রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

তাদের ভয় মৃত মান্নান ভূঁইয়াকেও

কাজী সিরাজ

তাদের ভয় মৃত মান্নান ভূঁইয়াকেও

নরসিংদীর শিবপুর সব সময়ই আমাদের টানে। শিবপুরের সঙ্গে একাত্তরের অনেক স্মৃতি। পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী অতর্কিতে রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র, নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর সশস্ত্রভাবে হামলে পড়ার পর অবরুদ্ধ হয়ে যাই ঢাকা শহরে। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার চিওড়া কাজীবাড়িতে (গ্রামের বাড়ি) গিয়ে মা, চাচিআম্মা (আম্মা বলেই ডাকতাম ছোটবেলায় তার কাছে মানুষ হয়েছিলাম বলে) এবং বোনদের সঙ্গে দেখা করে ২৫ মার্চ ’৭১ ঢাকায় পৌঁছি। সেদিন পল্টন ময়দানে আমাদের গোপন সংগঠন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে জনসভা ছিল। যুদ্ধ শুরুর আগে পল্টনে কোনো দলের সেটাই ছিল শেষ জনসভা। তখন আমাদের প্রধান নেতা কাজী জাফর আহমদসহ রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, মোস্তফা জামাল হায়দার, হায়দার আনোয়ার খান জুনো প্রমুখ বক্তৃতা করেন। কাজী জাফর আহমদ ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র ঘোষণা দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানিয়ে বলেন, পশ্চিমারা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের মুক্তির পথ নেই, আর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধেরও কোনো বিকল্প নেই। আলোচনার নামে পাকিস্তানিরা সময়ক্ষেপণ করছে এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেদিন সভার পক্ষ থেকে স্বাধীনতার জন্য গেরিলা যুদ্ধের কৌশলপত্র ঘোষণা করেছিলেন শাহরিয়া আখতার বুলু (পরবর্তীকালে বিএনপি নেত্রী ও অষ্টম জাতীয় সংসদের সদস্য)। পাকিস্তানিরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সে রাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে হত্যা করে অগণিত মানুষ। এ ইতিহাস সবারই জানা। সেদিন আমাদের আরেক নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ঢাকায় ছিলেন না। হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন তার নিজের জন্মস্থান শিবপুরে। ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহারের প্রথম দিনে আমাদের দলের নেতৃস্থানীয় সবারই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় শিবপুরে। শিবপুর আগে থেকে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির একটি ঘাঁটি এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা সবাই আশ্রয় নিলাম মান্নান ভূঁইয়ার শিবপুরে। ইতিমধ্যেই তিনি তার এলাকায় একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলেছেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সেখানেই ‘থ্রি নট থ্রি’ চিনলাম, তা চালাতে শিখলাম। তারপর সেখান থেকে চলে গেলাম কুমিল্লার গ্রামে— আমি, জাফর ভাই (কাজী জাফর আহমদ)। সবাই একে একে চলে গেলেন যার যার নিজস্ব এলাকায়। হায়দার আনোয়ার খান জুনো শিবপুরে থেকেই যুদ্ধ করেছেন বীরের মতো। কাজেই এই শিবপুরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় এবং আবেগাশ্রিত।

আমরা পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছি ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু শিবপুরসহ সমগ্র নরসিংদী হানাদারমুক্ত হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। ভারতে না গিয়ে দেশের মাটিতে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের অপার কীর্তি স্থাপন করেছিলেন মান্নান ভূঁইয়া। নিজের রাজনৈতিক অনুসারীই শুধু নয়, সব মত ও পথের ছাত্র-যুবক-কৃষকদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অদম্য বাহিনী। বলা যায় সমগ্র নরসিংদীতেই তার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। ১২ ডিসেম্বর প্রতিবছর যখন ফিরে আসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যান স্মৃতিময় অতীতে, যে সব মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন মধুর স্মৃতি তাদের আবেগে আপ্লুত করে। নানাভাবে তারা উদযাপন করেন দিনটি। ক্ষোভ ও লজ্জার বিষয় হচ্ছে, এবার যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার পরও উদযাপন করা যায়নি শিবপুর-নরসিংদী হানাদারমুক্ত করার বিজয় উৎসব। স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে বানচাল করে দেয় অনুষ্ঠানটি। ১২ ডিসেম্বর সকালে যাত্রার প্রস্তুতিকালে খবর পেলাম অনুষ্ঠানটি হচ্ছে না। শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধা সাদেক জানান খবরটি। পরে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সংগঠন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পরিষদের সদস্য সচিব ও শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আরিফ মৃধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিবপুর থানার প্রাক্তন কমান্ডার বন্ধু ঝিনুক খান বিষয়টি কনফার্ম করেন। ঝিনুর সম্পর্কে একটু বলা দরকার। হানাদার বাহিনী তার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, ধ্বংস করে সব পারিবারিক সহায়-সম্পদ। কোনো মহল থেকে সামান্য সহযোগিতা পাননি হাতও পাতেননি কারও কাছে। নতুনভাবে আরেক যুদ্ধ করে টিকে আছেন। নিরন্তর চলছে সে যুদ্ধ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো। এবার অনেক ভালো করে দিবসটি উদযাপন করতে চেয়েছিলেন ঝিনুকরা— শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধারা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তার পরিচয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। লজ্জায় পড়ে গেলাম। শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে আমিই যোগাযোগ করেছিলাম তার সঙ্গে। তিনি আমাকে খুব ভালো জানেন। তাই রাজি হয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর রূপকথার মতো অনেক বীরত্ব কাহিনী আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশকে স্বাধীন করার সমুদয় কৃতিত্ব যারা হাতিয়ে নিতে চাইছেন একাই এবং নিযুক্ত চাটুকার দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ও দলবন্দনার কল্পকাহিনী লেখাচ্ছেন ওই সব লেখা মিথ-এ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো মৃত্যুর সঙ্গে লড়া বীরদের স্বীকৃতিই খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ এসব ‘ড. বিসর্গওয়ালা’ ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে হানাদার বাহিনীকে সার্ভ করেছেন, কেউ বয়স ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে না গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করে ঢাকায় সব কিছু স্বাভাবিক— ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের খবর মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য পাকিস্তানিদের ধূর্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বতো সহযোগিতা করেছেন। কেউ আবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে মুরগি সাপ্লাইয়ের বাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। এদের কেউ কেউ এখন ইতিহাসবেত্তা। কেউ মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। ইতিহাস স্বয়ম্ভু। প্রকৃত ইতিহাস যখন শতবর্ষ পরে পূর্ণতা নিয়ে জাতি ও বিশ্ববাসীর সামনে হাজির হবে সেখানে দেখা যাবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আর আবদুল মান্নান ভূঁইয়াদের মতো অনেক আলোকোজ্জ্বল মুখ। এখন ‘অটোলাইটে’ যাদের আলোকিত দেখানো হচ্ছে, তখন দেখা যাবে তাদের কেউ কেউ সেখানে নিষ্প্রভ।

 

 

শিবপুরে ১২ ডিসেম্বর যে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল স্রেফ রাজনৈতিক হিংসা এবং মান্নান ভূঁইয়া প্রতিবিদ্বেষ থেকে তা বানচাল করে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এ ব্যাপারে সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শচ্যুত, স্খলিত বিএনপি। যারা এ কাজটি করল তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

সেদিন শিবপুর নরসিংদী হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপনের কর্মসূচি নিয়েছিল আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পরিষদ। এটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, একজন সৎ ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার স্মৃতিও সমুজ্জ্বল রাখা, তার কর্ম ও কীর্তি আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে দেশপ্রেমিক ও যোগ্য নাগরিক হতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যেই গঠিত এই পরিষদ। সারা দেশেই একজন সৎ, সাহসী ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে মান্নান ভূঁইয়ার একটা খ্যাতি আছে সব দল মতের অনুসারীদের কাছে। বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের শূন্যতা ও আকাল নিয়ে যখন ভবিষ্যৎ চিন্তায় চিন্তাশীলরা আতঙ্কিত তখন একজন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া অথবা একজন আবদুর রাজ্জাক কিংবা কমরেড ফরহাদ এবং তাদের সময়কার, তাদের মতো আদর্শবাদী নিবেদিতপ্রাণ অনেক ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদের নাম উঠে আসে দৃষ্টান্ত হিসেবে। মতামত ব্যক্ত হয় এমন যে, রাজনীতিবিদ হবেন এদেরই মতো। সেই আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তার জন্মস্থান শিবপুর, আশপাশের সব থানা এবং নরসিংদীতেও বিপুলভাবে জনপ্রিয়। মৃত মান্নান ভূঁইয়াকে এখন মনে করা হয় জীবিত মান্নান ভূঁইয়ার চেয়েও অধিক জনপ্রিয়, অধিক শক্তিশালী। এলাকায় যারা রাজনীতি করেন, এমপি, মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তারা ভয় পান এই জনপ্রিয়তাকে, এই শক্তিকে। তাদের ভয় মান্নান ভূঁইয়ার এই জনপ্রিয়তার রথ যদি অন্য কাউকে এগিয়ে দেয়, মান্নান ভূঁইয়ার রাজনীতি, আদর্শ ও অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিষ্ঠা নিয়ে কেউ যদি তার ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে জনগণের সামনে আবির্ভূত হয়, তাহলে তাদের কপাল পুড়বে। তাই মান্নান ভূঁইয়ার নামে কিছু হতে গেলেই বিশেষ বিশেষ চক্র আঁতকে ওঠে। ওদের বুকে যেন কাঁপন লাগে, এই বুঝি রাজত্ব গেল আর বুঝি স্বপ্ন পূরণ হলো না। মৃত মান্নান ভূঁইয়ার শিবপুর এবং আশপাশ এলাকায় যে আকাশছোঁয়া ভাবমূর্তি, এলাকার উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তার যে ছোঁয়া এখনো তা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। মান্নান ভূঁইয়ার অনুপস্থিতি তাদের ভাবায়, মান্নান ভূঁইয়ার স্মৃতি তাদের এখনো কাঁদায়। শেষ সংসদ নির্বাচনে তার ব্যাপারে যে ভুল এলাকার মানুষ করেছে তার এককালের শিষ্যদেরই ষড়যন্ত্রে, সে ভুলের প্রায়শ্চিত করতে উন্মুখ তারা। প্রতিপক্ষ তাই সতর্ক ও বেপরোয়া।

আগেই উল্লেখ করেছি, ১২ ডিসেম্বর নরসিংদী হানাদারমুক্ত দিবস উদযাপন করতে চেয়েছিল আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পরিষদ। আর কারও তাগিদ ছিল না এ ব্যাপারে। কোনো কর্মসূচিও ছিল না কারও। কিন্তু তারপরও কর্মসূচিটি পালন করা গেল না। উদ্যোগটির পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে একটি অঞ্চলের হানাদারমুক্ত হওয়ার গৌরবদীপ্ত দিনটিও পালন করতে বাধা দিল রাজনৈতিক ধুরন্ধর স্বার্থবাজরা। আবারও উল্লেখ করি, আবদুর মান্নান ভূঁইয়া পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত সে অনুষ্ঠানটি বানচাল করে দেওয়ার জন্য এক আনহোলি আঁতাত হয়েছিল শাসকদল আওয়ামী লীগ ও বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপির মধ্যে। ইতিমধ্যে স্থানীয় জনগণ জেনে গেছেন যে, এক সময় যারা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার ছায়াতলে আশ্রিত থেকে ‘মানুষ’ হয়েছেন, মোটা-তাজা হয়েছেন, বিন্দু থেকে বৃত্ত গড়েছেন বলে লোকমুখে বহুল উচ্চারিত এবং এমনকি আবদুল মান্নান ভূঁইয়া পরিষদের সঙ্গেও এক সময় জড়িত থেকে নিজেদের মান্নান ভূঁইয়ার লোক বলে জাহির করতেন তারাই উদ্যোগী হয়ে শাসক দলের সঙ্গে আঁতাত করে অনুষ্ঠানস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করায়। কিছুদিন আগে এই ব্যক্তিরা মান্নান ভূঁইয়া পরিষদ ছেড়ে আবার স্থানীয় বিএনপিতে ফিরে যায় নানা লোভের বশবর্তী হয়ে। এদের একজন মান্নান ভূঁইয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরিফ মৃধার কাছে উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত হন জামানত খুইয়ে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীও হেরে যান তার কাছে। একজন নির্দল প্রার্থী দেশের প্রধান দুই দলের দুই প্রার্থীকে হারিয়ে দিতে পেরেছেন মান্নান ভূঁইয়ার ভাবমূর্তির আশীর্বাদে। দুই প্রার্থীর জ্বালা এখন দুই দলের জ্বালায় পরিণত হয়েছে। মান্নান ভূঁইয়ার কোনো দল নেই, তার অনুসারীদের কোনো রাজনৈতিক তত্পরতাও নেই। তবুও ওদের কত ভয়। মৃত মান্নান ভূঁইয়াকে নিয়ে কী আতঙ্ক তাদের। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দীর্ঘ প্রায় এক যুগ বিএনপি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। নানান দুর্যোগে দলকে রক্ষা করেছেন দক্ষ কাণ্ডারি হিসেবে। আমাদের জানা মতে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির গাঁটছড়া বাঁধা এবং দলে অরাজনৈতিক লুটেরা শক্তি ও দুর্নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু গঠনতন্ত্রের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারপারসনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে কার্যকর কিছু করতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ফেরদৌস কোরেশীর নেতৃত্বাধীন ‘কিংস পার্টি’র প্রভাবে বিএনপি যখন ভাঙনের মুখে পড়ে, সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে কুশলী রাজনীতিবিদ মান্নান ভূঁইয়া কোরেশীর দলে যোগদানেচ্ছুদের ফিরিয়ে আনেন এবং দলকে পরিশুদ্ধ করে দুর্বৃত্তায়ন-দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় শহীদ জিয়ার বিএনপিতে ফেরত আনার সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগেও আমু-রাজ্জাক-তোফায়েল-সুরঞ্জিত-অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মুকুল বোস ও অন্যরা একই উদ্যোগ নেন— যদিও দুই পক্ষের উদ্যোগই ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগের প্রবীণরা বিষয়টি অনুধাবন করে সবাইকে দলেই রেখেছেন সম্মানের সঙ্গে। কেউ কেউ এখন মন্ত্রী। কিন্তু মান্নান ভূঁইয়াকে কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিস ছাড়াই বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। তাতে মান্নান ভূঁইয়া ক্ষতিগ্রস্ত হননি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। এটা বোঝার বোধশক্তিও নেই বিএনপির নীতি-নির্ধারক পরিবারের। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া দলে নেই, বেঁচেও নেই। কিন্তু এদেশের রাজনীতির আলোচনায় সততা ও আদর্শবাদিতার দৃষ্টান্তে, মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে তিনি প্রাসঙ্গিক; তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে গঠিত একটি সংগঠনের উদ্যোগে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়কে কেন্দ্র করে একটি আবেগাশ্রিত অনুষ্ঠানকে লীগ-বিএনপির যারা যৌথভাবে চক্রান্ত করে বানচাল করে দিল, তাদের বিরুদ্ধে যদি কেন্দ্র থেকে কোনো দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, বুঝতে হবে, কেন্দ্রের সম্মতি নিয়েই তারা কু-কাজটি করেছে। অন্তত, বিএনপির ক্ষেত্রে তো এটা বলাই যায়। কারণ, প্রচার আছে, এখনো মান্নান ভূঁইয়ার ভাবমূর্তি আতঙ্কে কারও কারও শরীরে নাকি ফোসকা ফোটে। এ জন্য দলের ভিতরে-বাইরে তার অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী-অনুসারীদেরও ওরা সন্দেহ করে, ভয় পায়। কে জানে এমন সব ভয় না শেষ পর্যন্ত তাদের খায়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর