সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জেলা পরিষদ নির্বাচনের হালচাল

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার

জেলা পরিষদ নির্বাচনের হালচাল

দেশে প্রথমবারের মতো সমতলের ৬১টি জেলা পরিষদ নির্বাচন ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ অনুষ্ঠিত হবে। জেলা পরিষদ নির্বাচন পদ্ধতি অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ভিন্ন। জেলা পরিষদ একটি ইলেকটোরাল কলেজের দ্বারা বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে নির্বাচিত হবে। ইলেকটোরাল কলেজ সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন মেয়র ও কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। জেলা পরিষদের প্রার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ নেই। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের কোনো স্তরের প্রতিনিধিদের জেলা পরিষদে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকছে না। তবে সংশোধিত আইনে জেলা পরিষদের প্রশাসকের পদ ছেড়ে নির্বাচন করার বিধান রাখা হয়েছে।

দলীয় প্রতীকের নির্বাচন না হলেও আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসন সেটি আমলে নেয়নি এবং আইনসিদ্ধভাবে তা নেওয়ার সুযোগও নেই। অন্যদিকে নির্বাচকমণ্ডলীর অধিকাংশ, অর্থাৎ বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকারদলীয় হওয়ায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এ নির্বাচন বর্জন করছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সদস্যপদে যথেষ্ট প্রার্থী রয়েছে। উল্লেখ্য, এ নির্বাচনে ২২ জেলায় চেয়ারম্যান পদের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নির্বাচন বর্জনের পরেও বাকি ৩৯টি জেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১২৪ জন প্রার্থী। অর্থাৎ এসব জেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী একই দলের অমনোনীত প্রার্থী বা অন্য প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসকদের মধ্যে যারা দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের অনেকেই ক্ষমতায় থাকাকালীন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জেলার উন্নয়ন পারফর্মেন্সের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলের মনোনয়নের বাইরের প্রার্থীদের যথেষ্ট স্থানীয় জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের উদারনৈতিক মনোভাব কৌশলগতভাবে দলের জন্য এবং প্রতিযোগিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ভালো হতো। পূর্বোক্ত শেষাংশটিও ক্ষমতাসীন দলের ইমেজকে বৃদ্ধি করত বা করবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব অত্যন্ত প্রাজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। দলেরও সে পথে হাঁটা উচিত। অন্যথায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রশ্নটি অনেক বড় হয়ে দেখা দেবে এবং তার দায় কেন্দ্র ও তৃণমূল উভয়কেই বহন করতে হবে। কারণ সাব-সিস্টেমগুলো যখন বিস্তৃতভাবে সিস্টেমের বাইরে কাজ করে তখন সিস্টেম রিভিউ অথবা নীতি বা কৌশল পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ এটি সিস্টেমের ব্যর্থতা হিসেবেও বিবেচিত হয়। এই যুক্তিতে এক্ষেত্রে উত্তম পন্থা হচ্ছে নির্বাচনপূর্বে ক্ষমতাসীন দলের মুক্ত বা উদার মনোভাব প্রকাশ করা। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটি যেমন দলের রাজনীতির জন্য ভালো, তেমনি জেলা পরিষদের বিদ্যমান আইনের স্পৃহা অর্থাৎ নির্দলীয় নির্বাচন নীতির জন্যও ভালো।

যাই হোক, এবার জেলা পরিষদের ইতিহাসটি একটু দেখা যাক। জেলা পরিষদ ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু ছিল জেলা বোর্ড নামে। পাকিস্তান আমলে এর নামকরণ করা হয় জেলা কাউন্সিল। স্বাধীনতার পর এটি আবার জেলা বোর্ড নামে অভিহিত হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জেলা বোর্ডের কাঠামোকে সুসংগত করার জন্য জেলা গভর্নর পদ্ধতি চালু করেন কিন্তু তা কার্যকর করার সুযোগ হয়নি। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং জেলা বোর্ডের নামকরণ করা হয় জেলা পরিষদ। সে সময় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হতো। ১৯৮৮ সালে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ১৯৮৮ পাস হয়। ওই আইনেও পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্য নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকার নির্বাচন না করে দলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ করতে চায়। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের সময় ওই আইনটি বাতিল করে দেওয়া হয়। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা শুরু হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ পাস করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এলে জেলা পরিষদ সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকার জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ৮২(১) ধারা অনুযায়ী দেশের পার্বত্য তিনটি জেলা বাদে বাকি ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করে। সে আইন অনুসারে, নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসক জেলা পরিষদের কার্যাবলি সম্পাদন করবেন।

পাঁচ বছর প্রশাসক দ্বারা জেলা পরিষদ পরিচালিত হওয়ার পর ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠিত হতে যাচ্ছে। তিনটি পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধি বাদে প্রায় ৬৫ হাজার স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৫৮ হাজার) জনপ্রতিনিধি রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদে। আইয়ুবীয় বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র ধাঁচের ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে নির্বাচন সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। তা সত্ত্বেও জেলা পরিষদ ধারণাটাকে ক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে একটি বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেক ধন্যবাদ। তুলনামূলকভাবে এ সরকার স্থানীয় সরকারের উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে অনেক কাজ করেছে; যদিও এখনো বাংলাদেশে একটি সমন্বিত স্থানীয় শাসন নীতি প্রণীত হয়নি।

লেখক : উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর