বাংলা একাডেমির হয়েছেটা কী? বছর বছর তারা জাতীয় বইমেলায় বইয়ের প্রকাশকদের বই বিক্রি অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে! তাঁদের অধিকার নেই মেলায় বই বিক্রি করার যাঁরা সারা বছর অপেক্ষা করেন একটি মাস বই বিক্রি করবেন বলে। এই মেলায় যোগ দেবেন বলেই যাঁরা বই প্রকাশ করেন, তাঁরা হঠাত্ শুনছেন, তাঁরা নিষিদ্ধ। হাবিজাবি কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৬ সালে ব-দ্বীপ প্রকাশনীকে করেছে নিষিদ্ধ। বই লেখার অপরাধে ব-দ্বীপের লেখক-প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিককে জেলে পোরা হয়েছে। কত ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অপরাধী জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়, বেরোনো হয় না মানিকের। পর পর দু’বছর দুটো প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করে ধিকৃত হওয়ার পর তারা ফের নতুন উদ্যমে নিষিদ্ধ করেছে আরও একটি প্রকাশনীকে। ২০১৭-২০১৮ সালের জন্য বেচারা শ্রাবণ প্রকাশনী নিষিদ্ধ। কী দোষ শ্রাবণ প্রকাশনীর? এর কর্ণধার নাকি নানা ছুঁতোয় মত প্রকাশের বিরুদ্ধে যাওয়ার সমালোচনা করেছিলেন। এসব দেখে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছে বাংলা একাডেমি একটি আদর্শ বিচ্যুত একাডেমি, যে একাডেমির দাঁড়ানোর কথা মুক্তচিন্তার পক্ষে, দাঁড়াচ্ছে মুক্তচিন্তার বিপক্ষে।
বাংলা একাডেমি যে আগেও লেখকদের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে ছিল, তার সাক্ষী আমি। স্মৃতি ঘেঁটে বলছি—
“১৯৯১ সাল। বইমেলা শুরু হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা। সেদিন সতেরোই ফেব্রুয়ারির সন্ধেবেলা। মেলায় একটি চাপা উত্তেজনার গন্ধ পাওয়া যায়। উত্তেজনা কেন, কিসের জন্য, আমার জানা হয় না কিছু। বিশাল একটি ব্যানার নিয়ে একটি মিছিল বিদ্যাপ্রকাশের সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। মেলার মধ্যে ব্যানার নিয়ে মিছিল! এ আবার কেমন! এমন তো দেখিনি আগে কোনও দিন! কি সেই মিছিল কেন সেই মিছিল প্রশ্ন করে কারও কাছ থেকে উত্তর পাওয়া যায় না। হঠাত্ দেখি খোকা টেবিল থেকে আমার বইগুলো দ্রুত তুলে ফেলছেন, বইয়ের তাক থেকে খোকার শালা আমার বই নামিয়ে নিচ্ছেন। তখনই হঠাত্ মুহম্মদ নূরুল হুদা আর রফিক আজাদ আমাকে বের করে নিলেন স্টল থেকে। আমাকে নিয়ে বাংলা একাডেমির মূল দালানের ভেতর ঢুকে গেলেন। একেবারে মহাপরিচালকের ঘরে। ঘটনা কি! ঘটনা যা জানা গেল, তা হলো, আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হয়েছে। তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটি এই মিছিলটি করছে, আমাকে পিষে মারার জন্য এই মিছিল। মেলার বইয়ের স্টলগুলোয় কমিটির লোকেরা হুমকি দিয়ে এসেছে আমার বই যেন না রাখা হয় কোথাও। রাখলে ওরা স্টল ভেঙে ফেলবে নয়তো পুড়িয়ে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার বই যে স্টলগুলোয় ছিল, সরিয়ে ফেলা হলো। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। ঘরে আরও লেখক বসে ছিলেন। ফজলুল আলমও উঠে এসেছিলেন আমার পেছন পেছন। আশঙ্কায় তাঁর মুখ চোখ সব গোল গোল হয়ে আছে। মহাপরিচালকের ঘরে এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। মিছিল কেন হয়েছে, কারা করেছে, মেলার অস্থিরতা কি করে বন্ধ করা যায়। ব্যানারে কী লেখা এই নিয়ে ফিসফিস চলছে লেখকদের মধ্যে। মহাপরিচালক হঠাত্ আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন এই মিছিল হচ্ছে? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ওদের?’‘তা তো আমি জানি না কি অভিযোগ।’ আমি বলি।
মহাপরিচালক গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘খুব অশ্লীল কথা লেখা আছে ব্যানারে। কী মনে হয় আপনার, কেন এসব করছে ওরা?’
‘সম্ভবত আমার লেখার কারণে।’
‘লেখে তো অনেকেই। এই যে এখানে যত লেখক আছেন, সকলেই বই লেখেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তো মেলায় মিছিল হয় না। আপনার বিরুদ্ধে হয় কেন?’
ফজলুল আলমের কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠল, ‘হয় কেন মানে? উনি কি করে জানবেন হয় কেন! যারা হওয়ায় তারা জানে, কেন। আর তসলিমা নাসরিনের লেখা সকলে গ্রহণ করতে যাবে কেন! তাঁর লেখা তো আর সবার মতো আপোসের লেখা নয়!’
গুঞ্জন ওঠে লেখকদের মধ্যে। তবে কি তিনি তাঁদের বলছেন আপোস করে লেখেন তাঁরা। গুঞ্জন থামিয়ে মহাপরিচালক ভুরু কুঁচকে চাইলেন আমার দিকে, আমাকে বললেন, ‘মেয়ে হয়ে আপনি পুরুষের মতো লিখতে যান কেন? সে কারণেই তো ঝামেলা হচ্ছে।’
আমি ঝটিতে উত্তর দিই, ‘আমি পুরুষের মতো লিখব কেন! আমি আমার মতো করে লিখি।’
বসে থাকা লেখকরা একটু নড়ে চড়ে বসেন।
‘সবাইকে সব কিছু মানায় না। তা কি বুঝতে পারেন না?’ মহাপরিচালকের ঠোঁটের কোণে একটি হাসি ঝিকমিক করে। লেখকদের নিঃশ্বাসের টানে কিছু ঝিকমিক তাঁদের ঠোঁটের কোণেও আশ্রয় নেয়।
‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। কোনও মেয়ে কি আপনি যে ভাষায় লেখেন, সে ভাষায় লেখে?’
আমি চুপ।
‘না, লেখে না।’
মহাপরিচালকের মন্তব্যে লেখকদের মাথাও নড়ে, না লেখে না।
আমার চোয়াল শক্ত হচ্ছে।
‘আপনার লেখা খুব অশ্লীল।’
এবার দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ে বলে, ‘আমার লেখা কারও কাছে তা অশ্লীল মনে হয়, কারও কাছে মনে হয় না।’
মুহম্মদ নূরুল হুদা বাইরে গিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আসেন যে মেলার মধ্যে কোনও মিছিল যেন না হয়, এতে মেলার পরিবেশ নষ্ট হয়। কারও যদি কোনও অভিযোগ থেকে থাকে তবে যেন তা মেলা কমিটির সদস্যদের জানানো হয়। শান্ত হতে বলেন তিনি মিছিলের জনতাকে।
আগুন আগুন বলে একটি রব ওঠে মেলায়। ঘরে বসা লোকগুলোর কেউ কেউ জানালার দিকে ছুটে যান ঘটনা দেখতে। বই পোড়ানো হচ্ছে মেলার মাঠে। আমার বই মিছিলের লোকেরা যে যেখানে পেয়েছে মাঠের মাঝখানে জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছে।
খোকা দাঁড়িয়ে আছেন মহাপরিচালক হারুন উর রশীদের ঘরের বারান্দায়। আমি উঠে যাই খোকার কাছে। খোকা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে আছেন, ঘামছেন তিনি। চোয়াল খোকারও শক্ত হয়ে আছে।
‘কারা এই মিছিল করছে খোকা ভাই? জানেন কিছু?’
খোকা মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন না।
মহাপরিচালক মেলা কমিটির সদস্য বাংলা একাডেমির উপপরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানালেন, ‘আপনি মেলায় না এলে ভালো হয়।’
‘এ কেমন কথা, কেন আমি আসব না?’
ফজলুল আলম বলে ওঠেন, ‘কেন তিনি আসবেন না? তাঁর কি দোষ?’
‘উনি এলে মেলায় গণ্ডগোল হয়, তাই তিনি আসবেন না।’
জানিয়ে দিলেন, মেলায় যদি আমার ওপর কোনও আক্রমণ হয়, সেই দায়িত্ব মেলা কমিটি নিতে পারবে না। সুতরাং আমার নিরাপত্তার জন্য বইমেলায় আমার না আসাই ভালো। আমার জন্য মেলার পরিবেশ নষ্ট হোক, মেলা পণ্ড হয়ে যাক, তা তাঁরা চান না।
ফজলুল আলম চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘আপনারা মেলা কমিটির লোক, আপনারা তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন।’
ফজলুল আলমের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান মহাপরিচালক। চোখের ভুরুতে প্রশ্ন, লোকটি কে এখানে চিত্কার করছে! একে তো চিনি না!
কিছু ছেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করছে বলে আমার মেলায় আসা বন্ধ হবে কেন! অনেকে তো আমার লেখা পছন্দ করে, তারা...
আমার কোনও যুক্তিই মহাপরিচালক মেনে নেন না। মীমাংসা শেষ অবধি কিছুই হয় না। মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যে স্থির থাকেন। তাঁর পরামর্শ আমার আর মেলায় আসা উচিত নয়। যেহেতু আমি মেয়ে হয়ে পুরুষের মতো লিখি, যেহেতু আমি অশ্লীল লেখা লিখি, যেহেতু আমার লেখা আদৌ কোনও ভালো লেখা নয়, সেহেতু আমার বিরুদ্ধে মেলায় মিছিল বের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, আমাকে লোকে পেষণ করতে চাইবে, এও অবাক করা কোনও ব্যাপার নয়। সুতরাং আমি যেন মেলা থেকে দূরে থাকি, এ যত না আমার নিরাপত্তার জন্য, তার চেয়ে বেশি মেলার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার জন্য।
পুলিশের ভ্যানে তুলে দিয়ে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এর কিছু দিন পর আমার প্রকাশক জানি না কোত্থেকে কিছু পেশিবহুল লোক জোগাড় করলেন, যাদের কাজ আমাকে মেলায় নিয়ে যাওয়া আর মেলা শেষ হলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। অচেনা পেশি পরিবেষ্টিত হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মেলায় যাই বটে আমি, আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ জোটে না কিছুতে তবে খোকার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। কোনও লেখক তো এগিয়ে আসেনি কোনও সাহায্য করতে, মেলা কমিটি মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, এ সময় খোকা এই মীমাংসাটি না করলে আমাকে এক ঘোর হতাশার মধ্যে ঘরে বসে থাকতে হতো। যে দুটো দিন মেলায় গিয়েছি, বিদ্যাপ্রকাশের স্টলেই বসে ছিলাম। মেলার মাঠে হাঁটাহাঁটি বা চায়ের স্টলে গিয়ে চা খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হলেও যেতে পারিনি। স্টলেও বেশিক্ষণ বসা হয়নি, ঘণ্টা দুঘণ্টা পর বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তবে আমি যে যে করেই হোক গিয়েছি মেলায়, সেটিই ছিল বড় ঘটনা। যদিও আশঙ্কা নামের কুিসত একটি জিনিসকে কোনও আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতে পারিনি, যদিও খোকার চোখ সারাক্ষণই অস্থির ছিল উদ্বেগে তবু বিজয়ের প্রশান্তি অল্প হলেও কিছু ছিল তাঁর মনে। ফজলুল আলম উত্কণ্ঠা এবং উচ্ছ্বাস দুটো নিয়েই নিরাপদ একটি দূরত্বে হাঁটাহাঁটি করেন। বইমেলা কমিটির লোকেরা আমাকে ভুরু কুঁচকে দেখেছেন। জ্বলজ্যান্ত উপদ্রুবটিকে দেখতে তাঁদের ভালো লাগেনি। আমার মতো আস্ত একটি সমস্যা মেলায় উপস্থিত হলে কী না কী অঘটন ঘটে কে জানে! মেলায় যদি জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়ে যায়, তবে! তার চেয়ে একা আমাকে কোথাও নিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিলে মেলাটা অন্তত বাঁচে। মেলার স্টলগুলোয় আমার বই নেই। বেশির ভাগই ছিনিয়ে নিয়েছে পেষণ কমিটির লোকেরা। বেশির ভাগই পুড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও স্টলে বই আছে, সেসব বই লুকিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের তলায়। প্রতি বছরের মতো বাংলা একাডেমি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠান করছে। আগের বছরের অনুষ্ঠানগুলোয় কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, এবার আমি আমন্ত্রিত নই।”
—-এভাবেই আমাকে ব্রাত্য করেছিল বাংলা একাডেমি। তারপর তো গোটা দেশই ব্রাত্য করলো। লেখকরা তখন চুপ ছিলেন। তাঁরা এখনো চুপ। চুপ থাকার কালচার তৈরি হয়ে গেছে দেশটিতে। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে এই কালচারটি বেশ জনপ্রিয়, যাঁদের রুখে দাঁড়ানোর কথা মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে। তাঁরা সম্ভবত পাওয়ারফুলদের ভাষায় কথা বলেন বলে, নিজের কোনো ভিন্ন মত নেই বলে, জানেন যে তাঁদের মত নিয়ে কোথাও কোনো রকম অসুবিধেয় পড়তে হবে না। নিজের সুবিধে হলেই হলো, অন্যের অসুবিধেয় তাঁদের কিছু যায় আসে না। দেশ কতটা নষ্ট হলে বাংলা একাডেমির মেলায় কোনো প্রকাশনীর স্টল নিষিদ্ধ করা হয় এবং লেখক কবিরা চুপ থাকতে পারেন— তা নিশ্চয়ই আমরা অনুমান করতে পারছি।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।