শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আমি বিজয় দেখেছি

লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

আমি বিজয় দেখেছি

আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বৈষম্যের নগ্নরূপ দেখেছি। এক বর্ণবাদী রূপ। এক কর্তৃত্ববাদী-আধিপত্যবাদী উগ্ররূপ। তুমি বাঙালি তুমি ছোট, আমি পাঞ্জাবি আমি বড়। একই সেনাবাহিনীতে, একই ছাউনিতে এমনকি একই পল্টনে পাশাপাশি থেকেও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান বিশাল। একটা অবহেলা, অবজ্ঞা আর চাপা ঘৃণা আমরা বাঙালি অফিসাররা অহরহ অনুভব করেছি। বাঙালি হওয়া যেন এক বিরাট অপরাধ। তুমলোক বাঙালি হো। কুছ কামকা নেহি হো। ছোটা ছোটা আদমি হো। ছেরেফ মাছলি খাতে হো। গোটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা তখন অত্যন্ত নগণ্য। অফিসার পর্যায়ে হাতে গোনা কয়েকজন। অপমান আর অবজ্ঞার শিকার হতে বাঙালিরাও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করত। বাংলায় কথা বলা যেত না। উর্দু বলতে হতো। উর্দু পরীক্ষায় পাস না থাকলে চাকরি থাকত না। কমিশন নিশ্চিতকরণ হতো না (confirmation), স্থায়িত্ব পেত না। মেজর গনি ও কর্নেল ওসমানীর অক্লান্ত চেষ্টায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে এই রেজিমেন্ট ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। লাহোরের নিকটবর্তী খেমকারান সেক্টরে এই রেজিমেন্ট অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভারতের আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিয়েছিল। গোটা সেনাবাহিনীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এও কি সম্ভব! প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এককভাবে গোটা যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য সবচেয়ে বেশি সামরিক পুরস্কারে (gallantry award) অর্জন করে এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান এই রেজিমেন্টের তখন একজন তরুণ অফিসার, একজন কোম্পানি অধিনায়ক। বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই সম্মান, খ্যাতি, গৌরব ও স্বীকৃতি সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভীষণভাবে ঈর্ষান্বিত করে তুলেছিল। তারা আরও মরিয়া হয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু বাঙালিরাও তখন আত্মোপলব্ধিতে পূর্ণ জাগ্রত। তারা হীনমন্যতা ত্যাগ করে মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাদের উত্কৃষ্টতা জাহির করার লক্ষ্যে মেধা ও দক্ষতাকে শানিত করে। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়। সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রাম করে চলে। প্রশিক্ষণে, খেলাধুলা ও স্পোর্টসে, বিভিন্ন যুদ্ধের মহড়ায়, কোর্স ক্যাডার, শৃঙ্খলায় এবং সামরিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ও প্রতিযোগিতায় বাঙালি ইউনিটগুলো এবং অন্যান্য ইউনিটের বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালের মার্চের সেই মরা-বাঁচার কঠিন দিনগুলোয় সবচেয়ে দুঃসহ সময় যারা পার করেছেন, চরম মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ে ভুগেছেন, চরম মানসিক যন্ত্রণায় কাতর থেকেছেন তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থানরত বাঙালি ইউনিটগুলোর বাঙালি সেনা ও সেনা কর্মকর্তা। এ এক মহা অগ্নিপরীক্ষা। তারা প্রত্যক্ষ করছেন স্বাধীনতার চেতনায় উত্তাল গোটা দেশ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে সব মানুষ। টানটান উত্তেজনা। চরম পরিস্থিতি। শুধু মিছিল আর মিছিল চারদিকে। সরকারের হুকুম কেউ মানছে না। কারফিউ ব্রেক হচ্ছে যত্রতত্র, অহরহ। সেনা ছাউনির পাঞ্জাবি ইউনিটগুলো ইতিমধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর। গুলি চালিয়ে হত্যা করছে। বজ্র কঠিন শক্ত হাতে পূর্ব পাকিস্তান শাসন করতে, অবাধ্য বাঙালিদের উচিত শিক্ষা দিতে পাকিস্তান সামরিক সরকার অবলম্বন করেছে পোড়ামাটি নীতি (scorch earth policy), জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা কর (burn all, loot all, kill all)| বাঙালি সেনা অফিসার ও আন্ডার কমান্ড বাঙালি সৈনিকরা কী করবেন? কী করবে পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের অসীম সাহসিকতার খ্যাতিসমৃদ্ধ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি ইউনিটগুলো; যারা বেশ কয়েকটি ক্যান্টনমেন্টে তখন অবস্থান করেছিল। তারা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে তাদের ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের অপমান, বোনের নির্যাতন? তারা কি শুধু নিশ্চুপ হয়ে হাত-পা গুটিয়ে থাকবে নীরব দর্শক হয়ে, যখন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে তাদের প্রিয় মাতৃভূমির রাজপথ আর প্রান্তর? অত্যন্ত কড়া নজরদারি তাদের ওপরে। ভীষণ ঝুঁকিতে তাদের সবার জীবন। তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া আঁচ করে তাদের নিরস্ত্র করার জন্য ছাউনির পাঞ্জাবি ইউনিটগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা এক্ষুনি এই মুহূর্তে। কঠিন সিদ্ধান্ত, জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত। to be or not to be. হয় বীরের মতো বিদ্রোহ আর প্রতিরোধ যুদ্ধ, না হয় কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ।

চট্টগ্রাম সেনা ছাউনির অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়া সহযোদ্ধাদের বললেন, তোমাদের সিদ্ধান্ত তোমাদের কাছে। আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি। I revolt. উপস্থিত সবার একবাক্যে বলে উঠল, I bq we, We revolt. জিয়া তার পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ অতিক্রম করে রেডিও স্টেশনটি দখলে নেন। তিনি ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। প্রথমে নিজ নামে, পরে দ্বিতীয়বার সংশোধন করে একই ঘোষণা জাতির শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। তিনি সবাইকে অস্ত্র হাতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহ্বান জানান। ইথারে ভেসে আসা জিয়ার দৃপ্তকণ্ঠ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ প্রেইরিতে একটি স্ফুলিঙ্গের মতো দাবানল জ্বালিয়ে দেয়। অন্য সেনা ছাউনির বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকার নিকটবর্তী জয়দেবপুরে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ঝাঁপিয়ে পড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তেমনি যশোর সেনানিবাসের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনী। ঝাঁপিয়ে পড়ে যার যা আছে তাই নিয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা।

এর পরের ইতিহাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের কঠিন ইতিহাস। শত সহস্র গেরিলা অভিযান, রেইড, অ্যামবুশ, শত্রুঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ, সম্মুখযুদ্ধ, অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক, ইস্পাতকঠিন মনোবল আর মৃত্যুপণ লড়াইয়ের ইতিহাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রক্তের আখরে লেখা এক অনবদ্য গৌরবগাথা, এক বীর জাতির মহিমামণ্ডিত বীরত্ব কাহিনী, জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনের এক অমর আখ্যান। এ মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে ব্র্যাকেটবন্দী করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে, ব্র্যাকেটবন্দী করেছে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে গণচীনের এবং হো চি মিন পরিচালিত ভিয়েতনামের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। আমাদের গর্ব আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহে। এর উত্থান এর বিকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। এ সেনাবাহিনীই গোটা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ফোর্স সংগঠিত করেছে, অস্ত্র সংগ্রহ করেছে, রসদসম্ভার জুগিয়েছে, অভিযান পরিচালনা করেছে, শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। দেশকে স্বাধীন করেছে।

আজ বাংলাদেশ এক স্বাধীন সার্বভৌম গর্বিত দেশ। আজ চির উন্নত নজরুলের বাংলাদেশের শির। হিমালয়ের উচ্চতায় বিশ্বসভায় সে দৃশ্যমান। আজ বিশ্বজুড়ে গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত, অশান্ত রাষ্ট্রগুলোয় শান্তির দূত হয়ে সে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বৃহৎ থেকে বৃহত্তর অবদান রেখে চলেছে। সে নোবেল জয় করেছে। হিমালয়সহ বিশ্বের সব পর্বতশৃঙ্গ পদানত করেছে। বিশ্ব ক্রিকেটাঙ্গন দৃপ্তপদে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ২০০ বছরের পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে দিয়ে অতীতের উপনিবেশ প্রভু ব্রিটিশকে হারিয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। বিশ্বকাপ জয়ে সে আজ দৃঢ়প্রত্যয়ী। জয় বাংলাদেশের। জয় স্বাধীনতার।

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের সেই দুঃসহ কঠিন দিনগুলোর কথা মনে করে আমি সর্বদা যন্ত্রণাকাতর রই। বীভৎস নির্মম নিষ্ঠুর সেই মহাহত্যাযজ্ঞের দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে প্রতিভাত হয়। আমার স্বজন, সহযোদ্ধা, সহকর্মীদের বিয়োগব্যথা মনের গভীরে আঘাত করে। হেলেপড়া সূর্যের দীর্ঘ ছায়ায় আজ আমি নিজেকে অনেক দীর্ঘদেহী, অনেক বড় দেখি। সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে আজ আমার মনে হয় আমি এক দুঃসাহসী বীর। আমি গ্রানাইটকঠিন আত্মপ্রত্যয়ী। আমি চিরবিজয়ী। আমি অমর অব্যয়-আমি বাংলাদেশ।

পরাজিত পাকিস্তান আজ প্রায় পাঁচ দশকেও বাংলাদেশের বাস্তবতা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে। তারা এখনো বাস্তবতাবিবর্জিত। বোকার স্বর্গে তাদের বাস। একাত্তরের নারকীয় কর্মকাণ্ডকে এখনো তারা অস্বীকার করে চলেছে। সংসদে (পাঞ্জাব সংসদ) চিৎকার করে বলছে বাংলাদেশে তারা কোনো মানুষ হত্যা করেনি। তারা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেছে মাত্র। তারা বলছে বাংলাদেশে কোনো গণহত্যাই হয়নি। রক্তপাত যদি কিছু ঘটেই থাকে তা গৃহযুদ্ধরত বাঙালিরাই করেছে। তারা বলছে বাংলাদেশে তারা কোনো অন্যায়ই করেনি। এ যেন মধ্যাহ্ন বেলায় প্রকট সূর্যে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলা আমি আলো দেখি না। আমি চতুর্দিক অন্ধকার দেখি। এখন নিশ্চিতভাবে এটা রাত। তাদের জন্য আজ আমার অনেক করুণা হয়। তারা জীবনভর বোকার স্বর্গে বাস করে গেল। একাত্তরে করেছিল, আজও করছে। ভবিষ্যতের কথা জানি না। কামনা করি বিধাতা তাদের চোখ দেন। জ্ঞান দেন। বোঝার ক্ষমতা দেন। সত্যকে চেনার বাস্তবতাকে জানার ও মানার শক্তি দেন। আমার শঙ্কা হয় পাকিস্তানের ঔদ্ধত্য আর চোখ থাকতে অন্ধ মানসিকতা থেকে যদি তারা বেরিয়ে না আসতে পারে তাহলে আগামী দিনে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় জাতীয় বিপর্যয়।

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এই দিনে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বাংলাদেশ বিজয় দেখেছিল। হাজার বছরের সর্ববৃহৎ বিজয়। সর্বোচ্চ উল্লাসে উল্লসিত হয়েছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল। বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা বাঁধভাঙা জোয়ার গোটা বাংলাদেশকে প্লাবিত করেছিল। কোটি মানুষের অশ্রু আর রক্তপাত, যন্ত্রণা, যাতনা আর স্বজনহারা বেদনাকে ধুয়ে দিয়েছিল। প্রশান্তি এনেছিল। বাংলাদেশকে করে তুলেছিল পবিত্র, শুচি এক মহা পুণ্যভূমি। আমি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি পুরো নয় মাস দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বীর সেনানীদের কথা, তাদের বীরত্বগাথা। স্মরণ করছি বীর সমরনায়কদের, বীর সমর অধিনায়কদের। স্মরণ করছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। অর্পণ করছি আমার গর্বিত চৌকস স্যালুট। জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা।

            লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর