষণা করেছেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ।’ কোনো নেশাদার বস্তু কখনো মানবদেহের জন্য উপকারী হতে পারে না। বরং তা মারাত্মক ধরনের ক্ষতিকর। নেশাদার বস্তুর মধ্য হতে একটি হলো ধূমপান। এই ধূমপান কি কি ক্ষতি করে? এক. স্বাস্থ্যগত ক্ষতি। ধূমপানের প্রতিটি টানে কতগুলো মারাত্মক ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ

মানবদেহে প্রবেশ করে। যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গিয়ে আঘাত করে। এগুলোর প্রভাবে দেহের প্রতিটি অন্ত্রের কার্যক্ষমতা ক্রমশ বিপন্ন হতে থাকে। ফলে এক সময় শরীরে জন্ম নেয় হাজারো রোগ-ব্যাধি। তাই তো দেখা যায় অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা বেশি অসুস্থ থাকে। ধূমপান মানুষকে বেকার করে দেয়। ধূমপান ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধির জন্ম দেয়। হূদক্রিয়া বন্ধসহ হাজারো মারাত্মক ধরনের ক্ষতি করে, যার ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেকে মনে করে ধূমপান করলে দেমাগ সতেজ হয়। এটি একটি ভুল ধারণা। ধূমপানের দ্বারা ধীরে ধীরে দেমাগ অকেজো হয়ে যায়। এক সময় দেমাগে আর কোনো কাজ করে না। ফলে মানুষ স্ট্রোক করে থাকে। দুই. পরিবেশগত ক্ষতি। ধূমপান পরিবেশের ক্ষতি করে। পরিবেশ নোংরা হয়। গর্ভের সন্তান নষ্ট ও বিকলাঙ্গ পর্যন্ত হয়ে যায়। ধূমপায়ী যেখানে সেখানে ময়লা ও কফ-কাশি ফেলে। তার মুখের জীবাণু অন্য জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ধূমপায়ীর মুখে বিশ্রী দুর্গন্ধ হয়। যা কিনা সভা-সমিতি, মসজিদ-মাদ্রাসা, অফিস-আদালাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্রই ঘৃণা ও বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। অনেক সময় শিশু ও নারীরা ধূমপায়ীকে এড়িয়ে চলে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি নেমে আসে। ধূমপায়ীর জবানে অশালীন ও অশ্লীল কতাবার্তা বেশি আসে। সে বদমেজাজি হয়। বড়দের প্রতি সম্মান এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ তার দিলে থাকে না। বড়দের সামনে বিড়ি-সিগারেট টানতে থাকে। সে মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করে। তার মধ্যে সব সময় বেপরোয়া মনোভাব কাজ করে। তিন. অর্থনৈতিক ক্ষতি। আল্লাহপাক সম্পদশালীদের কাছে সম্পদকে অস্থায়ীভাবে কয়েক দিনের জন্য আমানত রেখেছেন। আল্লাহর দেওয়া এই আমানতকে বিড়ি-সিগারেটের মাধ্যমে আগুনে পুড়ে শেষ করা হয়। প্রতি বছর দেখা যায়, কোটি কোটি টাকা ধূমপানের জন্য মানুষ ব্যয় করে থাকে। প্রিয় পাঠক, এতটুকু পড়ে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, ধূমপান কত ক্ষতিকর। আমার জানা মতে, অনেক পরিবারকে দেখেছি, সুন্দরভাবে পরিবারটি চলতে থাকে। যেখানে অশান্তি বলতে কিছুই থাকে না। কিন্তু গৃহকর্তার ধূমপানের বদঅভ্যাস রয়েছে। ফলে এই ব্যক্তিটি অল্প দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে ইহজগৎ ত্যাগ করেছে। তার পরিবারে আহাজারির থাবা আঘাত করছে। মা সন্তানহারা হচ্ছেন, স্ত্রী স্বামীহারা হচ্ছেন। সন্তান পিতা হারা হচ্ছে। ধূমপান একটি বড় ধরনের মহামারীর মতো। যে মহামারীতে হাজার হাজার মানুষের ক্ষতি হয়। অনুরূপ ধূমপানের কারণেও হাজার হাজার মানুষের ক্ষতি হয়। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাক ও নেশাদার বস্তুর ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। নেশার দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। আর এই দাসত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগানো। একজন ধূমপায়ী যখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে ইচ্ছা করবে যে, এখন থেকে সে আর ধূমপান করবে না। খালেছ দিলে তওবা করবে। আল্লাহতায়ালা তওবাকারীদের তওবা কবুল করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর, নিশ্চয়ই তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা আন-নূর : ৩১) সূরা তা-হা এর ৮২নং আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আর যে তওবা করে, ইমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সত্পথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি ক্ষমাশীল’। প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা সবাই মিলে একটি ধূমপানমুক্ত পরিবেশ ও সমাজ গড়ি। বেশি বেশি কালামে পাকের তেলাওয়াত করি। বেশি বেশি নেক আমল করি। খারাপ পরিবেশ ও খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করি। আল্লাহওয়ালা ও আলেম-উলামাদের কাছে যাতায়াত করি। ইনশাআল্লাহ আমাদের থেকে মহান রব্বুল আলামিন সব খারাপ অভ্যাস দূর করে দেবেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে তামাক ও ধূমপানমুক্ত সমাজ গড়ার তৌফিক দান করুন।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর