শিরোনাম
রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া

একাত্তরের রক্ত গাঙে নাও ভাসিয়ে যারা রক্তিম বিজয় অর্জন করেছিল তাদের অমর অবদান ভুলবার মতো নয়। এ দেশ এ মাটি জনম জনম তাদের স্তুতি গীত গাইবে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতীয় বীরদের। যারা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে এক স্বাধীন ভূখণ্ড, উপহার দিয়েছে স্বাধীনতার সূর্য, আজ তারা কোথায়- কোটি বাঙালির প্রাণের এ প্রশ্ন অক্ষরের ক্যানভাসে প্রেম দিয়ে এঁকেছেন ছন্দের জাদুকর হাফেজ আহমাদ উল্লাহ। ‘বন্দী পাখি মুক্ত করে/উড়িয়েছিল যাঁরা/জানতে আমার ইচ্ছে করে/কেমন আছে তারা?/বিজয় দিবস পালন করি/ষোলই ডিসেম্বর/বুকের রক্তে করল যারা/দিনটাকে অমর-/জানতে আমার ইচ্ছে করে/আজকে তারা কই?/এই দেশ এই মাটি ওদের/ভুলবে না নিশ্চয়ই।’

একাত্তরের জাতীয় বীরদের ভুলতে না পারার সবচেয়ে বড় কারণ হলো- তারা নবীওয়ালা কাজের মিশন পূরণ করে গেছেন। নবী-রসুলরা যুগে যুগে ‘বন্দী পাখিকে উড়ানোর’ মিশন নিয়েই এসেছেন। এসেছেন বিজয়ের মিশন নিয়ে। যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর একমাত্র মিশন কী? তাহলে উত্তর হবে— ‘দীনের বিজয় অর্জন করা’। কোরআনের ভাষায়— ‘মহান আল্লাহ তাঁর রসুলকে হেদায়াত এবং সত্যধর্ম ইসলামসহ পাঠিয়েছেন। যাতে রসুল এ ধর্মকে সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করতে পারেন। বিজয়ের এ সংগ্রাম-সাধনার সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা ফাতহ : ২৮।) দীন বিজয়ের এ মিশন শুধু আমাদের নবী (সা.) এর জন্যই নয় বরং সব নবীর মিশনই ছিল এটি। যুগে যুগে আল্লাহ মনোনীত বান্দাদের কণ্ঠে একই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে বারবার। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সাইয়েদেনা মুসা (আ.)-কে আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের অত্যাচার থেকে বনি ইসরায়েলকে মুক্ত করে স্বাধীন ভূখণ্ডে স্বাধীনভাবে আল্লাহর দাসত্ব করার মিশন দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। কোরআনের ভাষায়- ‘মুসা বলল, হে ফেরাউন! আমি বিশ্বজাহানের প্রভুর পক্ষ থেকে প্রেরিত। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, আল্লাহর নামে সত্য ছাড়া আর কিছু বলব না। আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছি। কাজেই তুমি বনি ইসরাইলকে মুক্ত করে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দাও।’ (সূরা আল আ’রাফ, ৭:১০৮-৫)।

ধর্মে স্বাধীনতা এবং বিজয় শব্দটি এত তাত্পর্যমণ্ডিত হওয়ার কারণ হলো, সমাজ সংশোধনের জন্য প্রথমে মানুষকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিতে হবে। তবেই মানুষ স্বাধীনভাবে আল্লাহর গোলামী করতে পারবে। কারণ, আল্লাহর মনোনীত ধর্ম দুনিয়ায় এমন সংশোধন চায় যা শুধু ওয়াজ-নসিহত নয় বরং রাজনৈতিক শক্তি এবং স্বাধীন ভূখণ্ডেরও প্রয়োজন হয়। মক্কার দুরাচার পাপীষ্ঠরা মদিনার স্বাধীন ভূখণ্ডে আঘাত হেনেছে বারবার। এর ফলে রসুল (সা.) দাঁত ভেঙেছে, আহত হয়েছেন, কিন্তু মদিনায় আঁচর লাগতে দেননি তিনি। মদিনার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাচ্চা দিল ইমানদার সাহাবিরা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। ঠিক ১৪শ বছর পর সোনার বাংলায় এক দল খাঁটি দেশপ্রেমিক বান্দা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য ধর্মের এবং মানবতার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন। এ লড়াইয়ে আল্লাহতায়ালা মজলুমদের বিজয় দিয়েছেন এবং জালেমদের পরাজিত করেছেন।

মানুষ স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়ে স্বাধীনভাবে আল্লাহর গোলামি করার অবারিত সুযোগ পেল। একজন মুমিন-মুসলমানের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কিই বা হতে পারে। আমি পরাধীন নই। আমি স্বাধীন। স্বাধীনভাবে আল্লাহর গোলামি করব। এ স্বাধীনতা এবং বিজয়ের জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা প্রতিটি মুমিনের ইমানি দায়িত্ব। শরিয়তের সীমার মধ্যে বিজয় দিবস উদযাপন করা দোষণীয় নয়, বরং পছন্দনীয় ও প্রশংসনীয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে তাফসির মাহফিল, কোরআন পাঠ, রচনা লিখন, র‌্যালি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি আয়োজন করা দেশপ্রেমিকদের কর্তব্য। কোরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরাটি বিজয় লাভের পর করণীয় ও বিজয় উদযাপনের ধরন সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং দেখবেন যে, মানুষ দলে দলে আল্লাহর ধর্মে প্রবেশ করছে, তখন আপনার রবের প্রশংসাসহ তাসবিহ করুন এবং তার কাছে মাফ চান। নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী। (সূরা নাসর, ১১০:১-৩।) বিজয় লাভের পর বেশি করে আল্লাহর শোকরিয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা কোরআনের বিধান। আল্লাহ আমাদের জালেমদের বিরুদ্ধে বিজয় দিয়েছেন- কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রতিটি মসজিদ-মাদ্রাসায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইতিহাস চর্চা করা, খুতবায় আলোচনা করার পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি পালন করা দেশের সব আলেমের কর্তব্য। আলেমদের দেশপ্রেমের কর্তব্য থেকে নির্লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষ বিজয় উদযাপনের ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে অভিহিত নয়।  হে আলেম সমাজ, আপনাদের কি দায়িত্ব নয় দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানোর শিক্ষা দেওয়া?

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর