সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিএনপির প্রস্তাব ও আওয়ামী লীগের গাত্রদাহ

খন্দকার মাহবুব হোসেন

বিএনপির প্রস্তাব ও আওয়ামী লীগের গাত্রদাহ

বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। জনগণের এই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যদিয়ে। জনগণের ভোটে সরকার গঠন এবং ওই সরকারের অধীন রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে। তাই যাতে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে জনগণের অভিব্যক্তি অনুযায়ী একটি সরকার গঠন হয়, তার জন্য প্রয়োজন একটি দলনিরপেক্ষ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন।

বিভিন্ন দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে এবং দেশের সংবিধানের ওই পদ্ধতি লিপিবদ্ধ থাকে। আমাদের সংবিধানে নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে ১১৮ অনুচ্ছেদে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার প্রক্রিয়া বলা রয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয় প্রণীত আইনের বিধানাবলির সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দান করিবেন। কিন্তু সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে রাষ্ট্রপতি তার ইচ্ছামাফিক প্রণীত বিধান দ্বারা নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। ২০১২ সাল থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সার্চ কমিটির বিধান চালু হয়। উক্ত সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। যদিও সার্চ কমিটির সুপারিশ জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনগণের মতামত উপেক্ষা করে একটি ভোটারবিহীন সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। যা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’এর পরিপন্থী।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে চরমভাবে ব্যর্থতার কারণে নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়ার ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ দেখা দিয়েছে। দলমত নির্বিশেষে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়, সে ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায়  নেই যে, বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ দল, তাই যাতে দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ নিয়ে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন হয় এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দ্বারা জনগণ ভোট দিয়ে একটি সংসদ গঠন করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে প্রস্তাব দেওয়া হয়।

 

 

বিএনপির প্রস্তাব সাংবাদিক সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক উপস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মহলে গাত্রদাহ শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এই প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দেওয়া ফর্মুলা ‘অন্তঃসারশূন্য ও তামাশা’। এ কথাও বলেন যে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় সংসদে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব নেই, তাই তাদের সঙ্গে সংলাপ করার কোনো সুযোগও নেই। আরও বলেন বর্তমানে সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। তাই তার নির্বাচন কমিশন গঠন করার এখতিয়ার।

আওয়ামী লীগ হয়তো ভুলে গেছে অতীতে সুষ্ঠু ও দলনিরপেক্ষ নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে যৌথভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচন বর্জন করে এবং সংসদে ওই সময়ে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকা সত্ত্বেও বিএনপি এককভাবে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সময় ক্ষমতাসীন দলের বাইরে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা বিএনপি নেমে নিয়েছিল। যদিও তখনো সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পিত ছিল। বিএনপি তখন বলেনি যেহেতু নির্বাচন বর্জন করায় সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব ছিল না, তাই তাদের নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে তাদের কথা বলার অধিকার নেই। বিএনপি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট একটি রাজনৈতিক দল। তাদের মতামত উপেক্ষা করে বা মূল্যায়ন না করে ক্ষমতার দাপটে যদি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় সেটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইতিবাচক হবে না।

বিএনপি জনসমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অত্যন্ত সংগতভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে তাদের প্রস্তাব দিয়েছে। তা আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে এ কথা বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবে সরকারকে অবশ্যই এই প্রস্তাবের আলোকে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারা ব্যক্ত করে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার দাবি রাখে। সরাসরি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অর্থ দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির উসকানি দেওয়া।

ইতিমধ্যে কিছু কিছু বিশিষ্টজন তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার আলোকে এই প্রস্তাব সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিএনপির প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর নিয়োগের সমালোচনা করেছেন। তিনি এও বলেছেন এই প্রস্তাবের অনেক ভালো বিষয় আছে যা গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জরুরি। নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনী নিয়োগ এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতা প্রদানের যে প্রস্তাব বিএনপি দিয়েছে তাতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিষয়টি হয়তো তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে যে (Representation of Peoples Order) RPO তে ২০০৯ সালের বর্তমান সরকার কর্তৃক সংশোধনীর পূর্বে R.P.O-র Article2 (XLaa)তে Law enforcing agencies হিসেবে defence services of Bangladesh ছিল। যেটা বর্তমানে সরকার সংশোধন করে Law enforcing agency হিসেবে শুধু পুলিশ, র‌্যাব ও বিডিআরকে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও প্রতিরক্ষা বাহিনী নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে নিয়োজিত ছিল।

কিন্তু দেখা গেছে নির্বাচনকালীন সময় প্রতিরক্ষা বাহিনী যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য রাস্তায় টহল দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে পুলিং বুথের ভিতরে অবাধে জাল ভোট প্রদানের মহড়া চলছে। যার কারণে নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হয়। যেহেতু বর্তমানে প্রতিরক্ষা বাহিনী সংশোধিত RPO অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ভূমিকায় থাকে না। শুধু নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকে, তাই তারা যাতে নির্বাচনকালীন সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রাখতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তাদের Magisterial ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যাতে তাত্ক্ষণিকভাবে নির্বাচন আইন ভঙ্গ করে কোনো ব্যক্তি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত করলে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কেননা পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবির বাহিনী বিগত নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখেননি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহতকারীদের পক্ষে সহায়তার ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে। নির্বাচনকালীন সময় Magisterial ক্ষমতা প্রদানের অর্থ এই নয়, তাদের অপরাধের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাদের শুধু নির্বাচনী আইন ভঙ্গকারীকে তাত্ক্ষণিকভাবে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বিএনপির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ স্বাধীনতার পর থেকে যে দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল উক্ত দলের বক্তব্য নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে গ্রহণ করতে হবে। এই প্রস্তাবের ফলে যেহেতু ইতিপূর্বে সংসদে জামায়াতের সংসদ সদস্য ছিল। তাই কৌশলে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে এই জামায়াতকে নিয়ে ১৯৮৮ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জামায়াত আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী ছিল। আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নেতারা সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করে রাজপথ উত্তপ্ত করেছিল। তাছাড়া বিএনপি যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তা সবই কার্যকর করতে হবে, প্রস্তাবের মধ্যে এমন কোনো শর্ত নেই। আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য সরকার পক্ষ এবং সব বিরোধী দল ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটি শক্তিশালী, দক্ষ এবং জনগণের আস্থার সম্মিলিত একটি নির্বাচন কমিশন গঠন যার ফলে আগামীতে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেওয়ার অধিকার পায় এবং নির্বাচনে তাদের মতামত প্রতিফলিত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়। একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন দ্বারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। জনগণের সমর্থনবিহীন সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক তাতে শেষ রক্ষা হয় না। আগের কথা বাদ দিয়েও বাংলাদেশ হওয়ার পর এরশাদ সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন উক্ত সরকারকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। বরং করুণভাবে বিদায় নিতে হয়েছে, তাই ইতিহাস থেকে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

     লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

সর্বশেষ খবর