সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

পরিশুদ্ধ জীবন নির্মাণ

মুফতি আমজাদ হোসাইন

পরিশুদ্ধ জীবন নির্মাণ

রসুল (সা.)-এর মদিনার জীবন ছিল শান্তিময়। নবীজী এখানে এসেই এক অতুলনীয় জীবনযাপন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করলেন। মদিনার আনসার ও মক্কার মোহাজেরগণ মিলে নবীজীর শান্তির মিছিলে শরিক হলেন। নবীজীর আদর্শে গঠন করলেন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবন।  মক্কায় মোহাজেরগণ ছেড়ে আসলেন পৈতৃক বসতভিটা। আনসাররা মোহাজের ভাইদের জন্য ছেড়ে দিলেন  নিজেদের সম্পদের অর্ধেক। পরিচ্ছন্ন ও ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছিলেন যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ফলে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতের শুভ সংবাদ লাভ করেছিলেন। তারা নবীজীর আদর্শে আদর্শবান হয়ে পরবর্তীতে আগত লোকদের জন্য প্রাত্যহিক কর্ম বা আচরণের মধ্যদিয়ে সব মানুষের অনুসরণযোগ্য একটি আদর্শ স্থাপন করলেন। তাই তো নবীজী সাহাবায়ে কেরামদের সম্পর্কে বলেছিলেন আমার সাহাবিরা আকাশের তারকারাজির মতো। যারাই তাদের অনুসরণ করবে তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে। হজরত রসুলে আরাবি (সা.) মক্কায় অবস্থানরত কোরাইশ ও সবার জন্য মঙ্গল করতে চেয়েছিলেন। তিনি সবাইকে আহ্বান করেছিলেন ‘সকলে বল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাহলে সফলতা পাবে’। মঙ্গলকামী নবীজী তাদের থেকে উত্তর পেলেন কষ্ট আর কষ্ট। একসময় নবীজীকে স্বীয় মাতৃভূমি পর্যন্ত ত্যাগ করতে হলো। কলেমার দাওয়াত দেওয়ার কারণে তিনি এক ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। তখনকার মক্কার লোকেরা তাঁকে কখনো অবিশ্বাস করেনি, শুধু অবিশ্বাস করেছিল তাঁর ওপর অবতীর্ণ ঐশী বাণীকে। কিন্তু মদিনার পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো ছিল। এখানের ইহুদিরা ঐশী বাণীকে অবিশ্বাস করেনি। কিন্তু নবীকে বিশ্বাস করতে তারা নারাজ। মদিনায় ইহুদি ছাড়াও মোনাফেকদের একটি বড় দল ছিল, যারা উপরে এক কিন্তু ভিতরে ছিল আরেক। এরা মুসলমানদের কাছে গিয়ে বলত আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। আর ইহুদিদের দেখলে বলত মুসলমানদের সঙ্গে আমরা উপহাস করেছি মাত্র। আমরা আসলে তোমাদের সঙ্গেই আছি। মদিনায় এই দুটি দুষ্টচক্রের সঙ্গে নবীজীকে অহরহ মোকাবিলা করতে হয়েছে। অপরদিকে মক্কার কোরেশদের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানোর জন্যও তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি সর্বদা কোরআনের অমীয় বাণী প্রচার করে সবাইকে পরিচ্ছন্ন জীবনের দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। একজন মানুষের জন্য জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে ডিসপ্লিন বা নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকা অতীব জরুরি। নিয়ন্ত্রণাধীন জীবন শান্তিময় হয়, সুখ-শান্তিতে ভরপুর থাকে। সে হায়াতে, সময়ে, সম্পদে বরকত পায়। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে এমন কিছু মনীষীকে দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন, যারা পৃথিবীবাসীর কল্যাণ কামনায় নিজ জীবন উৎসর্গ করেছেন। পার্থিব লোভ-লালসা ও সব মোহের ঊর্ধ্বে উঠে মানব সমাজের জাগতিক ও পারলৌকিক শান্তি ও মুক্তির আশায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কোনো কাজ করলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বরকত পাওয়া যাবে, সে পথের দিশা বাতলিয়ে দেন। খালিক ও মাখলুকের মাঝে সেতুবন্ধের অবিরাম মেহনত করে থাকেন। সমাজ সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার প্রতিটি মুহূর্ত যেন বরকতময় হয়, বরকতশূন্য না হয়, মানব জাতিকে সে বিষয়ে  তালিম দিয়ে থাকেন। তারা তো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বরকত পেতেন। তাদের দ্বারা লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হতো। কারণ একটিই তা হলো, তারা স্বীয় প্রভুর কাছে নিজেদের সর্বস্ব অর্পণ করে দিয়েছিলেন। যেমন : আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবেতাবেয়িন, ওলামায়ে মুজতাহেদিন, ওলামায়ে সলফ ও ওলামায়ে খলফদের সুমহান জামাত। তাদের জীবন ছিল একেবারে সাদামাটা। খুবই সাধারণ কাপড়-চোপড় পরিধান করতেন। সাধারণ খাবার-দাবার খেতেন। হায় হুতাশ ছিল না। না পাওয়ার বেদনা ছিল না। তারা আল্লাহর কাছে যা চাইতেন তা আল্লাহপাক দিয়ে দিতেন। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক থাকার কারণে সব কাজে বরকত পেতেন। দুনিয়াবি কাজকর্ম তাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করতে পারত না। তারা প্রয়োজন অনুপাতে পার্থিব কাজকর্ম করার পরও তাদের জবানে আল্লাহর জিকির চালু থাকত। মৃত্যুর যন্ত্রণা, কবরের আজাব এবং কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কি উত্তর দেবেন তার ভয় ছিল। সব সময় আল্লাহর আজাবের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন। নবীজীর সাহাবিদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, এমন লোকেরা, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। (তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে) যাতে আল্লাহ তাদের উত্কৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিজিক দান করেন। (সূরাতুন-নূর : ৩৭-৩৮) আলোচ্য আয়াতের বিষয়বস্তু দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যারা আল্লাহর বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করবে, আল্লাহপাক তাদের তিনটি জিনিস পুরস্কার দেবেন। এক. তিনি প্রতিটি উত্কৃষ্ট কাজের উত্তম প্রতিদান দেন। দুই. তিনি নিজ অনুগ্রহে অসংখ্য-অগণিত প্রতিদান দেন।

তিন. দুনিয়াতে রিজিকের কোনো অভাব রাখেন না। প্রতিটি কাজে বরকত দেন এবং বরকতময় জীবন ধারণ করার তৌফিক দান করেন। মূলত যারা হেদায়েতের আলোয়ে জীবন আলোকময় করে তারাই আল্লাহ কর্তৃক এমন বরকত ও শান্তি পেয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে অনিয়ন্ত্রণাধীন জীবন অশান্তি ও দুঃখ-কষ্টে ভরা থাকে। জীবনের কোনো কাজে বরকত পায় না। অর্থাৎ হায়াতে, সময়ে ও সম্পদে বরকত পায় না। দেখা যায় আল্লাহর দেওয়া হায়াত কখন ফুরিয়ে যায় টেরই পায় না। মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করার পরও উপার্জন বরকতহীন থাকে।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর